এপিক্‌টেটসের উপদেশ/তত্ত্বজ্ঞানের পথ

তত্ত্বজ্ঞানের পথ।

 একদা, কোন একজন রোমবাসী স্বীয় পুত্র-সমভিব্যাহারে প্রবেশ করিয়া, এপিক্‌টেটসের উপদেশ শ্রবণ করিতে লাগিল। এপিক্‌টেটস্ বলিলেন “এইরূপ আমার উপদেশ-পদ্ধতি”; এবং এই কথা বলিয়া চুপ করিয়া রহিলেন। কিন্তু আগন্তুক ব্যক্তি যখন তাঁহাকে আবার উপদেশ দিতে অনুরোধ করিল, তখন তিনি আবার এইরূপ বলিতে আরম্ভ করিলেন:—

 যাহারা অশিক্ষিত ও অপটু, তাহারা যখন কোন বিদ্যা শিক্ষা করিতে প্রথম আরম্ভ করে, তখন তাহাদের নিকট উহা অত্যন্ত ক্লান্তিজনক বলিয়া বোধ হয়। কিন্তু সেই বিদ্যার দ্বারা যে সামগ্রী প্রস্তুত হয়, তাহার প্রয়োজনীয়তা ও ব্যবহার্য্যতা তৎক্ষণাৎ সকলেরই প্রত্যক্ষগোচর হইয়া থাকে, এবং সেই সকল সামগ্রীর মধ্যে প্রায়ই এমন কিছু থাকে, যাহা চিত্তাকর্ষক ও প্রীতিজনক। কোন চর্ম্মকার যখন পাদুকা নির্ম্মাণ করে, তখন যদি কেহ সেখানে দাঁড়াইয়া দেখে, তখন তাহা দেখিয়া তাহার সুখ হয় না; কিন্তু বাস্তব পক্ষে পাদুকা একটি কাজের জিনিস; এবং উহা তৈয়ারি হইয়া গেলে, দেখিতেও মন্দ লাগে না। এইরূপ ছুতার-মিস্ত্রীরও কাজ দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া দেখা অত্যন্ত কষ্টকর বলিয়া বোধ হয়; কিন্তু কাজটি শেষ হইলে, তাহার প্রয়োজনীয়তা তৎক্ষণাৎ উপলব্ধি হয়। সঙ্গীত-শিক্ষা সম্বন্ধে এই কথাটি আরও খাটে। সঙ্গীত-শিক্ষার উপদেশ শোনা অত্যন্ত কষ্টকর; কিন্তু সঙ্গীত কাহার না ভাল লাগে?—অশিক্ষিত ব্যক্তিরও ভাল লাগে। যিনি তত্ত্ববিদ্যা শিক্ষা করেন, তাঁহারও একটা বিশেষ উদ্দেশ্য আছে; এমন করিয়া সমস্ত বাহ্য ঘটনার সহিত ইচ্ছাকে খাপ্ খাওয়াইতে হইবে, যাহাতে আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোন ঘটনা না হয়, অথবা যাহা আমি ইচ্ছা করিব তাহা ছাড়া আর কিছু ঘটিতে না পায়। এই শিক্ষা ও সাধনার ফলে তত্ত্বজ্ঞানী যাহা ইচ্ছা করেন তাহাই প্রাপ্ত হন, এবং যাহা ইচ্ছা করেন না তাহা পরিহার করিতে পারেন। এইরূপে তিনি বিনা কষ্টে, বিনা ভয়ে, বিনা উদ্বেগে জীবন যাপন করেন। এই তাে তত্ত্বজ্ঞানীর কাজ। কিন্তু এখন কথা হইতেছে, এই কাজটি কি উপায়ে সংসাধিত হইতে পারে?

 ২। ছুতার-মিস্ত্রী যে ছুতার-মিস্ত্রী হয়, সে একটা কিছু শিখিয়াই হয়; নাবিক যে নাবিক হয়, সেও একটা কিছু শিখিয়া তবে হয়। তত্ত্বজ্ঞানীর পক্ষেও কি সে কথা খাটে না? আমরা ভাল হইব, জ্ঞানী হইব—ইহা কি শুধু ইচ্ছা করিলেই হয়?—না, তাহার জন্য একটা-কিছু বিশেষ শিক্ষা চাই—সাধনা চাই? এখন তবে দেখা যাক্ প্রথমে আমাদের কি শিক্ষা করিতে হইবে।

 ৩। তত্ত্বজ্ঞানীরা বলেন, সর্ব্বাগ্রে এই কথাটি জানা আবশ্যক যে, ঈশ্বর আছেন, তিনি সকল পদার্থেরই তত্ত্বাবধান করেন; তাঁহার নিকট হইতে—কি কার্য্য, কি চিন্তা, কি কামনা—কিছুই গােপন করা যায় না। তাহার পর জানিতে হইবে দেবতাদের প্রকৃতি কি। দেবতাদের প্রকৃতি যেরূপ অবধারিত হইবে, যথাসাধ্য তাঁহাদের সেবা ও তুষ্টিসাধন করিয়া, ভক্তজন তাঁহাদের অনুরূপ হইবার চেষ্টা করিবেন। যদি দেবতা সত্যনিষ্ঠ হয়েন, তাহা হইলে তাঁহারও সত্যনিষ্ঠ হইতে হইবে। যদি তিনি মুক্ত হন, তাহলে তাঁহাকেও মুক্ত হইতে হইবে; যদি তিনি শুভঙ্কর হয়েন, তাহা হইলে তাঁহাকেও শুভঙ্কর হইতে হইবে; যদি তিনি মহানুভব হয়েন, তাহা হইলে তাঁহাকেও মহানুভব হইতে হইবে। এইরূপে দেবতার সমকক্ষ হইবার চেষ্টা করিয়া, তিনি সেই ভাবের অনুরূপ কথা কহিবেন ও কার্য্য করিবেন।

 ৪। আচ্ছ। তবে, কোথা হইতে প্রথম আরম্ভ করা যাইবে? আমি বলি, প্রথমে বাক্যের অর্থের প্রতি মনোযোগী হও।

 —“তবে কি বাক্যার্থ আমি বুঝি না?”

 —“না, তুমি বোঝো না।”

 —“কি করিয়া তবে আমি বাক্য ব্যবহার করি?”

 অশিক্ষিতেরা যেরূপ লিখিত বাক্য ব্যবহার করে, কিম্বা গোমহিষেরা যেরূপ বাহ্য পদার্থ সকল ব্যবহার করে, তুমিও সেইরূপ করিয়া বাবহার করিয়া থাক। কারণ, ব্যবহার এক জিনিস, আর বুঝা আর এক জিনিস। তুমি যদি মনে কর, বাক্যার্থ তুমি বুঝ—ভাল, কোন একটা কথা লইয়া দেখা যাক্, তুমি উহার অর্থ বুঝ কি না। কিন্তু তোমার মতো বৃদ্ধের পক্ষে হার-মানা কষ্টকর হইবে। আমি ইহা বিলক্ষণ জানি, তুমি এইখানে এইভাবে আসিয়াছ, যেন তোমার কিছুই অভাব নাই। হাঁ, তুমি মনে করিতেছ, তোমার কিসের অভাব। তোমার ধন ঐশ্বর্য্য আছে, সন্তান-সন্ততি আছে, হয়তো পত্নীও আছে, অনেক দাসদাসীও আছে; সীজার তোমাকে জানেন, রোমে তোমার অনেক বন্ধুবান্ধব আছে; যথাযোগ্যরূপে তুমি তোমার অধীনজনদিগকে দণ্ড পুরস্কার বিধান করিয়া থাক—ভাল যে করে তাহার ভাল কর, মন্দ যে করে তাহার মন্দ কর। আর তোমার চাই কি? এখন তোমাকে যদি আমি দেখাইয়া দিই, প্রকৃত সুখের জন্য তোমার যে সকল বস্তু নিতান্ত আবশ্যক, তাহা তোমার কিছুই নাই; এবং যাহা তোমার পক্ষে নিতান্ত আবশ্যক, কেবল সেইগুলিই ছাড়া আর অন্য সমস্ত বস্তু এতাবৎকাল তুমি অনুসরণ করিয়াছ; ঈশ্বর কি পদার্থ, মানুষ কি পদার্থ, ভাল কাহাকে বলে, মন কাহাকে বলে, তাহা তুমি জান না; এই সমস্ত যদি তোমাকে দেখাইয়া দি, তাহা হইলে তোমার অসহ্য হইবে; যদি আমি অপর বস্তু সম্বন্ধে বলি, তুমি কিছুই জান না, তাহাও বরং তোমার সহ্য হইবে; কিন্তু যদি বলি, তুমি আপনাকে আপনি জান না, তাহা তোমার কখনই সহ্য হইবে না; তাহা হইলে তুমি ক্রুদ্ধ হইয়া এখান হইতে চলিয়া যাইবে। কিন্তু ইহা বলিয়া আমি কি তোমার কোন অনিষ্ট করিলাম? একজন কুৎসিৎ ব্যক্তির সম্মুখে দর্পণ ধরিলে কি তাহার অনিষ্ট করা হয়? একজন চিকিৎসক যখন কোন রোগীকে বলেন, “বাপু, তুমি কি মনে করিতেছ তোমার পীড়া হয় নাই? আমি দেখিতেছি, তোমার জ্বর হইয়াছে। আজ কিছু আহার করিও না; শুধু একটু জল খাইয়া থাকিও”—এই কথায় কোন রোগী তো বলে না, “তুমি আমাকে অপমান করিলে।” কিন্তু যদি কাহাকে বলা যায়, “তোমার চেষ্টাসকল চিত্তদহন-কারী, তোমার পরিত্যক্ত বিষয়গুলি নীচতা-সূচক, তোমার উদ্দেশ্য সকল নীতি-বিরহিত; তোমার হৃদয়ের আবেগসমূহ প্রকৃতির সহিত মিল হয় না; তোমার মতামত-সকল শূন্যগর্ভ ও মিথ্যা—তাহা হইলে তখনই সে বলিয়া উঠিবে—“ঐ ব্যক্তি আমাকে অপমান করিয়াছে।”

 ৫। কোন একটা বৃহৎ মেলায়, লোকেরা যেরূপভাবে কাজ করে, আমরাও সংসারে সেইরূপ ভাবে কাজ করিয়া থাকি। মেলায় গো মেষাদি বিক্রয়ার্থ আনীত হয়। অধিকাংশ লোকেই কেহ বা কিনিতে আইসে, কেহ বা বেচিতে আইসে। শুধু মেলা দর্শনের জন্য অতি অল্প লোকেই আসিয়া থাকে। কি জন্য মেলা স্থাপিত হইয়াছে, কে উহার স্থাপনকর্ত্তা, উহাতে কি কাজ হয়, এ সব তত্ত্ব জানিবার জন্য অতি অল্প লোকেই আইসে। এই ভব-মেলাতেও তাহাই হইয়া থাকে। গোমেষাদির ন্যায় কেহ কেহ কেবল ঘাস-দানা খাইতেই ব্যাপৃত। যাহারা শুধু ধন জন ঐশ্বর্য্যই ভোগ করে তাহারা গোমেষাদির ন্যায় শুধু ঘাস-দানা খায় না তো আর কি। শুধু দর্শন-সুখ লাভ করিবার জন্য অতি অল্প লােকেই আইসে; সংসার কি পদার্থ, সংসারের কর্ত্তা কে, এ তত্ত্ব জানিবার জন্য অতি অল্প লােকেই লালায়িত। কোন ক্ষুদ্র রাজ্য, কোন একটি সামান্য গৃহ, কর্ত্তা ব্যতীত, তত্ত্বাবধায়ক ব্যতীত, ক্ষণকালও তিষ্ঠিয়া থাকিতে পারে না। তবে কি শুধু এই মহা বিশ্বনিকেতনটি দৈবের দ্বারা, আকস্মিক ঘটনাপুঞ্জের দ্বারা, এমন সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালিত হইতেছে? অতএব দেখা যাইতেছে জগতের একজন কর্ত্তা আছেন। কিন্তু তাঁহার স্বরূপ কি?—কি করিয়া তিনি শাসন করেন? এবং আমরাই বা কি পদার্থ? এবং কি উদ্দেশেই বা আমরা সৃষ্ট হইয়াছি?—ঈশ্বরের সহিত আমাদের কি কোন বন্ধন-সূত্র আছে, না কিছুই নাই?

 যে অল্পসংখ্যক লােক এই সকল তত্ত্বানুসন্ধানে ব্যাপৃত থাকে, সাধারণ লােকে তাহাদিগকে উপহাস করে! মেলা-ভূমিতেও, ব্যবসাদারেরা দর্শকদিগকে এইরূপই উপহাস করিয়া থাকে; এবং গোমেষাদিরও যদি চিন্তাশক্তি থাকিত, তাহা হইলে তাহারাও দর্শকদিগকে এইরূপ ভাবেই উপহাস করিত; তাহারা নিশ্চয় বলিত, এই মূর্খেরা যদি এখানে আসিয়া ঘাস-দানা উপভােগ না করিল, তবে এখানে আসিয়া করিল কি?