এপিক্টেটসের উপদেশ/তত্ত্বজ্ঞানের আরম্ভ
এপিক্টটসের উপদেশ
তত্ত্বজ্ঞানের আরম্ভ।
১। ভাল হইতে চাও তো আগে আপনাকে মন্দ বলিয়া বিশ্বাস কর।
২। যাহারা প্রকৃত উপায়ে, তত্ত্বজ্ঞানে যথারীতি প্রবেশ করিতে চাহে, অন্ততঃ তাহাদের জানা উচিত যে, নিজের দুর্ব্বলতা ও প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি অর্জ্জনে নিজের অক্ষমতা হৃদয়ঙ্গম করাই তত্ত্বজ্ঞানের আরম্ভ।
৩। পৃথিবীতে যখন আমরা ভূমিষ্ঠ হই, তখন জ্যামিতির সম কৌণিক ত্রিভুজ, সঙ্গীতের কোমল অতিকোমল স্বর—এ সকল বিষয় সম্বন্ধে আমাদের কোন সহজ স্বাভাবিক ধারণা থাকে না, পরন্তু বিদ্যার ধারাবাহিক শিক্ষার ফলেই আমরা পরে ঐ সব বিষয়ের জ্ঞান লাভ করি। আর দেখ, যাহারা ঐ সকল বিষয় কিছুই জানে না, তাহারা জানে বলিয়া মনেও করে না। কিন্তু ভাল-মন্দ, সুখ-দুঃখ, কর্ত্তব্যাকর্ত্তব্য—এমন কে আছে যে এই সকল বিষয়ের স্বাভাবিক সংস্কার লইয়া জন্মগ্রহণ না করে? এইরূপে, আমরা সকলেই ঐ সকল শব্দ ব্যবহার করি, এবং প্রত্যেক বিষয়ের সহিত, ঐ স্বাভাবিক সংস্কারণুলি যাহাতে থাপ খায়, তাহার জন্য চেষ্টা করিয়া থাকি। “অমুক লোক ভাল কাজ করিয়াছে,” “ঠিক্ করিয়াছে,” “ঠিক্ করে নাই,” “অমুক লোক সৎ” “অমুক লোক অসৎ”—আমাদের মধ্যে কে আছে যে এই সকল কথা ব্যবহার না করে? এমন কে আছে যে এই সকল কথা ব্যবহার করিবার জন্য জ্যামিতি কিম্বা সঙ্গীতের ন্যায় শিক্ষার অপেক্ষা রাখে? তাহার কারণ এই যে, আমরা ঐ সকল বিষয়ে যেন পূর্ব্ব-হইতেই শিক্ষিত হইয়া জন্মগ্রহণ করি; এবং গোড়ায় ঐ সকল সংস্কার লাভ করিয়া, আমরা পরে উহাতে আমাদের কতকগুলি নিজের মতামত যোগ করিয়া দেই।
যদি কাহাকে বলা যায়, তোমার এই কাজটি করা ভাল হয় নাই সে হয় তো বলিবে “কেন, ভাল মন্দ কাহাকে বলে আমি কি তাহা জানি না?—এ সম্বন্ধে আমার কি ধারণা নাই?”
—“হাঁ, তোমার ধারণা আছে সত্য।”
—“আর, ঐ ধারণা আমি কি প্রত্যেক পৃথক্ পৃথক্ বিষয়ে প্রয়োগ করি না?”
—“হাঁ, তুমি প্রয়োগ করিয়া থাক।”
—“আমি কি তবে ঠিক্মতো প্রয়োগ করি না?”
এইখানেই আসল প্রশ্ন আসিয়া উপস্থিত হইতেছে। এবং এইখানেই নিজের কল্পিত মতামত প্রবেশ করিবার অবসর পায়। সর্ব্ববাদি-সম্মত তাহা হইতে যাত্রা আরম্ভ করিয়া, ভ্রান্ত প্রয়োগের দ্বারা আমরা বাদবিসম্বাদের বিষয়ে অবতরণ করি। “তোমরা মনে করিতেছ, তোমাদের স্বাভাবিক সংস্কারগুলি, প্রত্যেক পৃথক্ পৃথক্ বিষয়ে তোমরা ঠিকমতো প্রয়োগ করিয়া থাক; আচ্ছা, তোমাদের এইরূপ বিশ্বাসের যে সকল বিষয় হেতু কি?”
—“কারণ, আমার মনে হইতেছে, ইহা ঠিক্।”
—“কিন্তু আর একজনের যে অন্যরূপ মনে হইতে পারে, তাহার কি করিলে? সেও কি তাহার প্রয়োগটি ঠিক্ বলিয়া মনে করিতেছে না?”
—“হাঁ, সে ঠিক বলিয়াই মনে করিতেছে।”
—“আচ্ছা তবে, যে সব বিষয়ে তোমাদের মত পরস্পর-বিরোধী, সেই সব বিষয়ে তোমরা উভয়েই কি তোমাদের সংস্কার গুলি ঠিকমতো প্রয়োগ করিয়াছ?”
—“না, তাহা হইতে পারে না।”
—“তবে, তুমি এমন কিছু কি দেখাইতে পার যাহা তোমার মনে হওয়া অপেক্ষা আরও কিছু বেশি?” একজন পাগল ও তো বলে, সে যাহা মনে করিতেছে তাহাই ঠিক্। তাহার পক্ষেও কি এই মনে হওয়ার যুক্তিটি যথেষ্ট?”
—“না যথেষ্ট নহে।”
—“এখন কথা হইতেছে, যাহা “মনে হওয়া”রও উপরে—সেটি কি?”
৪। এখন তবে দেখ, তত্ত্বজ্ঞানের আরম্ভ কোথায়। কি করিয়া মনুষ্যগণ পরস্পর-বিরুদ্ধ মত অবলম্বন করে, কোথা হইতে এই পরস্পরবিরোধিতা উৎপন্ন হয়, মতমাত্রই বিশ্বাসযোগ্য কি না, এই সমস্ত সম্যরূপে দর্শন করাই দর্শনশাস্ত্রের আরম্ভ। যাহা মনে হইতেছে তাহা ঠিক্ কি না, এবং আমরা যেমন তুলাদণ্ডের দ্বারা ওজন ঠিক্ করি, ওলন-সূতার দ্বারা সোজা বাঁকা স্থির করি, সেইরূপ এই স্বাভাবিক সংস্কারের প্রয়োগসম্বন্ধে কোন নির্দ্দিষ্ট নিয়ম আছে কি না, তাহারই অনুসন্ধান করা তত্ত্বজ্ঞানের প্রথম সোপান। যাহা আমার মনে হয়, তাহাই কি ঠিক্? কিন্তু তাহা হইলে, যে সকল বিষয় পরস্পর-বিরোধী তাহারা সকলই কেমন করিয়া ঠিক্ হইতে পারে?
—“যাহা মনে হয়, তাহাই ঠিক, এ কথা আমি বলিতেছি না। ঠিক্ বলিয়া যাহা আমার বিশ্বাস হয়, তাহাই ঠিক্।”
“তোমার ঠিক্ বলিয়া যাহা মনে হইতেছে, ঠিক্ তাহার উল্টা বিশ্বাস অন্যের মনে হইতে পারে। অতএব, “মনে হওয়া” আর “বাস্তবিক হওয়া” সকলের পক্ষে সমান কথা নহে। দেখ, ওজন কিম্বা মাপের সময় আমরা “মনে হওয়া”র উপর নির্ভর করি না—তাহাতে সন্তুষ্ট হই না। পরন্তু উভয় স্থলেই, আমরা একটা নির্দ্দিষ্ট নিয়মের অনুসরণ করি। তবে কি শুধু তত্ত্বজ্ঞানের সম্বন্ধেই “মনে হওয়া”-ছাড়া আর কোন নিয়ম নাই? আর, একি কখন সম্ভব, যাহা মানুষের সর্ব্বাপেক্ষা প্রয়োজনীয় তাহার কোন প্রমাণ নাই—আবিষ্কারেরও কোন উপায় নাই। অবশ্যই তাহার একটা নির্দ্দিষ্ট নিয়ম আছে—প্রমাণ আছে। সেই নিয়ম কি, বাহির করিতে চেষ্টা কর। তাহা বাহির করিতে পারিলে সকল প্রকার পাগ্লামি ঘুচিয়া যাইবে। তাহা হইলে “মনে হওয়া”র ভ্রান্তি-প্রবণ মানদণ্ডে আর আমরা বস্তু-সমূহের পরিমাপ করিব না।
৫। আমরা এখন কোন্ বিষয়ের তত্ত্বানুসন্ধান করিতেছি?— সুখের? আচ্ছা, উহাকে তবে সেই নিয়মের হাতে সমর্পণ কর—সেই তৌলদণ্ডে তাহাকে স্থাপন কর।
—“আচ্ছা, শ্রেয় এমন একটি জিনিস কি না, যাহার উপর নির্ভর করা আমাদের কর্ত্তব্য।”
—“নিশ্চয়ই শ্রেয়ের উপর নির্ভর করা কর্ত্তব্য।”
—“আর শ্রেয়কে বিশ্বাস করা উচিত কি না?”
—“হাঁ, বিশ্বাস করা উচিত।”
—“আচ্ছা, যাহা অস্থায়ী তাহার উপর আমরা নির্ভর করিতে পারি কি না?”
—“না, পারি না।”
—“আচ্ছা, সুখের কি কোন স্থায়িত্ব আছে?”
—“না, স্থায়িত্ব নাই।”
আচ্ছা তবে সুখকে অর্থাৎ প্রেয়কে শ্রেয়ের স্থান হইতে সরাইয়া ফেলিয়া তৌলদণ্ড হইতে দূরে নিক্ষেপ কর। কিন্তু যদি তোমার চক্ষের দৃষ্টি ক্ষীণ ও অস্পষ্ট হয়, একটি তৌলদণ্ডকে যদি যথেষ্ট মনে না কর, তাহা হইলে আর একটি তৌলদণ্ড গ্রহণ কর।
—“যাহা শ্রেয় তাহাতেই আনন্দলাভ করা ঠিক কি না?”
—“হাঁ, তাহাই ঠিক্।”
—“আর, সুখের সামগ্রীতে আনন্দলাভ করা কি ঠিক্?”
এই সকল বিষয় তৌলদণ্ডে ভাল করিয়া ওজন করিয়া তবে উত্তর দিও।
নিয়মটি যদি তোমার হস্তগত হয়, তাহা হইলে এই সকল বিষয়ের বিচার করা—পরিমাপ করা তোমার পক্ষে সহজ হইবে।
এই নিয়ম-সকল পরীক্ষা করা,—স্থাপন করাই তত্ত্ববিদ্যার মুখ্য উদ্দেশ্য। এবং এই নিয়মগুলি আবিষ্কৃত হইলে, তাহা জীবনে ব্যবহার করাই তত্ত্বজ্ঞানী সাধু জনের কাজ।