এপিক্টেটসের উপদেশ/একলা থাকা
এক্লা থাকা।
১। আপনাকে এক্লা বলিয়া মনে হয় তাহারি—যে অসহায় ও নিরুপায়। কেননা, একাকী থাকিলেই একলা থাকা হয় না। আবার বহুলোকের সঙ্গে থাকিলেই যে এক্লাভাব ঘুচে—তাহাও নহে। সেই জন্য, যাহারা আমার নির্ভরের স্থল—সেই ভ্রাতা হইতে, কিংবা পুত্র হইতে, কিংবা বন্ধু হইতে যখন আমি বিচ্ছিন্ন হই, তখনই আপনাকে এক্লা বলিয়া মনে হয়। সহরের এত জনতা, এত গৃহ অট্টালিকা, তবু সহরের মধ্যে গিয়া, আপনাকে কখন কখন এক্লা বলিয়া মনে হয়। অর্থাৎ মনে হয়—আমি অসহায়; মনে হয়, এমন সব লোকের মধ্যে আসিয়া পড়িয়াছি যাহারা আমার অনিষ্ট করিতে সঙ্কুচিত হইবে না। ভ্রমণে বাহির হইয়া যদি একদল তস্করের মধ্যে আসিয়া পড়ি, তখনও আমার মনে হয়—আমি এক্লা। বিশ্বাসী ধর্ম্মপরায়ণ হিতৈষী মনুষ্যের দর্শনেই আমাদের এক্লাভাব ঘুচিয়া যায়;— যে কোন মনুষ্যের দর্শনে তাহা হয় না। এ কথা সত্য—আমরা সামাজিক জীব, স্বভাবতই অন্যের সঙ্গে একত্র বাস করিতে আমাদের ইচ্ছা হয়। কিন্তু ইহাও দেখা আবশ্যক কিসে আমি নিজের উপর নির্ভর করিয়া থাকিতে পারি —নিজের সংসর্গেই পরিতৃপ্ত হইতে পারি। কেননা মনুষ্য একাকীই জন্মগ্রহণ করে একাকীই মৃত হয়। দেখ না কেন-ঈশ্বর নিজেই নিজের সঙ্গী; একাকীই জগৎশাসনে ব্যাপৃত, একাকীই স্বকীয় মহৎ সঙ্কল্পের ধ্যানে নিমগ্ন। এইরূপ আমিও যদি আমার নিজের সঙ্গে কথোপকথন করিতে পারি, অন্য সংসর্গের অভাব অনুভব না করি, আপনার মধ্যেই আত্মবিনোদনের উপায় সংগ্রহ করিয়া রাখি, আত্মপর্য্যাপ্ত হই; ঈশ্বরের জগৎশাসন কিরূপ ভাবে চলিতেছে,—বাহ্য বস্তুর সহিত আমার কিরূপ সম্বন্ধ, আমার পূর্ব্ব-অবস্থা কিরূপ ছিল, এখনকার বর্ত্তমান অবস্থাই বা কিরূপ, কোন্ কোন্ বিষয় এখনও আমাকে ক্লেশ দিতেছে, কিরূপে এই সমস্ত দুঃখক্লেশ বিদূরিত অথবা উপশমিত হইতে পারে, অবস্থা-অনুসারে কোন্ কোন্ বিষয়ে আপনার উৎকর্ষ সাধন করিতে পারি,—এই সমস্ত বিষয়ের আলোচনায় যদি আমি ব্যাপৃত থাকি তাহা হইলে আমাকে আর এক্লা থাকিতে হয় না।
২। আমরা ভাবি,—রাজা আমাদিগকে শান্তি প্রদান করিয়াছেন। এখন কোন যুদ্ধবিগ্রহ নাই; দস্যু তস্করের ভয় নাই, এখন দেশের একপ্রান্ত হইতে অপর প্রান্ত পর্য্যন্ত, সকল সময়েই নিরাপদে ভ্রমণ করিতে পারি। এ সমস্তই সত্য; কিন্তু রাজা কি জ্ববরোগ হইতে, নৌকাডুবি হইতে, অগ্ন্যুৎপাত হইতে, ভূমিকম্প হইতে, বজ্র বিদ্যুৎ হইতে, অথবা পঞ্চবাণ হইতে আমাদিগকে নিষ্কৃতি দিতে পারেন?—অথবা দুঃখ শোক হইতে, ঈর্ষা হইতে আমাদিগকে মুক্তি দিতে পারেন? —কখনই না। ইহার কোনোটি হইতেই তিনি আমাদিগকে রক্ষা করিতে পারেন না। কিন্তু তত্ত্বজ্ঞানীরা বলেন, তাঁহাদের কথা শুনিয়া চলিলে, এই সকল দুঃখ ক্লেশের মধ্যেও শান্তি লাভ করা যায়। তত্ত্বজ্ঞানের আশ্বাস বাণীটি কি তাহা শোন:—“যদি তোমরা আমার বাক্যে কর্ণপাত কর,—“হে মনুষ্যগণ! যেখানেই তোমরা থাক না কেন, তােমাদের শেকতাপ চলিয়া যাইবে, ঈর্ষা দ্বেষ চলিয়া যাইবে, কোন রিপুরই আর বশীভূত হইতে হইবে না, কোন বাধাবিঘ্নে প্রতিহত হইবে না, সর্ব্বপ্রকার অনিষ্ট হইতে মুক্ত হইয়া নিরুদ্বেগে জীবনযাত্রা নির্ব্বাহ করিতে পারিবে।” যিনি এইরূপ শান্তি-সম্পদ লাভ করিয়াছেন (যে শান্তির ঘোষণা ঈশ্বর ভিন্ন কোন পার্থিব রাজা কর্ত্তৃক অসম্ভব) তিনি কি আত্ম-পর্য্যাপ্ত ও আপ্তকাম হয়েন না? তখন তিনি এইরূপ বিবেচনা করেন;—“এখন আমার কোন অমঙ্গল ঘটিতে পারে না; আমার আর দস্যুভয় নাই; ভূমিকম্পের ভয় নাই; আমার নিকট, সকল পদার্থই শান্তিময়; কোনও পথ, কোনও নগর, কোনও সঙ্ঘ, কোনও প্রতিবেশী, কোনও সঙ্গীই আমার তিলমাত্র অনিষ্ট করিতে পারে না!” এইরূপ ব্যক্তির জন্য, কেহ যােগায় আহার, কেহ যােগায় বস্ত্র, কেহ যােগায় তাহার জ্ঞানের খােরাক; যে যাহার অধিকারী সেই তাহার অংশ দিয়া তাহাকে সাহায্য করে। যখন এই সকল আবশ্যক সামগ্রীর সরবরাহ বন্ধ হইয়া যাইবে, তখনই বুঝিতে হইবে তাহার পালা সাঙ্গ হইয়াছে, তাহার প্রস্থানের সময় উপস্থিত হইয়াছে; তখনই তাহার সম্মুখে দ্বার উদ্ঘাটিত হয় এবং ঈশ্বর তাহাকে বলেন;—“প্রস্থান কর”।
—“কোথায় প্রস্থান করিব”?
কোন ভীষণ স্থানে নহে;—সেই স্থানে তুমি প্রস্থান করিবে, যেখান হইতে তুমি আসিয়াছ;—যাহারা তােমার আত্মীয় বন্ধু—সেই মহাভূতের মধ্যে। তােমাতে যে অগ্নি ছিল তাহা অগ্নির মধ্যে,—যে বায়ু ছিল তাহা বায়ুর মধ্যে,—যে জল ছিল তাহা জলের মধ্যে চলিয়া যাইবে। কি ভূলােক, কি দ্যুলােক, কি স্বর্গ, কি নরক—এমন কোনও স্থান নাই যাহা দেবতাদের দ্বারা, মহাশক্তিদের দ্বারা পূর্ণ নহে। যাহারা এই সব বিষয় চিন্তা করেন, চন্দ্র সূর্য্য তারা নক্ষত্র দর্শন করিয়া যাহারা পরমানন্দ লাভ করেন, পৃথিবী সমুদ্র দেখিয়া যাহারা উল্লসিত হয়েন, তাঁহারা একলাও নহেন, অসহায়ও নহেন, নিরুপায়ও নহেন।
—“কিন্তু আমাকে এক্লা দেখিয়া যদি কেহ আমাকে হত্যা করে”?
—নির্ব্বোধ! তোমাকে হত্যা করিতে পারে না, তোমার অপদার্থ শরীরকেই হত্যা করিতে পারে।
৩। তুমি একটি ক্ষুদ্র আত্মা—শরীর গ্রহণ করিয়াছ মাত্র।
৪। তবে তুমি আর এক্লা কেমন করিয়া?—তোমার কিসের অভাব? তবে কেন আমরা আপনাকে শিশু অপেক্ষাও অধম করিয়া ফেলি? শিশুরা একলা থাকিলে কি করে? তাহারা ঝিনুক লইয়া, ধূলা-বালি লইয়া ঘর তৈরি করে—আবার ভাঙ্গিয়া ফেলে—আবার তৈরি করে; এইরূপ তাহাদের খেলার আর অন্ত নাই। আর, তুমি চলিয়া গেলে আমি কিনা আপনাকে একলা ভাবিয়া কাঁদিতে বসিব? আমার কি কোন ঝিনুক নাই?—ধূলা-বালি নাই? “কিন্তু শিশুরা নির্ব্বোধ বলিয়াই এইরূপ কার্য্য করে”। আর তুমি জ্ঞানী বলিয়াই আপনাকে অসুখী কর, কেমন কি না? এ তোমার কিরূপ জ্ঞান বল দেখি?