বেশভূষা।

 একদিন একটি যুবক, সযত্নে কেশবিন্যাস ও বেশবিন্যাস করিয়া এপিক্‌টেটাসের নিকট উপস্থিত হইল। এপিক্‌টেটাস্‌ এইরূপ বলিলেন:—

 “কোন-কোন কুকুরকে, কোন-কোন ঘোড়াকে, কিংবা অন্য কোন জন্তুকে সুন্দর বলিয়া কি তোমার মনে হয় না?”

 সে বলিল -“হাঁ, মনে হয় বৈ কি।

 —“সেইরূপ, কোন-কোন মানুষও সুন্দর কিংবা কুৎসিৎ নয় কি?”

 —“তা ত বটেই”

 —“এই যে সব সুন্দর জীবজন্তু, উহাদের প্রত্যেককে কি একই কারণে আমরা সুন্দর বলি?—না ঐ প্রত্যেকের মধ্যে এমন একটা কিছু আছে যাহা তাহাকেই সাজে, এবং যাহা থাকার দরুণই আমরা তাহাকে সুন্দর বলি? কথাটা এইরূপ দাড়াইতেছে যেহেতু আমরা দেখিতে পাই, প্রকৃতি বিশেষ বিশেষ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য, কুকুর ঘোড়া কোকিল প্রভৃতি বিশেষ বিশেষ জীব-জন্তুকে সৃষ্টি করিয়াছেন, অতএব এইরূপ সিদ্ধান্ত করা অযৌক্তিক নহে যে ঐ প্রত্যেক জাতীয় জীবজন্তুর মধ্যে নিজ নিজ প্রকৃতি অনুসারে যাহারা উৎকৃষ্ট তাহাদিগকেই আমরা সুন্দর বলি। এবং যেহেতু প্রত্যেক জাতীয় জীবের প্রকৃতি বিভিন্ন, অতএব উহাদের প্রত্যেকের সৌন্দর্য্যের প্রকারও বিভিন্ন। তাহা নহে কি?”

 সে ব্যক্তি এই কথার যৌক্তিকতা স্বীকার করিল।

 —“অতএব যাহা থাকায় কুকুর সুন্দর, তাহাতেই অশ্ব কুৎসিৎ বলিয়া মনে হয়, এবং যাহা থাকায় অশ্ব সুন্দর, তাহাতেই কুকুরকে কুৎসিৎ বলিয়া মনে হয়। জাতিগত প্রকৃতিভেদে সৌন্দর্য্যেরও প্রকার ভেদ হয় না কি?”

 —“হাঁ এইরূপই ত মনে হয়।”

 “যাহাতে-করিয়া একজন সুন্দর মল্লযোদ্ধা তৈয়ারী হয়, তাহাতে করিয়া একজন সুন্দর নর্ত্তক কখনই হইতে পারে না।”

 সে ব্যক্তি বলিল:—“তা ত বটেই”।

 —“মানুষের সৌন্দর্য্য তবে কিসের উপর নির্ভর করে?

 যে হিসাবে কুকুর সুন্দর—ঘোড়া সুন্দর, সেই একই হিসাবে কি মানুষ সুন্দর নহে?”

 সে ব্যক্তি বলিল;—“তাহাই বটে।”

 “কুকুরের সৌন্দর্য্য তবে কিসের উপর নির্ভর করে?”

 —কুকুরের স্বধর্ম্ম কুকুরের মধ্যে থাকায়। আর ঘোড়াড়র সৌন্দর্য্য? —ঘোড়ার স্বধর্ম্ম ঘোড়ার মধ্যে থাকায়। তাহা হইলে, মানুষের সৌন্দর্যও কি মানুষের স্বধর্ম্মের উপর নির্ভয় করে না? অতএব সৌম্য যুবক! যদি তুমি সুন্দর হইতে চাহ, তাহা হইলে মানুষের যাহা স্বধর্ম্ম তাহারই উৎকর্ষ সাধনে যত্নশীল হও। কিন্তু এই মনুষ্য-ধর্ম্মটা কি? তুমি যখন কাহাকে মনের সহিত প্রশংসা কর, তখন কিসের জন্য তাহাকে প্রশংসা কর? তাহার সাধুতার জন্য নহে কি?

 —“হাঁ সাধুতার জন্যই”

 মিতাচারী ও অমিতাচারী—ইহার মধ্যে তুমি কাহাকে প্রশংসা কর?

 —“মিতাচারীকে”

 ইন্দ্রিয়াসক্ত ও জিতেন্দ্রিয় ইহাদের মধ্যে তুমি কাহাকে প্রশংসা কর?

 —“জিতেন্দ্রিয়কে”  অতএব, যাহার তুমি প্রশংসা কর তাহার মত যদি তুমি আপনাকে করিয়া তুলিতে পার তবেই জানিবে তুমি আপনাকে সুন্দর করিয়া তুলিতেছ। কিন্তু যতদিন এই সব বিষয়ে অবহেলা করিবে, ততদিন আপনাকে সুন্দর করিবার যত উপায়ই অবলম্বন কর না,তুমি কুৎসিৎই থাকিবে।

 কেন না, তুমি মাংস নহ—তুমি কেশ নহ;—তুমি আত্মপুরুষ; তুমি যদি তোমার আত্মাকে সুন্দর করিতে পার, তাহা হইলেই তুমি সুন্দর হইবে। তুমি কুৎসিৎ—এ কথা আমি তোমার নিকট সাহস করিয়া বলিতে পারি না; কিন্তু যদি তোমাকে কেহ কুৎসিৎ বলে, তাহা হইলে তোমার তাহা সহ্য করা উচিত। কেন না, এ অবস্থায়, কুৎসিৎ ছাড়া তোমার প্রতি আর কোন্ শব্দ প্রয়োগ করা যাইতে পারে? আল্‌সিবাইডিস্ ত একজন অদ্বিতীয় সুপুরুষ ছিলেন; সক্রেটিস্‌ তাঁহাকে কি বলিয়াছিলেন জানো ত?—তিনি বলিয়াছিলেন:—“সুন্দর হইতে চেষ্টা কর। মস্তকের কেশ কুঞ্চিত করিয়া, পায়ের রোমাবলী উৎপাটিত করিয়া সুন্দর হইবে?—না, তাহা নহে। তোমার আত্মাকে সুব্যবস্থিত কর,—সংযত কর; সমস্ত অশুভ চিন্তা আত্মা হইতে অপসারিত কর।”

 —“শরীর সম্বন্ধে তাহা হইলে কি করা কর্ত্তব্য?”

 —“প্রকৃতি শরীরকে যেভাবে গড়িয়াছেন তাহাকে সেই ভাবেই রাখিবে। জানিবে, আর একজন শরীরের তত্ত্বাবধান করিতেছেন; শরীরকে তাঁহারই হস্তে সমর্পণ কর।”

 —“তবে কি শরীরকে অপরিষ্কার ও মলিন করিয়া রাখিতে হইবে?”

 “তাহা কখনই নহে। তুমি বাস্তবিক যাহা—প্রকৃতি তোমাকে যেরূপ ভাবে গড়িয়াছেন—তুমি সেই ভাবে আপনাকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখ। পুরুষ পুরুষের মত, স্ত্রীলােক স্ত্রীলােকের মত, শিশু শিশুর মত পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকুক্।

 ৩। আমি চাহি না, তত্ত্বজ্ঞানীর শারীরিক ভাব দেখিয়া, লােকে ভয় পাইয়া তত্ত্বজ্ঞান হইতে দূরে সরিয়া যায়। যেরূপ আর সমস্ত বিষয়ে, সেইরূপ শারীরিক বিষয়েও তত্ত্বজ্ঞানী সর্ব্বদাই প্রহৃষ্ট ও নিরুদ্বিগ্ন থাকিবেন।

 বন্ধুগণ! তােমরা দেখ, আমার কিছুই নাই। আমার কিছুরই প্রয়ােজন নাই। দেখ আমি গৃহশূন্য, ভূমিশূন্য;—আমি নির্ব্বাসিত। যদিও আমি গৃহহীন তথাপি,—ধনাঢ্যরা যে সকল চিন্তায়—যে সকল মনকষ্টে প্রপীড়িত—আমি তাহা হইতে বর্জ্জিত। আমার শরীরও দেখ; এই কঠোরতার দরুণ আমার শরীর কিছুমাত্র খারাপ হয় নাই। যদি আমি কয়েদীর মত পােষাক পরিয়া অবস্থিতি করি, তাহা হইলে তত্ত্বজ্ঞানের উপদেশ শুনিতে আমার কাছে কে ঘেঁসিবে? মুনিঋষি হইতে গেলে যদি এইরূপ ভাবে থাকিতে হয়, তাহা হইলে আমি সেরূপ মুনিঋষি হইতেও চাহি না।

 তত্ত্বজ্ঞানের উপদেশ শুনিবার জন্য কোন যুবক প্রথমে যখন আমার নিকট আইসে—আমি চাহি সে চুল এলােমলাে না করিয়া বরং পরিপাটী কুঞ্চিত কেশে আমার নিকট আইসে। কেন না, তাহা হইলে আমি বুঝিব, তাহার কতকটা সৌন্দর্য্যবােধ আছে। বুঝিব—সে যাহা শােভন ও সুন্দর বলিয়া মনে করে, তদনুসারেই সে আপনাকে বিভূষিত করিয়াছে। এরূপ লােককে, প্রকৃত সুন্দর কি—শুধু তাহাই দেখান আবশ্যক। আমি তাহাকে বলি:—“সৌম্য যুবক! তুমি সুন্দরকে খুঁজিতেছ—ভালই করিতেছ। কিন্তু আসল সৌন্দর্য্য সেইখানে যেখানে তোমার আত্মা অধিষ্ঠিত;—যেখানে তােমার রাগ দ্বেষ, যেখানে তােমার রতি বিরতি, যেখানে তােমার স্বাধীনতা বিদ্যমান; কিন্তু তােমার শরীর মৃৎপিণ্ড ভিন্ন আর কিছুই নহে। কেন তবে শরীরের জন্য মিছামিছি এত শ্রম যত্ন করা? কেন না, মহাকাল যদি তােমাকে আর কোন শিক্ষা না দেয়, অন্তত এই শিক্ষাটি তােমাকে নিশ্চয়ই দিবে যে, শরীর জিনিসটা কিছুই নহে। কিন্তু যদি কেহ আমার নিকট আইসে যাহার শরীর অপরিষ্কার অপরিচ্ছন্ন, বাহার গুম্‌ফ হাঁটু পর্যন্ত ঝুলিয়া পড়িয়াছে, তাহাকে আমি কি বলিব? কিসের উপমা দিয়া, কিসের দৃষ্টান্ত দিয়া আমি তাহাকে বুঝাইব? সে যদি সৌন্দর্য্যের কোন চর্চ্চা না করিয়া থাকে, তাহা হইলে সৌন্দর্য্যের অন্য পথ তাহার জন্য কি করিয়া আমি নির্দ্দেশ করিব? কেমন করিয়া তাহাকে বুঝাইব “সৌন্দর্য্য এখানে নাই—সৌন্দর্য্য ঐখানে”? আমি যদি তাহাকে বলি—শারীরিক মলিনতার উপর সৌন্দর্য্য নির্ভর করে না,—সৌন্দর্য্য আত্মার জিনিস—সে কি তাহা বুঝিবে? সে কি আদৌ সৌন্দর্য্যকে অন্বেষণ করে? তাহার মনে কি সৌন্দর্য্যের কোন ভাব আছে? আমি যদি একটা শূকরকে বলি, তুই কাদায় গড়াগড়ি দিস্ না—সে কি আমার কথা শুনিবে?