এপিক্টেটসের উপদেশ/বিধাতার অনাগত বিধান
বিধাতার অনাগত-বিধান।
পশুর শরীরের জন্য যাহা কিছু আবশ্যক তাহা আপনা হইতেই তাহারা পায়, তাহার জন্য কোন আয়োজন করিতে হয় না, খাদ্য পানীয়ের জন্য, শয়ন স্থানের জন্য তাহাদের ভাবিতে হয় না। তাহাদের জুতা চাই না, শয্যা চাই না, বস্ত্র চাই না। কিন্তু আমাদের এ সমস্ত চাই। তাহারা নিজের জন্য জীবন ধারণ করে না—মানব-সেবার জন্যই জীবন ধারণ করে। তাহাদের জন্য যদি এই সব আবশ্যকীয় জিনিসের আয়োজন করিতে হইত, তাহা হইলে আমাদের কতই অসুবিধা হইত। গো মেযাদির লোমরূপ গাত্রাবরণ, খুর রূপ উপানৎ যদি আমাদের যোগাইতে হইত, তাহা হইলে আমরা কি মুস্কিলেই পড়িতাম। মানুষের সেবায় নিযুক্ত হইবে বলিয়া, প্রকৃতি-জননী তাহাদিগকে পূর্ব্ব হইতেই সর্ব্বতোভাবে সুসজ্জিত করিয়া রাখিয়াছেন।
প্রকৃতি-রাজ্যে এমন একটি জিনিসও দেখা যায় না যাহাতে বিধাতার পূর্ব্বচিন্তা ও পূর্ব্বায়োজন লক্ষিত না হয়। শ্রদ্ধাবান্ কৃতজ্ঞ ব্যক্তি ইহা সর্ব্বত্রই উপলব্ধি করিয়া থাকেন। বড় বড় বিষয় ছাড়িয়া দেও—শুধু ছোটখাটো বিষয় আলোচনা করিয়া দেখিলেই ইহা উপলব্ধি হইবে। ঘাস হইতে কিরূপে দুগ্ধ উৎপন্ন হয়, দুগ্ধ হইতে কিরূপে পনির উৎপন্ন হয়, চর্ম্ম হইতে কিরূপে পশম উৎপন্ন হয়, একবার ভাবিয়া দেখ। এই সমস্তের মধ্যে কাহার হস্ত দেখা যায়?—কাহার কার্য্য-কল্পনা লক্ষিত হয়? তুমি কি বলিবে—“কাহারও নহে?” কি বিষম ধৃষ্টতা! কি মূঢ়তা!
এই কথা বুঝিতে পারিলে, সেই পরম দেবতার মহিমা কীর্ত্তনে আমরা কি ক্ষণমাত্র বিরত হইতে পারি? যখন আমরা আহারের উদ্দেশে মৃত্তিকা খনন করি, কিংবা কর্ষণ করি, তখন কি এই বলিয়া তাহার গুণগান করিব না যে, “মহান্ সেই ঈশ্বর যিনি ভূমিকর্ষণের জন্য আমাদিগকে এই সব যন্ত্র দিয়াছেন; মহান্ সেই ঈশ্বর যিনি আমাদিগকে হস্ত দিয়াছেন, উদর দিয়াছেন, খাদ্য দিয়াছেন, যিনি আমাদের অজ্ঞাতসারে শস্য বর্দ্ধিত করিতেছেন, এবং নিদ্রাকালে আমাদের নিশ্বাস প্রশ্বাস নিয়মিত করিতেছেন? তিনি যে আমাদিগকে তাঁহার বিশ্বরচনা আলোচনা করিবার শক্তি দিয়াছেন, কোন্ পথে চলিতে হইবে আমাদিগকে জানাইয়া দিয়াছেন,—ইহার জন্য তাঁহার মহিমা কীর্ত্তন করা কি মনুষ্যমাত্রেরই কর্ত্তব্য নহে?
তোমাদের মধ্যে অধিকাংশ লোকই অন্ধ;—তোমাদের মধ্যে কি তবে একজনও নাই যে এই স্থান অধিকার করে?—সকলের হইয়া তাঁহার মহিমা কীর্ত্তন করে? আমি বৃদ্ধ, আমি খঞ্জ,—ঈশ্বরের গুণগান ভিন্ন আমি আর কি করিতে পারি? আমি যদি কোকিল হইতাম, কোকিলেরা যাহা করে, আমি তাহাই করিতাম। আমি যদি রাজহংস হইতাম,—রাজহংসেরা যাহা করে, আমি তাহাই করিতাম। কিন্তু আমি যে জ্ঞান-বুদ্ধিসম্পন্ন জীব,—আমার কর্ত্তব্য ঈশ্বরের মহিমা কীর্ত্তন করা। এই আমার জীবনের নির্দ্দিষ্ট কাজ; ইহাই আমি চিরকাল করিব, এ কাজ আমি কখনও ছাড়িব না; যতদিন থাকে দেহে প্রাণ, করিব তাঁরই নাম গান; এবং এই নাম-গানে তোমাদিগকেও আমি আহ্বান করিতেছি।