এপিক্টেটসের উপদেশ/জীবনের খেলা
জীবনের খেলা।
১। যাহা উচিত, ও যাহা কার্য্যোপযোগী—এই উভয়ের শক্তিসন্মিলন ও ঐক্যবন্ধনই প্রকৃতির প্রধান কাজ।
২। বাহ্য বস্তু আমাদের উপেক্ষার বিষয়, কিন্তু বাহ্য বস্তুর ব্যবহার ও প্রয়োগ উপেক্ষার বিষয় নহে। কি করিয়া তবে, মনের অবিচলতা ও শান্তি এবং বাহ্য বিষয়ের সম্বন্ধে যত্নশীলতা—এই দুই এক সঙ্গে রক্ষা করা যাইতে পারে? কি করিয়া অনবধানতা ও অপরিপাট্য বর্জ্জন করা যাইতে পারে? অক্ষক্রীড়কদিগের দৃষ্টান্ত এইস্থলে গ্রহণ করা যাউক। পাশার “দান”গুলিও অপ্রধান, পাশার গুটিকাগুলিও অপ্রধান। আমার পাশায় কি দান পড়িবে তাহা আমি কি করিয়া বলিব? কিন্তু যে দান পড়িবে তাহার উপযুক্ত প্রয়োগ করা—ইহাই আসল খেলা। বিচার পূর্ব্বক বাহ্য বিষযসকল নির্ব্বাচন ও বিভাগ করিয়া এইরূপ বলা “বাহ্য বস্তু সকল আমার আয়ত্তাধীন নহে, ইচ্ছাশক্তিকে প্রয়োগ করাই আমার আয়ত্তাধীন”—ইহাই জীবনের প্রধান কাজ। আমি ভালকে কোথায় অন্বেষণ করিব, আর মন্দকেই বা কোথায় অন্বেষণ করিব?— আমার অন্তরে;—আমার যাহা নিজস্ব তাহাতেই। কিন্তু যাহা কিছু তােমার নিজস্ব নহে, তাহাকে ভালও বলিবে না, মন্দ ও বলিবে না, ইষ্টজনকও বলিবে না, অনিষ্টজনকও বলিবে না, তৎসম্বন্ধে ওরূপ কোন শব্দই প্রয়ােগ করিবে না।
৩। তবে কি এই সকল বিষয়ে অযত্নশীল ও অসাবধান হইব? কোন প্রকারেই নহে। উহাও একপ্রকার ইচ্ছাশক্তিগত পাপ, সুতরাং প্রকৃতির বিরুদ্ধ। সাবধান ও যত্নশীল হইবে, কেন না, বাহ্য বস্তুর প্রয়ােগ উপেক্ষার বিষয় নহে; কিন্তু সেই সঙ্গে অবিচলিত ও শান্ত থাকিবে, কেন না, বাহ্য বস্তু স্বয়ং উপেক্ষার বিষয়। আমার সহিত যাহার প্রকৃত সম্পর্ক, সে বিষয়ে আমাকে কেহ বাধা দিতে কিম্বা বাধ্য করিতে পারিবে না। কিন্তু যে সকল বস্তুর দ্বারা আমি বাধিত ও বাধ্য হইয়া থাকি, যাহার সম্প্রাপ্তি আমার সাধ্যায়ত্ত নহে, তাহা ভালও নহে, মন্দও নহে। কিন্তু সেই সকল বস্তুর প্রয়ােগেই ভাল মন্দ নির্ভর করে, এবং তাহাই আমার আয়ত্তাধীন। বিষয়ানুরাগীর যত্নশীলতা ও বিষয়-বিরাগীর অবিচলতা—এই দুয়ের সন্মিশ্রণ ও সমন্বয় সাধন বড়ই কঠিন সন্দেহ নাই; কিন্তু তাই বলিয়া অসাধ্য কিম্বা অসম্ভব নহে; যদি ইহা অসম্ভব হয়, তাহা হইলে মানুষের পক্ষে সুখী হওয়াও অসম্ভব।
৪। আমাকে এমন একটি লােক দেখাও, কোন-একটা কাজ কিরূপ ভাবে করিতে হইবে শুধু তাহারই প্রতি যাহার দৃষ্টি; যে ব্যক্তি কোন বস্তু প্রাপ্তির জন্য লালায়িত নহে, পরন্তু স্বীয় ইচ্ছাশক্তি প্রয়ােগ করিবার জন্যই উৎসুক।
৫। তাই ক্রিসিপস্ এই কথাগুলি বেশ বলিয়াছিলেন—“যতদিন ভবিষ্যৎ আমার কাছে প্রচ্ছন্ন থাকে, ততদিন প্রকৃতির অনুযায়ীবস্তুগুলি প্রাপ্তির পক্ষে যে অবস্থা সর্ব্বাপেক্ষা অনুকূল, তাহাই আমি অবলম্বন করিয়া থাকি; কারণ, ঈশ্বর আমাকে এইরূপ নির্ব্বাচনের অধিকার দিয়াছেন। কিন্তু আমি যদি জানি, ঈশ্বর আমাকে পীড়িত হইবার জন্য আদেশ করিয়াছেন, তাহা হইলে আমি আপনা-হইতে সেই দিকেই অগ্রসর হইব। এমন কি, আমার পাদদ্বয়ের যদি বুদ্ধিবৃত্তি থাকিত, তাহা হইলে সেও আপনা হইতে অগ্রসর হইয়া কর্দ্দমে লিপ্ত হইত।”
৬। ধানের শিষ্গুলি যে বাহির হয় তাহা কিসের জন্য?—শুষ্ক হইবার জন্যই কি নহে? আর কৃষকেরা উহাকে কাটিবে, শুধু এইজন্যই কি উহা শুষ্ক হয় না? কেন না, নিজের জন্য জীবন ধারণ করিতে উহার পৃথিবীতে আসে নাই। অতএব উহাদের যদি জ্ঞান থাকিত, কৃষকেরা যাহাতে উহাদিগকে না কাটে—এইরূপ প্রার্থনা করা কি উহাদের পক্ষে উচিত হইত? কেন না, ধান-কাটা না হওয়া ধানের পক্ষে বিষম অভিশাপ; সেই প্রকার জানিবে, অকর্ত্তিত পাকা ধানের ন্যায়, মানুষের মরাও মানুষের পক্ষে অভিশাপ। কেন না, আমরাও একপ্রকার কর্ত্তনীয় বস্তু। তবে, আমরা জানি যে আমরা কর্ত্তিত হইব, তাই আমরা এ-সম্বন্ধে এত আক্রোশ প্রকাশ করিয়া থাকি। অশ্বের ভালমন্দ কিসে হয়, অশ্বপালক যেরূপ বুঝে, আমরা সেইরূপ আপনাকে বুঝি না—সমস্ত মানবজাতির ভাল-মন্দ কিসে হয় আমরা তাহা বুঝি না। কিন্তু ক্রিসান্টস্ যখন শত্রুকে শস্ত্রাঘাত করিতে প্রবৃত্ত সেই সময়ে সেনাপতি তুরীধ্বনি করিয়া তাহাকে ফিরিতে আদেশ করিলেন—সেই তুরীধ্বনি শুনিয়া ক্রিসান্টস্ শত্রুকে আঘাত করিতে ক্ষান্ত হইল;— আপনার ইচ্ছানুরূপ কাজ করা অপেক্ষা সেনাপতির আদেশ পালন করা এতই তাহার ভাল বলিয়া মনে হইয়াছিল। কিন্তু আমাদের মধ্যে অবশ্যম্ভাবিতার আজ্ঞাও কেহ সুবাধ্য হইয়া পালন করিতে চাহে না। আমরা কঁদিতে কাদিতে, আর্ত্তনাদ করিতে করিতে, দুঃখ কষ্ট সহ্য করিয়া থাকি, আর সেই সকল কষ্টকে আমাদের নিয়তি বলিয়া নির্দ্দেশ করি। নিয়তি কিসের বাপু? যদি ভবিতব্যকে নিয়তি বল, তাহা হইলে সকল বিষয়েই তো আমরা নিয়তির অধীন। কিন্তু শুধু যদি মৃত্যুকেই নিয়তি বলিতে হয়, তাহা হইলে, যাহার জন্ম তাহারই মৃত্যু— ইহাতে আবার দুঃখ কিসের? আমরা অসির আঘাতে মরি, চক্রের পেষণে মরি, জলমগ্ন হইয়া মরি, গৃহছাদ-স্থলিত “টালির” আঘাতে মরি, অত্যাচারী রাজার হস্তে মরি। যমালয়ে যে পথ দিয়াই যাই নাকেন, তাহাতে আইসে যায় কি? সব পথই সমান। কিন্তু সত্য কথা যদি শুনিতে চাও, তাহা হইলে বলি, অত্যাচারী রাজা তোমাকে যে পথ-দিয়া যমালয়ে প্রেরণ করেন, তাহাই সর্ব্বাপেক্ষা সিধা পথ। কোন অত্যাচারী রাজা এপর্য্যন্ত কাহাকেও “ছয়মাস ফাঁসি” দেন নাই; কিন্তু জ্বররোগ মানুষকে এক মাস ধরিয়া বধ করিয়া থাকে। ফলতঃ এ সমস্ত ব্যাপার তুমুল শব্দমাত্র—ফাঁকা নামের ঝনৎকার মাত্র।
৭। কিন্তু সমুদ্র-যাত্রার সময় আমরা যেরূপ করিয়া থাকি, এসো আমরা এক্ষণে সেইরূপ করি। সেই সময়ে, আমার পক্ষে কি করা সম্ভব?—এইটুকুই আমার পক্ষে সম্ভব—অর্থাৎ জাহাজের সারেং, জাহাজের খালাসি, যাত্রার সুযোগ ইত্যাদি নির্ব্বাচন করা। তারপর, মনে কর, একটা ঝড় উঠিল, আমার তাহাতে কি আইসে-যায়? আমার যাহা করিবার ছিল, আমি তো তাহার কিছুই বাকী রাখি নাই। এখন সমস্যা-চিন্তার ভার আর এক জনের—অর্থাৎ সারেঙের। কিন্তু, জাহাজটা যে ডুবিতেছে! আমি তার কি করিব?—এ সময়ে আমার আর কি করিবার আছে? আমার যাহা সাধ্য আমি তাহাই করিতে পারি—ঈশ্বরকে তিরস্কার না করিয়া, চ্যাঁচামেচি না করিয়া নির্ভয়চিত্তে জলমগ্ন হইতে পারি। আমি এই মাত্র জানি, যাহার জন্ম তাহার মরণও নিশ্চিত। আমি অমর নহি, আমি জগতের একটি অংশ মাত্র, দিনের অংশ যেরূপ মুহূর্ত্ত। মুহূর্ত্তের ন্যায় আসিয়াছি, মুহূর্ত্তের ন্যায় চলিয়া যাইব। অতএব, কি প্রকারে চলিয়া যাইব,— জলে ডুবিয়া কিংবা জ্বরে ভুগিয়া তাহাতে কি আসে যায়; কেননা, আমাকে চলিয়া যাইতেই হইবে, তা যে রকম করিয়াই হউক। তুমি দেখিবে, নিপুণ-ক্রীড়কের এইরূপই করিয়া থাকে। গোলা তাহাদের নিকট প্রধান জিনিষ নহে; কিরূপে গোল ছুঁড়িতে হইবে, ধরিতে হইবে, তাহার উপরেই খেলার ভালমন্দ নির্ভর করে। এই গোলাখেলায় নিয়মের বাঁধাবাঁধি আছে, চটুলতা, আছে, বুদ্ধি-বিবেচনার প্রয়োজন আছে। ক্রোড় পাতিয়া রাখিলেও আমি হয়তো গোলাটাকে ধরিতে পারিব না, কিন্তু আর একজন, আমার নিক্ষিপ্ত গোলা অক্লেশেই ধরিয়া ফেলিবে। কিন্তু আমি যদি গোলাটাকে ছুঁড়িবার সময়, আকুলব্যাকুল হইয়া পড়ি, তাহা হইলে আমার খেলাটা কিরূপ হইবে? কি করিয়া আমি স্থির থাকিব?—খেলার ক্রম-টি কি করিয়া রক্ষা করিব?
৮। কি করিয়া গোলা খেলিতে হয়, সক্রেটিস্ তাহা ভাল জানিতেন। সে কিরূপ?—না যখন তিনি বিচারালয়ে দাঁড়াইয়া উপহাস করিয়াছিলেন। তিনি বলিয়াছিলেন; “দেখ থ্যানিটস্, তুমি এমন কথা কি করিয়া বলিলে যে আমি ঈশ্বরে বিশ্বাস করি না, “ডিমন”-দিগকে তুমি কিরূপ ঠাওরাও? তাঁহারা কি ঈশ্বরের পুত্র কিম্বা দেবতা ও মনুষ্যের মাঝামাঝি এক-প্রকার মিশ্র প্রকৃতির জীব নহেন?” এই কথা স্বীকৃত হইলে, তিনি আবার বলিলেন “অশ্বতর আছে অথচ গর্দ্দভ নাই, এরূপ অভিমত তোমার বিবেচনায়, কাহারও হইতে পারে কি?” এইরূপেই সক্রেটিস্ গোলা খেলিয়াছিলেন। কি প্রকারের গোলা তিনি তাহাদের মধ্যে নিঃক্ষেপ করিয়াছিলেন?— জীবন, শৃঙ্খল, নির্ব্বাসন, বিষ, স্ত্রীবিচ্ছেদ, পরিত্যক্ত অনাথ শিশুসন্তান। এই সকল গোলা লইয়া তাহারা খেলিয়াছিল; কিন্তু তিনিও বড় কম খেলা খেলেন নাই;—অতি শোভন ভাবে, ওজন বুঝিয়া খেলিয়াছিলেন। আমাদেরও সেইরূপ করা উচিত। নিপুণ ক্রীড়কেরা গোলা ছুঁড়িবার ও ধরিবার সময় যেরূপ সাবধান ও যত্নশীল হয় আমাদেরও সেইরূপ সাবধান ও যত্নশীল হইতে হইবে, অথচ স্বয়ং গোলাসম্বন্ধে উদাসীন থাকিতে হইবে।