এপিক্টেটসের উপদেশ/আত্মোন্নতির তিনটি ধাপ
আত্মোন্নতির তিনটি ধাপ।
১। তত্ত্বজ্ঞান তিনভাগে বিভক্ত। যিনি জ্ঞানী ও সাধু হইতে ইচ্ছা করেন, এই তিন বিভাগেই তাঁর সাধনা ও অভ্যাস করা আবশ্যক।
বিষয়ের অনুসরণ ও বিষয়ের পরিবর্জ্জন এই প্রথম বিভাগের বিষয়। যাহা আমি চাই তাহা যেন পাই, যাহা চাহি না তাহার মধ্যে গিয়া না পড়ি,—ইহাই আমাদের চেষ্টা।
নিজ মনের বাসনা ও বিদ্বেষ—ইহাই দ্বিতীয় বিভাগের বিষয়। বাসনা বিদ্বেষের বশবর্ত্তী না হইয়া, যাহা মনুষ্যোচিত—সেই কার্য্যে সতর্কতা, সুশৃঙ্খল ও বিবেচনা সহকারে অগ্রসর হইতে হইবে। দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হইয়া কোন কার্য্য করিবে না। ইহাই চারিত্র্য।
তৃতীয় বিভাগটি এই:—যাহাতে বিভ্রম উপস্থিত না হয়, সে বিষয়ে তর্ক হইবে। সকল বিষয় তলাইয়া দেখিতে চেষ্টা করিবে। বাহ্য আকারে ভুলিবে না।—ইহাই বিবেকবুদ্ধি।
প্রথম কথা:— কোন প্রিয় বস্তু অর্জ্জন কিম্বা কোন অপ্রিয় বস্তু বর্জ্জন করিতে না পারিলে তাহা হইতেই আমাদের সুখদুঃখ উৎপন্ন হয়। বিষয়টি অতীব গুরুতর। ইহা ইহতেই আমাদের যত কিছু উদ্বেগ অশান্তি, দুঃখ দুর্দ্দশা, শোক-সন্তাপ, বিরহ বিলাপ। এই স্থলে, রিপুর বশবর্ত্তী হইয়া আমরা বিবেকের বাণী শুনিতে পাই না।
দ্বিতীয় কথা:—যাহা কিছু মনুষ্যোচিত, তাহাই আমাদের করিতে হইবে। তাই বলিয়া, পাষাণ-মুর্ত্তির ন্যায় হৃদয়শূন্য হইয়া থাকিতে হইবে না—ঈশ্বরাধীন জীবের যাহা কর্ত্তব্য, পুত্রের যাহা কর্ত্তব্য, পিতার যাহা কর্ত্তব্য, নাগরিকের যাহা কর্ত্তব্য, এ সমস্তই আমাদের পালন করিতে হইবে। স্বাভাবিক অথবা অর্জ্জিত যে কোন সম্বন্ধবন্ধনে আমরা পরস্পরের সহিত আবদ্ধ হইয়া আছি, সেই সকল সম্বন্ধগুলি আমাদিগকে সষত্রে রক্ষা করিতে হইবে।
তত্ত্বজ্ঞানে কিয়দ্দূর অগ্রসর হইলে তবেই আমরা তৃতীয় বিভাগের অধিকারের মধ্যে আসিয়া পড়ি। অন্য দুই বিভাগের কাজ কিরূপে সুরক্ষিত হইতে পারে, কিরূপে অবাধে সম্পাদিত হইতে পারে, তাহারই উপদেশ এই তৃতীয় বিভাগের বিষয়। তাহার স্থূল মর্ম্ম টি এই:— কোন বস্তু আমরা বিনা পরীক্ষায় গ্রহণ করিব না। বিনা-পরীক্ষায় কোন বাসনার প্ররোচনাকেও মনে স্থান দিব না। কেহ বলিতে পারেন, ইহা আমাদের সাধ্যাতীত।
দেখিতে পাই, আজকালের তত্ত্বজ্ঞানীরা উপরোক্ত দুই বিভাগকে ছাড়িয়া এই তৃতীয় বিভাগটি লইয়াই ব্যাপৃত। ইহা লইয়াই তাহাদের যতকিছু তর্কবিতর্ক, বাদবিতণ্ডা, সিদ্ধান্তস্থাপন, ও হেত্বাভাস-প্রদর্শন হইয়া থাকে। তাঁহারা বলেন, সিদ্ধান্ত-নির্ণয়ের সময়, সতর্কতার সহিত আপনাকে বিভ্রম হইতে রক্ষা করিবে। কিন্তু যে ব্যক্তি জ্ঞানী ও সাধু সেই আপনাকে বিভ্রম হইতে রক্ষা করিবে—না, আর কেহ?
২। তবে কি, বিভ্রম হইতে আপনাকে রক্ষা করা—শুধু এই কাজটুকুই তোমাদের এখন করিতে বাকি? আর সমস্ত কাজই তোমাদের হইয়া গিয়াছে? তোমরা কি অর্থে আর প্রলুব্ধ হও না? কোন সুন্দরী রমণীকে দেখিয় তোমরা কি বিচলিত হও না? তোমার কোন প্রতিবেশী উত্তরাধিকার-সূত্রে কোন সম্পত্তিলাভ করিলে তোমার কি ঈর্ষা হয় না? সংক্ষেপে আর কিছু তোমাদের করিতে বাকি নাই, এখন কেবল, যাহা সাধনায় পাইয়াছ, তাহাই সুদৃঢ় করাই কি তোমাদের একমাত্র প্রয়োজন?
হতভাগ্য! এই কথাগুলি শুনিতে শুনিতেই যে তুমি ভীত ও উদ্বিগ্ন হইতেছ, পাছে কেহ তোমাকে অবজ্ঞা করে—তুমি জানিতে উৎসুক হইয়াছ, তোমার সম্বন্ধে কে কি-কথা বলিতেছে। আজকালের সর্ব্বশ্রেষ্ঠ তত্ত্বজ্ঞানী কে?—এই কথা আলোচনার সময়, সেই সভায় উপস্থিত কোন ব্যক্তি যদি তোমার নাম করিয়া বলে “অমুক ব্যক্তি সর্ব্বশ্রেষ্ঠ তত্ত্বজ্ঞানী”—অমনি তোমার মনের লেজটা দশহাত ফুলিয়া উঠিবে। কিন্তু উপস্থিত আর এক ব্যক্তি যদি বলে—“সে-সব কিছুই নয় —তার কথা শুনিবারই যোগ্য নহে, সে কি-জানে? সে তত্ত্বজ্ঞানের শুধু আরম্ভ করিয়াছে মাত্র—তার অধিক কিছুই নয়।”—অমনি তুমি বিস্ময়ে স্তম্ভিত হইবে, তোমার মুখ বিবর্ণ হইয়া যাইবে, আর তুমি বলিয়া উঠিবে “আমি তাকে একবার দেখাতে চাই, আমি কিরূপ ব্যক্তি। আমি যে একজন মহা তত্ত্বজ্ঞানী, তা আমি তাহার নিকট সপ্রমাণ করিয়া দিব।”
যথেষ্ট হইয়াছে, আর প্রমাণের আবশ্যক নাই; তুমি কিরূপ তত্ত্ব জ্ঞানী তোমার এই কথাতেই বিলক্ষণ জানা যাইতেছে।