এপিক্টেটসের উপদেশ/রাজশক্তি ও আত্মবল
রাজশক্তি ও আত্মবল।
১। অন্য-অপেক্ষা যদি কোন ব্যক্তির বেশী সুযোগ-সুবিধা থাকে, আর যদি সে অশিক্ষিত হয়, তাহা হইলে সে গর্ব্বে স্ফীত না হইয়া থাকিতে পারে না। তাই প্রজা-পীড়ক রাজা এইরূপ সগর্ব্বে বলিয়া থাকেন “জান আমি কে?—আমি সকলের প্রভু।” আচ্ছা প্রভু যে তুমি—তুমি আমাকে কি দিতে পার? আমার কাজের সমস্ত বাধাবিঘ্ন কি তুমি অপসারিত করিতে পার? তোমার কি সে ক্ষমতা আছে? যে জিনিসের প্রতি তোমার দ্বেষ, তাহা কি সকল সময়ে তুমি পরিবর্জ্জন করিতে পার? অথবা যাহা তুমি পাইতে ইচ্ছা কর, তাহা কি তুমি সকল সময়ে পাইয়া থাক? তোমার সে দৈবশক্তি কি আছে? সকল কার্য্যই কি তােমার সাধ্যায়ত্ত? জাহাজে চড়িয়া তুমি আপনার উপর নির্ভর কর—না কাপ্তেনের উপর নির্ভর কর? রথে আরােহণ করিয়া তােমার কি সারথীর উপর নির্ভর করিতে হয় না? তাই জানিবে, তুমি সকল কার্য্যের প্রভু নহ। তাহা হইলে কিসে তােমার প্রভুত্ব? “সকল মনুষ্যই আমার সেবায় নিযুক্ত”। ভাল,—যখন আমি আমার থালা-বাসন ধুই-মাজি, তখন কি আমি থালা-বাসনের সেবা করি না? তাই বলিয়া, আমার অপেক্ষা আমার থালা-বাসন কি বড়? উহারা আমার কতকগুলি অভাব মােচন করে বলিয়াই আমি উহাদের যত্ন করি। আমি কি আমার গর্দ্দভের সেবা-শুশ্রূষা করি না? আমি কি তাহার পা ধুইয়া দিই না—তাহার দেহচর্য্যা করি না? তুমি কি জাননা, প্রত্যেক ব্যক্তিই নিজের সেবা করে? কোন ব্যক্তি যেরূপ আপনার গাধার সেবা করে—সেইরূপ তােমারও সেবা করিয়া থাকে। তােমার প্রতি মানুষের মত কে ব্যবহার করে? কে তােমার মত হইতে চাহে? লােকে যেরূপ সক্রেটিসের অনুকরণ করিত, সেইরূপ তােমার অনুকরণ কি কেহ করিতে চাহে?
—“জান আমি তােমার মস্তক ছেদন করিতে পারি।” বেশ কথা বলিয়াছ। আমি সে কথা ভুলিয়া গিয়াছিলাম। যে হিসাবে লোকে ওলাউঠার দেবতাকে পূজা করে, জ্বরের দেবতাকে পূজা করে, সেই হিসাবে তুমিও আমার পূজ্য সন্দেহ নাই।
২। লােকে তবে কিসের এত ভয় করে? অত্যাচারী রাজার ভয়?— তাঁহার রক্ষিগণের ভয়? ঈশ্বর করুন যেন আমাদের সে ভয় করিতে না হয়। যাহার স্বাধীনতা প্রকৃতিসিদ্ধ সেই মানবাত্মা তাহার প্রকৃতিগত বাধা-বিঘ্ন ছাড়া আর কোন প্রকার বাধা-বিঘ্নে কি উত্তেজিত কিংবা বিচলিত হইতে পারে?—কখনই না। সে শু মিথ্যাজ্ঞান বা মােহবশেই এরূপ বিচলিত হইয়া থাকে। কেন না, যখন সেই অত্যাচারী রাজা কোন ব্যক্তিকে বলে;—“তোমার পায়ে আমি বেড়ী দিব,” সে ব্যক্তির পদ-যুগল যদি তাহার বিশেষ যত্নের জিনিস হয় ত সে বলিবে “দোহাই ধর্ম্মাবতার, আমার উপর দয়া করুন,” কিন্তু আত্মার উপর—আত্মার স্বাধীনতার উপরেই যাহার বেশী আস্থা,—সে বলিবে “ইহাতে যদি তোমার বেশী সুবিধা হয়—তাহাই কর।”
—“আমাকে কি তবে প্রভু বলিয়া তুমি গ্রাহ্য কর না?”—না, আমি করি না। আমি তোমাকে দেখাইব, আমিই আমার প্রভু! তুমি কিরূপে আমার প্রভু হইবে? ঈশ্বর আমাকে স্বাধীন করিয়া দিয়াছেন। তুমি কি মনে কর ঈশ্বর তাঁহার নিজের সন্তানকে ক্রীতদাস হইতে দিবেন? তুমি আমার মৃত শরীরেরই প্রভু—এই লও সেই শরীর।
—“তুমি তবে আমার সেবা করিবে না?”
না, আমি আমার আত্মারই সেবা করিব; আর এই কথা আমার মুখ দিয়া যদি বলাইতে চাও যে আমি তোমারও সেবা করিব,—তাহা হইলে আমি বলিতেছি আমি সেইরূপ ভাবে তোমার সেবা করিব, যেরূপ ভাবে আমি আমার ঘটি বাটীর সেবা করিয়া থাকি।
৩। ইহা স্বার্থপরতা নহে। সমস্ত কাজ নিজের জন্যই করিবে এই ভাবেই প্রত্যেক জীব সৃষ্ট হইয়াছে। কিন্তু জ্ঞান-বুদ্ধিসম্পন্ন জীবসমূহ এইরূপ ভাবে গঠিত, যদি তাহারা আত্মহিত করে, সেই সঙ্গে সাধারণের হিত না হইয়া থাকিতে পারে না। অতএব সাধারণের হিতকে বাদ দিয়া কেহ কখন আপনার প্রকৃত হিত করিতে পারে না। ইহা কি কখন প্রত্যাশা করা যায় যে কোন মানুষ আপনা-হইতে আত্মহিত হইতে একেবারেই দূরে থাকিবে? যে মূলতত্ত্বটী সমস্ত প্রকৃতির মধ্যে দেখা যায় সেই আত্মপ্রীতি তাহা হইলে কোথায় থাকে?
৪। অতএব আত্মা ছাড়া আর কোন বিষয়ের উপর আমাদের যদি আস্থা থাকে,—আর কোন বিষয়কে যদি ভাল কিম্বা মন্দ বলিয়া আমরা মনে করি,—বিষয়-সমূহের মিথ্যাপ্রতীতি যদি আমাদের অন্তরে পোষণ করি, তাহা হইলে কাজেকাজেই আমাদিগকে অত্যাচারী রাজার সেবায় নিযুক্ত হইতে হইবে। শুধু রাজার সেবা হইলেও বাঁচিতাম—রাজার অধম পেয়াদাদিগেরও সেবা করিতে হইবে।
৫। যে, এইরূপ ভাল-মন্দ ভেদবিচারে সমর্থ, সে কেন না শান্তভাবে জীবনযাত্রা নির্ব্বাহ করিতে পারিবে? যাহা ঘটিবে ও যাহা ঘটিয়াছে তাহার প্রতি অবিচলিত ভাবে দৃষ্টিপাত করিতে কেন না সমর্থ হইবে? তুমি আমাকে দারিদ্র্যের মধ্যে নিক্ষেপ করিতে চাও? দেখ, আমি তাহা অম্লানবদনে গ্রহণ করিতে পারি কি না;—দেখ দারিদ্র্যের অভিনয় আমি ভাল করিয়া করিতে পারি কি না। তুমি চাও আমি দেশশাসন করি?—আমাকে সেইরূপ কর্ত্তৃত্ব দেও—দায়িত্ব দেও—তাহা হইলে আমি তাহার ক্লেশভারও বহন করিব। নির্ব্বাসন?—যেখানেই যাই না কেন, সেই খানেই আমি ভাল থাকিব। এখানে যে আমি ভাল ছিলাম তাহা স্থানের জন্য নহে,—আমার মতামত অক্ষত ছিল বলিয়াই। যেখানেই যাই, আমার সেই মতামত আমি সঙ্গে লইয়া যাইব। আমার মতামত হইতে আমাকে কেহই বঞ্চিত করিতে পারিবে না। উহাই আমার নিজস্ব বস্তু; উহা রক্ষা করিতে পারিলে, যাহাই করি না কেন, যেথাই যাই না কেন, তাহাতে কিছুই আইসে যায় না।
৬। “কিন্তু এইবার যে তোমার মৃত্যুকাল উপস্থিত।”
কি বলিতেছ?—মৃত্যু? ওগো! মৃত্যুকে তুমি শোকের ব্যাপার করিয়া তুলিও না—উহা যেমনটি ঠিক্ তাহাই বল। যে পঞ্চভূত হইতে আমি আসিয়াছিলাম, সেই পঞ্চভূতে আবার আমায় মিশিয়া যাইতে হইবে;—এই না? ইহাতে ভয়ের বিষয় কি আছে? বিশ্বের কোন্ কোন্ পদার্থ এইবার তবে বিশ্বমাঝে বিলীন হইবে? এমন কি অভাবনীয় নূতন ঘটনা ঘটিতে যাইতেছে যাহা কেহ কখন দেখে নাই—শুনে নাই? এইজন্যই কি রাজাকে ভয় করিতে হইবে? এই কার্য্যসাধন করিবার জন্যই কি রক্ষিগণ বড় বড় তীক্ষ্ণ অসি ধারণ করিয়া আছে? এ কথা অন্যের নিকট বল; এ সমস্ত জিনিস আমি ভাল করিয়া পরীক্ষা করিয়া দেখিয়াছি। আমার উপর মানুষের কোন ক্ষমতা নাই। ঈশ্বর আমাকে স্বাধীন করিয়া দিয়াছেন; তাঁহার কিরূপ আদেশ, আমি তাহা জানি; আমাকে কেহই বন্দী করিতে পারে না। আমার মুক্তিদাতা আমার সঙ্গেই রহিয়াছেন; আমার বিচারকর্ত্তাও আমার সঙ্গে রহিয়াছেন। তুমি শুধু আমার শরীরের প্রভু। তাহাতে আমার কি আইসে যায়? আমার সম্পত্তির কথা বলিতেছ? সম্পত্তি-নাশে আমার কি আইসে যায়? নির্ব্বাসন, কারাদণ্ড?—আবার আমি বলিতেছি,—যখনি তুমি বলিবে, তখনই এই সমস্ত জিনিস অনায়াসে ছাড়িয়া যাইব। তোমার ক্ষমতাটা একবার জারি করিয়াই দেখ না, দেখি তাহার কতদুর দৌড়।
৭। কিন্তু রাজা আমাকে যে বন্ধন করিবে। আমার বন্ধন করিবে কি?—না, আমার পদদ্বয়। আমার লইবে কি?—না, আমার মস্তক। আমার যাহা কেহ বন্ধন করিতে পারে না—সে জিনিস্টা কি তবে?— আমার আত্মা;—আমার আত্ম-স্বাধীনতা। তাই পুরাকালের এই উপদেশ—“আপনাকে জানো।”
৮। আমি তবে কাহাকে ভয় করিব? রাজার দ্বারিগণকে? তাহারা আমার কি করিতে পারে?—আমাকে প্রবেশ করিতে দিবে না? আমি যদি প্রবেশ করিতে চাই তবেই ত আমাকে প্রবেশ করিতে দিবে না।
আমার ইচ্ছা হইলেও আমি প্রবেশ করিব না। কেন না, আমার ইচ্ছা অপেক্ষা ঈশ্বরের ইচ্ছাই আমার নিকট বলবতী। আমি তাঁহারই অনুগত ভৃত্য ও অনুচর; তাঁহার যাহা ইচ্ছা আমারও তাই ইচ্ছা, তিনি যে পথে যাইতে বলিবেন আমি সেই পথেই চলিব। আমাকে কেহ বহিষ্কৃত করিতে পারে না; যাহারা জোর করিয়া প্রবেশ করিতে যায় তাহারাই বহিষ্কৃত হয়। আমি প্রবেশ করিতে চাই না কেন? কারণ আমি জানি, যাহারা রাজদ্বারে প্রবেশ করে তাহারা ভাল জিনিস কিছুই পায় না। কিন্তু সীজার অমুক ব্যক্তিকে সম্মানিত করিয়াছেন বলিয়া আমি যখন কাহাকে তাহার প্রতি অভিনন্দন প্রকাশ করিতে শুনি, আমি তখন তাহাকে জিজ্ঞাসা করি, তোমার ভাগ্যে কি লাভ হইল? কোন দেশের শাসনভার?—আচ্ছা সেই সঙ্গে কি তুমি ন্যায়পরতা সম্বন্ধেও কিছু শিক্ষা পাইয়াছ? ম্যাজিষ্ট্রেটের কাজ?—সেই সঙ্গে ভাল ম্যাজিষ্ট্রেট হইবার শক্তি কি কিছু অর্জ্জন করিয়াছ? তবে আর কি হইল? এক ব্যক্তি শুধু কতকগুলা চিনির বাতাস লইয়া বাহিরে ছড়াইয়া দিতেছে; শিশুগণ তাহাই লইবার জন্য আপনাদের মধ্যে কাড়াকাড়ি করিতেছে। কিন্তু পূর্ণবয়স্ক পুরুষেরা তাহার জন্য লালায়িত হইতে পারে না;—তাহারা এই সমস্তকে তুচ্ছজ্ঞান করে। সরকারী চাকরী বিতরণ করা হইতেছে—শিশুরা তাহার অন্বেষণ করুক; অর্থ বিতরণ করা হইতেছে—শিশুরা তাহার জন্য কাড়াকাড়ি করুক। তাহারা রাজদ্বার হইতে তাড়িত হইতেছে—মার খাইতেছে, তথাপি যে-হাতের মার খাইতেছে, সেই হাতই আবার তাহারা চুম্বন করিতেছে; কিন্তু আমার নিকট রাজার এই সব দান তুচ্ছ হইতেও তুচ্ছ।