এপিক্টেটসের উপদেশ/নব-শিক্ষার্থীর প্রতি
নব-শিক্ষার্থীর প্রতি।
এ কথা যেন স্মরণ থাকে, কোন বস্তু-বিশেষকে পাইবার জন্যই আমরা তাহার অনুসরণ করিয়া থাকি; এবং কোন বস্তুকে এড়াইবার জন্যই তাহাকে বর্জ্জন করিয়া থাকি। যে ব্যক্তি শক্তির অনুসরণ করিয়াও উদ্দিষ্ট বস্তুকে প্রাপ্ত হয় না এবং যে ব্যক্তি কোন বস্তুকে এড়াইতে গিয়া সেই বস্তুর মধ্যেই আবার গিয়া পড়ে, এই দুই ব্যক্তিই হতভাগ্য।
যে সকল বস্তু তোমার আয়ত্তাধীন ও প্রাকৃতিক নিয়মের বিরোধী তাহা যদি তুমি এড়াইতে চেষ্টা কর, তাহা হইলে তুমি সফল হইতে পারিবে। কিন্তু যাহা তোমার আয়ত্তাধীন নহে এবং যাহা প্রকৃতিরই অপরিহার্য্য ধর্ম্ম—সেই দুঃখ কষ্ট ও মৃত্যুকে তুমি কিছুতেই এড়াইতে পারিবে না। অতএব সে চেষ্টা হইতে বিরত থাকিবে।
২। কোন বস্তুই হঠাৎ উৎপন্ন হয় না। এমন কি, একগুচ্ছ আঙুর ও ডুমুরফলও হঠাৎ উৎপন্ন হয় না। যদি তুমি আমাকে বল, “আমি এখনি একটি ডুমুর খাইতে চাই,” তাহার উত্তরে আমি এই কথা বলিব:—“আগে ডুমুরের ফুল হোক্, তার পর তার ফল হোক্—তার পর সেই ফল পাকুক্ ইত্যাদি”। যখন দেখা যাইতেছে, সামান্য একটা ডুমুরের ফলও একেবারেই কিম্বা এক ঘণ্টার মধ্যেই পূর্ণতা প্রাপ্ত হয় না, তখন তুমি কি আশা করিতে পার, মানব-মনের ফল এত শীঘ্র ও এত সহজে হস্তগত হইবে? আমি যদি তোমাকে বলি, “হাঁ, হইবে”; তবুও তুমি তাহা প্রত্যাশা করিও না।
৩। মনুষ্য-জীবনের প্রকৃতিগত উদ্দেশ্য সিদ্ধ করাও বড় একটা সামান্য কথা নহে। কেন না, মানুষ কাহাকে বলে? তুমি বলিবে, যে জীব প্রাণবান্, যে মরণাধীন, যে বিবেক-বুদ্ধিসম্পন্ন সেই মানুষ। “আচ্ছা ভাল, বিবেক-বুদ্ধি আছে বলিয়া মানুষ কাহা হইতে ভিন্ন?”
—“বনের হিংস্র জন্তু হইতে”।
“আর কাহা হইতে ভিন্ন?”
—“গো-মোদি হইতে"।
তবে দেখিও, তুমি যেন হিংস্র জন্তুদিগের মত কোন কাজ করিয়ো না। কারণ, তুমি যদি সেরূপ কোন কাজ কর, তোমার মধ্যে যে মানুষটি আছে, সেই মানুষটি বিনষ্ট হইবে; তোমার মানবজীবনের উদ্দেশ্য সিদ্ধ হইবে না। যখন আমরা কলহ-বিবাদ করি, পরস্পরের হানি করি, ক্রোধে উন্মত্ত হই, উগ্রচণ্ড মুর্ত্তি ধারণ করি, তখন আমরা কতটা নীচে নামিয়া যাই?—তখন আমরা হিংস্র জন্তুদিগেরই সমান হইয়া পড়ি। যখন আমরা লুব্ধ, ইন্দ্রিয়-পরায়ণ, কাণ্ডাকাণ্ডজ্ঞান-শূন্য হইয়া বিভৎস জঘন্য কাজে প্রবৃত্ত হই, তখন আমরা কতটা নামিয়া যাই?—তখন আমরা গোমোষাদির ন্যায় হইয়া পড়ি। ইহাতে আমরা হারাই কি? হারাই আমাদের বিবেক-বুদ্ধি। মনুষ্যের যেটি আসল জিনিস্ তাহা হইতেই ভ্রষ্ট হই।
৪। বীণা যদি বীণার কাজ না করে, বংশী যদি বংশীর কাজ না করে, তাহা হইলে তাহাদের থাকা, না থাকা, দুই সমান। মানুষের সম্বন্ধেও তাহাই বলা যাইতে পারে। যাহার যে কাজ সেই কাজ যে যতটা করিয়া উঠিতে পারে, সে ততটা আপনাকে বাঁচাইয়া রাখে; যে যতটা তাহা হইতে বিচ্যুত হয়, সে ততটা আত্মবিনাশ সাধন করে।
৫। কোন বিষয়ে দৃঢ়বিশ্বাস সহজে উৎপন্ন হয় না। যদি কোন ব্যক্তি প্রতিদিন কোনও একই বিষয়-সম্বন্ধে কথা কহে, কথা শোনে, সেই সঙ্গে জীবনের কার্য্যেও তাহা প্রয়োগ করে, তবেই সেই বিশ্বাস তাহার মনে বদ্ধমূল হয়।
৬। কোনও মহৎ শক্তি লাভ করা প্রথম শিক্ষার্থীদিগের পক্ষে বিপদজনক। “কিন্তু আমাকে তো প্রকৃতির অনুসারে চলিতে হইবে”? রুগ্ন ব্যক্তির পক্ষে ওকথা খাটে না। যাহাতে তুমি পরে সুস্থ লোকের মত থাকিতে পার, এই উদ্দেশে আপাততঃ কিছুকালের জন্য তোমাকে রুগ্ন ব্যক্তির মত চলিতে হইবে। যাহাতে তুমি পরে বিবেক-বুদ্ধির উপদেশ অনুসারে ঠিক মত চলিতে পার, এই উদ্দেশে আপাততঃ উপবাসাদি ব্রত ও অন্যান্য কঠোর নিয়ম পালন করিতে হইবে। তোমার অভ্যন্তরে যদি কিছু ভালো থাকে, আর যদি তুমি বিবেক-বুদ্ধির কথা শুনিয়া চল,—তুমি যে কাজ করিবে তাহাই ভাল হইবে। “না, আমরা মুনি-ঋষির মত থাকিয়া লোকের ভাল করিব—লোকের দোষ সংশোধন করিব”।
“লোকের কি ভাল করিবে?”—তোমার নিজের কি কিছু ভাল করিয়াছ? অন্যের দোষ কি সংশোধন করিবে? তোমার নিজের দোষ কি সংশোধন করিয়াছ? তুমি যদি তাহাদের ভাল করিতে চাও, তাহাদের কাছে গিয়া মেলাই বকাবকি করিও না; পরন্তু তত্ত্বজ্ঞান শিক্ষার-ফলে, কিরূপ লোক তৈয়ারি হয়, তাহারই দৃষ্টান্ত তোমার নিজ জীবনে প্রদর্শন কর। যাহারা তোমার সহিত আহার করে, তাহারা যাহাতে তোমার আহার দেখিয়া ভাল হইতে পারে; যাহারা তোমার সহিত পান করে, তাহারা যাহাতে তোমার পান করা দেখিয়া ভাল হইতে পারে, তুমি তাহাই কর। আত্মত্যাগ স্বীকার কর, সকলকে পথ ছাড়িয়া দেও, সকলের কথা ও আচরণ সহ্য কর। এইরূপেই তাহাদের তুমি ভাল করিতে পারিবে; তাহাদের উপর তোমার পিত্ত বমন করিয়া—তাহাদের উপর ঝাল ঝাড়িয়া তাহাদের তুমি ভাল করিতে পারিবে না।