এপিক্টেটসের উপদেশ/স্বাভাবিক সংস্কার ও বিবেকবুদ্ধি
স্বাভাবিক সংস্কার ও বিবেক বুদ্ধি।
স্বাভাবিক সংস্কারগুলি মনুষ্যমাত্রেরই সাধারণ সম্পত্তি এবং উহা সর্ব্ববাদি-সম্মত; উহা লইয়া পরস্পরের মধ্যে বিরোধ উপস্থিত হয় না। কেন না, আমাদের মধ্যে কে না স্বীকার করে, যাহা শ্রেয় তাহাই উপাদেয় এবং শ্রেয়কেই বরণ করা—অনুসরণ করাই আমাদের কর্ত্তব্য। তবে, কোন্ স্থলে পরস্পরবিরোধিতা উপস্থিত হয়?—সেই সময়েই উপস্থিত হয় যখন আমরা ঐ স্বাভাবিক সংস্কারগুলিকে বিশেষ বিশেষ বিষয়ে প্রয়োগ করিতে যাই।
আচ্ছা, শিক্ষা তবে কাহাকে বলে? প্রকৃতির অনুসরণ করিয়া, এই স্বাভাবিক সংস্কারগুলিকে, বিশেষ বিশেষ বিষয়ে প্রয়োগ করিতে শিক্ষা করাই প্রকৃত শিক্ষা;—তা-ছাড়া, এইটি নির্ণয় করা যে, কোন্ কোন্ বস্তু আমাদের আয়ত্তাধীন এবং কোন্ কোন্ বস্তু আমাদের আয়ত্তাধীন নহে। আমাদের ইচ্ছা এবং আমাদের ইচ্ছাকৃত কার্য্যই আমাদের আয়ত্তাধীন। বাহ্য বস্তু ও আমাদের বাহ্য অবস্থা সম্পূর্ণরূপে আমাদের আয়ত্তাধীন নহে। তাহার উপর আমাদের মঙ্গলামঙ্গল নির্ভর করে না। আমাদের যাহা আয়ত্তাধীন—আমাদের সেই ইচ্ছার উপরেই আমাদের মঙ্গলামঙ্গল নির্ভর করে। ইচ্ছাশক্তি প্রয়োগ করিয়াই আমরা শ্রেয়ের পথে অগ্রসর হই; প্রবৃত্তি আমাদিগকে স্বার্থসাধনের দিকে—অস্থায়ী হীন সুখের দিকে—প্রেয়ের দিকেই লইয়া যায়। স্বার্থসাধন কিম্বা প্রেয়ই যদি আমাদের জীবন-পথের নিয়ন্তা হয়, তাহা হইলে শেষে আমরা কোথায় গিয়া দাঁড়াইব? জমি রাখা যদি আমার স্বার্থ হয়, তাহা হইলে সেই জমিটুকু আমার প্রতিবাসীর নিকট হইতে হরণ করিয়া লওয়া ও আমার স্বার্থ হইবে। যদি একখণ্ড বস্ত্রে আমার সার্থসাধন হয়, উহা চুরি করিয়া আনাও আমার আমার স্বার্থের অনুযায়ী হইবে। এইজন্যই পৃথিবীতে এত যুদ্ধ বিগ্রহ, বিদ্রোহ বিপ্লব, প্রজাপীড়ন ও ষড়যন্ত্র। পার্থিব সুখ দুঃখের উপরেই যদি আমার শুভাশুভ নির্ভর করে, তাহা হইলে ঈশ্বরের প্রতি আমার মনকে প্রকৃত পথে রাখিব কি করিয়া? কারণ, আমি যদি ক্ষতিগ্রস্ত হই, দুঃখ দুর্দ্দশা ভোগ করি, তা হলেই আমি বলিব, ঈশ্বর আমাকে অবহেলা করিতেছেন। বাহ্য় বিষয়ের উপরেই যদি শ্রেয়ের প্রকৃতি ও শ্রেয়ের শ্রেয়ত্ব নির্ভর করে, তাহা হইলে ঈশ্বরের প্রতি তো আমাদের মনের ভাব এইরূপই হইবে। অতএব, ঐহিক সুখ-দুঃখের উপর আমাদের শুভাশুভ নির্ভর করে না, আমাদের যাহা আয়ত্তাধীন সেই ইচ্ছার প্রয়োগের উপরেই আমাদের প্রকৃত শুভাশুভ নির্ভর করে।
আমাদের যতগুলি মনোবৃত্তি আছে, তন্মধ্যে একটি মনোবৃত্তি আপনাকে আপনি আলোচনা করিয়া থাকে;—আপনাকে আপনি ভাল বলে, কিম্বা মন্দ বলে। এইরূপ আত্মদৃষ্টি কি ব্যাকরণের আছে?— না, ব্যাকরণ শুধু শব্দ সম্বন্ধেই বিচার করিতে পারে। আর সঙ্গীত?— সঙ্গীত শুধু স্বর-সম্বন্ধেই বিচার করিতে পারে। ঐ উভয়ের মধ্যে কোনটিই কি আপনাকে আপনি আলোচনা করিতে পারে?—না, কোনটিই তাহা পারে না। তোমার বন্ধুকে যখন পত্র লেখা প্রয়োজন হয়, তখন ব্যাকরণ বলিয়া দেয়, কি করিয়া তাঁহাকে পত্র লিখিতে হইবে। সঙ্গীত সম্বন্ধেও তাহাই। এখন তোমার পত্র লেখা উচিত, কি উচিত নহে; গাওয়া উচিত কি বাজানো উচিত, এ সমস্ত কথা ব্যাকরণ কিম্বা সঙ্গীত বলিয়া দিতে পারিবে না। তবে, কে বলিয়া দিবে? তোমার সেই মনোবৃত্তিই বলিয়া দিবে যে আপনাকে আপনি আলোচনা করে এবং অন্য সকল বিষয়েরও আলোচনা করিয়া থাকে। সেটি বিবেক-বুদ্ধি। বিবেক-বুদ্ধি ছাড়া আর কোনও বৃত্তিই আপনাকে আপনি আলোচনা করিতে পারে না। অর্থাৎ সে নিজে কি পদার্থ, সে নিজে কি করিতে সমর্থ, তাহার মূল্য কি—এই সব বিষয়ে অন্য বৃত্তি আলোচনা করিতে পারে না। এবং এই বৃত্তি যেমন আপনাকে আপনি আলোচনা করে, সেইরূপ অন্য বস্তুসম্বন্ধেও আলােচনা করিয়া থাকে। কোন একটি সােণার জিনিস যে সুন্দর, সে আর কে বলিতে পারে? সােণার জিনিস্টি নিজে তো তাহা বলিয়া দেয় না। অতএব স্পষ্টই দেখা যাইতেছে, ঐ বৃত্তি বহির্বিষয়েও প্রযুক্ত হয়। ব্যাকরণসম্বন্ধে, সঙ্গীতসম্বন্ধে, অন্যান্য মনােবৃত্তি সম্বন্ধে তবে কে বিচার করিয়া থাকে? কে তাহাদের প্রয়ােগ-স্থল সকল সপ্রমাণ করিয়া দেয়? কোন্টি কোন্ সময়ের উপযােগী কে তাহা বলিয়া দেয়?—সে বিবেক-বুদ্ধি ছাড়া আর কেহ নহে।
ঈশ্বর এই বিবেক-শক্তিকেই আমাদের আয়ত্তাধীন করিয়া দিয়াছেন, ইহার দ্বারাই আমরা বাহ্য় বিষয়ের যথাযথ ব্যবহার করিয়া থাকি। কিন্তু অন্য বিষয় সকল আমাদিগের আয়ত্তাধীন নহে। বাহ্য বস্তু সকল আমাদের রক্তমাংসের সহিত জড়িত হইয়া আছে, উহারা আমাদিগকে বাধা দিবে না তাে কি? এ শরীর তো এক প্রকার পেলব মৃৎপিণ্ড বিশেষ। তাই দেবতারা বলেন, শরীরকে তােমার আয়ত্তাধীন করিয়া দিতে পারি নাই বটে, কিন্তু আমাদের নিজের অংশ তােমাকে দিয়াছি।
সেটি কি?—নির্ব্বাচন করা, গ্রহণ কিংবা না গ্রহণ করা, অনুসরণ কিংবা পরিহার করা—অর্থাৎ সংক্ষেপে বলিতে গেলে-বাহ্য় বিষয়ের যথাযথ ব্যবহার করিবার শক্তি তােমাকে আমি দিয়াছি। এই শক্তিকে যত্নপূর্ব্বক রক্ষা কর, এই শক্তিকেই তােমার নিজস্ব করিয়া ব্যবহার কর; তাহা হইলে আর বাধা পাইবে না, ভারগ্রস্ত হইবে না, অনুশােচনা করিতে হইবে না, কাহারো নিন্দা বা স্তুতি করিতে হইবে না। এ দানটি কি সামান্য দান? ইহাতে কি তুমি সন্তুষ্ট নও? ঈশ্বরের নিকট প্রার্থনা করি, যেন আমরা ইহাতেই সন্তুষ্ট থাকিতে পারি। যে একটি বিষয় আমাদের আয়ত্তাধীন তাহাই যত্নপূর্ব্বক রক্ষা করা—তাহাতেই আসক্ত হওয়াই আমাদের কর্ত্তব্য। কিন্তু তাহা না করিয়া আমরা নানা বিষয়ে আপনাকে আবদ্ধ করি। দারা সুত ধন জনে আমরা আসক্ত হইয়া পড়ি। এবং এইরূপে ভারগ্রস্ত হইয়া আমরা রসাতলের দিকে আকৃষ্ট হই। যদি পাড়ি দিবার মতো বাতাস না থাকে, আমরা নিরাশ হইয়া ক্রমাগত বাতাসের জন্য সতৃষ্ণভাবে প্রতীক্ষা করি। এখন উত্তরে বাতাস বহিতেছে; তাহাতে আমাদের কি আসে-যায়? পশ্চিমে বাতাস কখন্ বহিবে?—পবন-দেবের যখন কৃপা হইবে। বাতাসের কর্ত্তা তো তুমি নও—সে পবন-দেব। তবে এখন আমরা কি করিব? যাহা আমাদের নিজস্ব বস্তু তাহারই কিসে উন্নতি হয়,—সদ্ব্যবহার হয় তাহারই চেষ্টা করা আমাদের কর্ত্তব্য। এবং ঈশ্বর যাহার যেরূপ প্রকৃতি দিয়াছেন তদনুসারেই অন্য বস্তু সকলের ব্যবহার করাই তাহার পক্ষে যুক্তিসঙ্গত।
শরীর যেরূপ বৈদ্যের প্রয়োগ স্থল, ভূমি যেরূপ কৃষকের প্রয়োগস্থল, এই বিবেক-বুদ্ধি সেইরূপ তত্ত্বজ্ঞানী সাধুজনের প্রয়োগস্থল অর্থাৎ সাধনক্ষেত্র। এবং প্রত্যেক পদার্থকে স্বকীয় প্রকৃতির অনুসারে ব্যবহার করাই তাঁহাদের কাজ। যাহা ভাল তাহা গ্রহণ করা, যাহা মন্দ তাহা পরিত্যাগ করা, এবং যাহা অনিশ্চিত তদ্বিষয়ে উদাসীন থাকা,—ইহাই আত্মা মাত্রেরই প্রকৃতি; বিক্রেতার হস্তে উচিত মূল্যস্বরূপ দেশের প্রচলিত মুদ্রা অর্পণ করিলেই সে যেরূপ ক্রেতাকে তাহার বিনিময়ে অভিলষিত পণ্য দ্রব্য প্রদান করিতে বাধ্য, সেইরূপ আত্মার নিকটে শ্রেয় উপস্থিত হইলেই, আত্মা তাহাকে না গ্রহণ করিয়া থাকিতে পারে না। আমাদের ইচ্ছাকে কিরূপ প্রয়োগ করি, কোন্ দিকে লইয়া যাই তাহার উপরেই আমাদের মঙ্গল অমঙ্গল নির্ভর করে। তবে আমরা অন্য বিষয়ের জন্য কেন এত উদ্বিগ্ন হই? যাহা তোমার আয়ত্তাধীন—যাহা তোমার নিজস্ব ধন তাহাকেই আঁকড়াইয়া ধরিয়া থাক, যাহা তােমার আয়ত্তাধীন নহে,—যাহা তােমার নিজস্ব নহে তাহাতে লােভ করিও না— তাহাতে আসক্ত হইও না। ভক্তি সে তােমার—শ্রদ্ধা সে তােমার— তাহা হইতে কে তােমাকে বঞ্চিত করিতে পারে—যদি তুমি নিজে ইচ্ছা করিয়া আপনি তাহা হইতে বঞ্চিত না হও? যাহা তােমার নিজস্ব নহে তাহাতে আসক্ত হইলে, তুমি কেবল তাহাতে বাধা পাইবে, ভারগ্রস্ত হইবে, উদ্বিগ্ন হইবে, পরিতাপ করিবে, ঈশ্বর ও মনুষ্যের প্রতি দোষারােপ করিবে। কিন্তু তাহাতে তুমি যদি আসক্ত না হও, তাহা হইলে তােমাকে কেহই বাধা দিতে পারিবে না, তােমার উপর কেহ বল প্রকাশ করিতে পারিবে না, কেহ তােমার হানি করিতে পারিবে না, কেহ তােমার শত্রু থাকিবে না, কাহা হইতেও তুমি ক্ষতিগ্রস্ত হইবে না। কিন্তু ইহা সাধনার বিষয়—ইহাতে সিদ্ধিলাভ করিতে হইলে কতকগুলি পদার্থ তােমাকে একেবারে পরিত্যাগ করিতে হইবে। উচ্চতর উদ্দেশ্য সাধনের জন্য, কতকগুলি নীচ উদ্দেশ্য বিসর্জ্জন করিতে হইবে। যদি মুক্তি চাও, মঙ্গল চাও, তাহা হইলে নীচ সুখ ও নীচ স্বার্থকে বিসর্জ্জন করিতে হইবে। যদি কোন বস্তু কঠোর বলিয়া তােমার নিকট প্রতীয়মান হয়—তখনই সেই বস্তুকে উদ্দেশ করিয়া এইরূপ বলিতে অভ্যাস। করিবে: “তােমাকে যাহা মনে হইতেছে, আসলে তুমি তাহা নও।” তাহার পর, তাহাকে পরীক্ষা করিয়া দেখিবে; বিশেষতঃ দেখিবে, উহা তােমার আয়ত্তাধীন কিম্বা আয়ত্তাধীন নহে। যদি উহা তােমার আয়ত্তাধীন না হয়, তাহা হইলে এইরূপ মনে করিবে: “উহা যখন আমার নিজস্ব নহে—উহাতে আমার কিছুই আইসে-যায় না।”