এপিক্টেটসের উপদেশ/অভ্যাস ও সাধনা
অভ্যাস ও সাধনা।
১। আমাদের প্রত্যেক শক্তিকে—প্রত্যেক বৃত্তিকে যদি আমরা কাজে খাটাই তবেই উহা পরিরক্ষিত ও পরিবর্দ্ধিত হইতে পারে; চলিবার শক্তি, চলিয়া-দৌড়িবার শক্তি, দৌড়িয়া বর্দ্ধিত হয়। তুমি যদি সুচারুরূপে কোনকিছু আবৃত্তি করিতে চাহ, তাহা হইলে ক্রমাগত তাহার আবৃত্তি করিতে হইবে; যদি ভাল লিখিতে চাহ, তাহা হইলে ক্রমাগত লিখিতে হইবে। যদি একমাস কাল তুমি উচ্চৈঃস্বরে আবৃত্তি না কর—আবৃত্তি না করিয়া আর কিছু কর—তাহা হইলে দেখিবে, তাহার ফল কি হয়। যদি তুমি দশ দিন শয্যাশায়ী থাকিয়া, তাহার পর একদিন, অনেক দূর হাঁটিতে চেষ্টা কর, তাহা হইলে দেখিবে, তোমার পা দুর্ব্বল হইয়া পড়িয়াছে। স্থূল কথা, যদি কোন বিষয়ে তুমি দক্ষতা লাভ করিতে চাহ, তাহা হইলে, কাজে তাহা কর; আর যদি কোন বিষয়ে নিবৃত্ত হইতে চাহ, তাহা হইলে, একেবারেই তাহা করিও না। তাহার বদলে আর কিছু কর।
২। আধ্যাত্মিক বিষয়েও ঠিক্ এইরূপ। তুমি যদি এক বার ক্রুদ্ধ হও, তাহা হইলে জানিবে, তাহাতে তোমার এক বার মাত্র অনিষ্ট হইল না,—প্রত্যুত, ঐ অনিষ্টের প্রবণতা বৃদ্ধি হইল;—তুমি অনলে ঘৃতাহুতি প্রদান করিলে। তুমি যদি রিপুর দ্বারা অভিভূত হও, তাহা হইলে মনে করিও না—তোমার উপর রিপু একবার মাত্র জয় লাভ করিল; পরন্তু ইহার দ্বারা তুমি তোমার ইন্দ্রিয়-দৌর্ব্বল্যকে পরিপুষ্ট ও বর্দ্ধিত করিলে। কেননা কার্য্যের দ্বারাই শক্তিসমূহ—বৃত্তিসমূহ ফুটিয়া উঠে, প্রবল হইয়া উঠে, ব্যাপ্ত হইয়া পড়ে। তত্বজ্ঞানীরা বলেন, এই রূপেই আত্মারও পাপ-প্রবণতার বৃদ্ধি হয়। ধনে যদি তোমার কথন লোভ হয়, আর সেই সময়ে যদি তুমি ধর্ম্মবুদ্ধির শরণাপন্ন হও, তাহা হইলে, তোমার লোভের ও দমন হইবে এবং তোমার ধর্ম্মবুদ্ধিও বললাভ করিয়া স্বপদে পূর্ব্ববৎ সুপ্রতিষ্ঠিত হইবে। কিন্তু যদি তুমি ধর্ম্মবুদ্ধির শরণাপন্ন না হও, তাহা হইলে, তোমার আত্মার পূর্ব্ববৎ নির্ম্মল অবস্থা আর ফিরিয়া পাইবে না; যখনি আবার কোন প্রলোভন আসিবে, তখন পূর্ব্বাপেক্ষা আরো শীঘ্র তোমার বাসনানল প্রজ্বলিত হইয়া উঠিবে। এইরূপ যখন ক্রমাগত ঘটিতে থাকিবে, তখন তোমার আত্মা ক্রমশঃ অসাড় হইয়া পড়িবে; এই দুর্ব্বলতা প্রযুক্ত, তোমার ধনলালসাও আরো প্রবল হইয়া উঠিবে। যে ব্যক্তি একবার জ্বর-রোগে আক্রান্ত হইয়াছে, তাহার জ্বর ত্যাগ হইলেও,সম্পূর্ণ আরোগ্য লাভ না করিলে, সে আর পূর্ব্বাবস্থা প্রাপ্ত হয় না। আত্মার রোগেও এইরূপ হইয়া থাকে। রোগের পর, আত্মায় যে সকল ক্ষতচিহ্ন থাকিয়া যায়, সেই ক্ষতচিহ্নগুলিকে যদি একেবারে নির্ম্মূলিত না কর, আর সেই স্থানে আবার যদি কখনও পাপের আঁচ লাগে, তাহা হইলে, সেই ক্ষতচিহ্নগুলি তখন আর চিহ্নমাত্র থাকে না, তখন সেইখানে আবার “দগ্দগে ঘা” হইয়া পড়ে।
৩। “আমার কোপন-স্বভাব চলিয়া যাউক”—এই রূপ যদি তোমার ইচ্ছা হয়, তাহা হইলে উহার প্রবণতাকে পোষণ করিও না; উহাতে এমন কোন আহুতি প্রদান করিও না যাহাতে উহা আরো জ্বলিয়া উঠে; প্রথম হইতেই শান্তভাব ধারণ কর; এবং বিনা ক্রোধে কতদিন অতিবাহিত হইল তাহার গণনা করিতে থাক;—“এইবার আমি একদিন ক্রুদ্ধ হই নাই;—এইবার, দুই দিন ক্রুদ্ধ হই নাই;—এইবার, তিন দিন ক্রুদ্ধ হই নাই”;—এইরূপ যদি ৩০ দিন ক্রুদ্ধ না হইয়া থাকিতে পার, তখন দেবতার উদ্দেশে যজ্ঞাদির অনুষ্ঠান করিবে। এইরূপে প্রবণতাগুলি ক্রমশঃ দুর্ব্বল হইয়া, একেবারেই নির্ম্মূলিত হইবে।
৪। ইহাতে সুসিদ্ধ কিরূপে হওয়া যায়? আত্মপ্রসাদ লাভ করিব,—ঈশ্বরের সমক্ষে নিষ্কলঙ্ক সুন্দর থাকিব—এইরূপ দৃঢ়সঙ্কল্প হৃদয়ে ধারণ কর; আমি আমার নির্ম্মল অন্তরাত্মার নিকটে নির্ম্মল থাকিব, ঈশ্বরের নিকটে বিশুদ্ধ থাকিব—সর্ব্বান্তঃকরণে এইরূপ ইচ্ছা কর। পরে যদি কোন প্রলোভনে পতিত হও, তখন কি করিবে? প্লেটো কি বলেন শোন:— পুণ্য-কর্ম্মের অনুষ্ঠান কর, দুর্ব্বলের সহায় ও আশ্রয় দেবতাদিগের মন্দিরে গিয়া প্রার্থনাদি কর।” কি মৃত, কি জীবিত সর্ব্বপ্রকার সাধু ও জ্ঞানী লোকের সহবাস অন্বেষণ কর, তাহা হইলেও যথেষ্ট হইবে।
৫। এই সকল উপায় অবলম্বন করিলে, তুমি প্রলোভনকে জয় করিতে পারিবে;—প্রলোভনের দ্বারা অভিভূত হইবে না। কিন্তু প্রথম হইতেই প্রলোভনের উদ্দামবেগে ভাসিয়া যাইও না। প্রথমেই তাহাকে এইরূপ বলিবে “রে প্রলোভন! একটু অপেক্ষা কর; আগে আমি দেখি—বস্তুটা তুই কি;— আর, তোর কাজটাই বা কি;— তোকে একবার যাচাইয়া লই।” প্রলোভনের দ্বারা নীয়মান হইবার পূর্ব্বে, একবার মনে মনে কল্পনা করিয়া দেখ, উহার শেষপরিণামটা কি। তা যদি না কর, তোমার চিত্তকে সে অধিকার করিয়া বসিবে এবং যেখানে খুসি তোমাকে লইয়া যাইবে। আর এক কাজ কর;—এই নীচ প্রলোভনের বিরুদ্ধে একটা উচ্চতর মহত্তর প্রলোভন আনিয়া তোমার সম্মুখে খাড়া কর, এবং সেই উচ্চ প্রলোভনের সাহায্যে নীচ প্রলোভনটাকে দুর করিয়া দেও। এইরূপে যদি তুমি অভ্যাস সাধনা কর, তাহা হইলে দেখিবে, তোমার স্কন্ধ, তোমার পেশী, তোমার স্নায়ু কতটা বলিষ্ঠ ও দ্রঢ়িষ্ঠ হইয়াছে। কিন্তু তাহা না করিলে, কেবল কথাই সার হইবে—কথা ছাড়া আর কিছুই হইবে না।
৬। সে-ই যথার্থ মল্লযোদ্ধা, যে এই সকল প্রলোভনের সহিত নিয়ত যুদ্ধ করে। মহান্ এই সংগ্রাম, স্বগীয় এই ব্রত,—যাহার ফল সর্ব্বাধিপত্য, যাহার ফল স্বাধীনতা, যাহার ফল সৌভাগ্য সমৃদ্ধি, যাহার ফল চিত্ত-শান্তি। ঈশ্বরকে স্মরণ কর, তাঁহার সাহায্য প্রার্থনা কর, তাঁহার শরণাপন্ন হও। ঝড়ের সময় নাবিক যেমন বরুণদেবকে ডাকে, তেমনি এই প্রলােভন-ঝটিকায় ঈশ্বরকে ডাক। যে ঝড়ে বিবেকবুদ্ধি অভিভূত ও বিপর্য্যস্ত হয়, তাহা অপেক্ষা প্রবল ঝড় আর কি আছে? আর যাহাকে তুমি ঝড় বল—সেই বা কি? সেও ত একটা প্রতীতি মাত্র—একটা অবভাস মাত্র। তাহা হইতে মৃত্যুভয় অপসারিত করিয়া লও,—দেখিবে,—যতই বজ্র বিদ্যুৎ হউক—আকাশ বেশ নির্ম্মল;—দেখিবে, আত্মার কাণ্ডারী সেই বিবেকবুদ্ধি কেমন স্থির ও প্রশান্ত! কিন্তু একবার পরাভূত হইয়া, যদি তাহার পর তুমি বল?—“এইবার আমি জয়ী হইব,” এবং প্রত্যেক বার যদি এই একই কথা তুমি বলিতে থাক, তাহা হইলে নিশ্চয় জানিবে,—অবশেষে তােমার এমন একটা হীনদশা উপস্থিত হইবে—তােমার এমন একটা দুর্ব্বল অবস্থা আসিয়া পড়িবে যে, তখন তুমি পাপ করিতেছ বলিয়া জানিতেও পারিবে না; তখন তুমি সেই পাপ-কার্য্যের জন্য নানাপ্রকার ওজর খুঁজিতে থাকিবে; তখন হেসিয়ডের এই উক্তিটির সত্যতা প্রমাণ হইবে:—“দীর্ঘসূত্রী যুঝে সদা অশেষ অনর্থ-সাথে।”
৭। তবে কি মানুষ এইরূপ দৃঢ়সঙ্কল্প করিয়া চিরকাল নির্দোষ থাকিতে পারে?—না, তাহা পারে না। তবে নির্দোষিতার দিকে অগ্রসর হইবার জন্য ক্রমাগত চেষ্টা করা—মানুষ অন্ততঃ এইটুকু পারে। আমাদের চেষ্টায় একটুও বিরাম না দিয়া, কিছুমাত্র শৈথিল্য না করিয়া, অন্ততঃ দুই চারিটি দোষ হইতেও যদি আমরা মুক্তিলাভ করিতে পারি, তাহা হইলেও আমাদের পরম সৌভাগ্য! তুমি যে এখন বলিতেছ— “কল্য হইতে আমি সাবধান হইব”, এ কথার অর্থ এই —“আজ আমি নির্লজ্জ হইব, দুরাগ্রহী হইব, নীচ হইব; আজ আমাকে কষ্ট দিতে অপরের সামর্থ্য থাকিবে, আজ আমি ক্রোধের বশীভূত হইব, ঈর্ষার বশীভূত হইব।” দেখ, কতগুলা পাপকে তুমি ডাকিয়া আনিতেছ! কল্যকার জন্য যদি কোন কাজ ভাল মনে কর, সে কাজটা আজই করা কি আরো ভাল নহে? কাল যদি কোন কাজ করিবার যোগ্য হয়, আজ কি তাহা আরো করিবার যোগ্য নহে? আজ, সে কাজ আরো এইজন্য করা উচিত যে, কাল তাহা করিতে তুমি সমর্থ হইবে—করিবার জন্য বল পাইবে; তাহা হইলে তুমি আর তাহা পর দিনের জন্য স্থগিত রাখিবে না।