কথামালা (১৮৭৭)/পীড়িত সিংহ
পীড়িত সিংহ
এক সিংহ, অত্যন্ত বৃদ্ধ ও দুর্ব্বল হইয়া, আর শিকার করিতে পারিত না। সুতরাং, তাহার আহার বন্ধ হইয়া আসিল। তখন সে, পর্ব্বতের গুহার মধ্যে থাকিয়া, এই কথা রটাইয়া দিল, সিংহ অতিশয় পীড়িত হইয়াছে; আর চলিতে পারে না, উঠিতে পারে না, কথা কহিতে পারে না। এই সংবাদ নিকটস্থ পশুদের মধ্যে প্রচার হইলে, তাহারা একে একে সিংহকে দেখিতে যাইতে লাগিল। সিংহ নিতান্ত দুর্বল হইয়াছে ভাবিয়া, যেমন কোনও পশু নিকটে যায়, অমনি সিংহ, তাহার ঘাড় ভাঙ্গিয়া, সচ্ছন্দে আহার করে।
এই রূপে কয়েক দিন গত হইলে, এক শৃগাল, সিংহকে দেখিবার নিমিত্ত, গুহার দ্বারে উপস্থিত হইল। সিংহ যথার্থই পীড়িত হইয়াছে, অথবা ছল করিয়া, নিকটে পাইয়া, পশুদিগের প্রাণ বধ করিতেছে, শৃগালের মনে এরূপ সন্দেহ ছিল। এজন্য, সে, গুহায় প্রবেশ করিয়া, সিংহের নিতান্ত নিকটে না গিয়া, কিঞ্চিৎ দূর হইতে জিজ্ঞাসিল, মহারাজ! আপনি কেমন আছেন? সিংহ, শৃগালকে দেখিয়া, অতিশয় আহ্লাদ প্রকাশ করিয়া, কহিল, কে ও, আমার পরম বন্ধু। শৃগাল! এস ভাই এস; আমি ভাবিতেছিলাম, ক্রমে ক্রমে, সকল বন্ধুই আমায় দেখিতে আসিল, পরম বন্ধু শৃগাল আসিল না কেন। যাহা হউক ভাই! তুমি যে আসিয়াছ, ইহাতে অত্যন্ত আহ্লাদিত হইলাম। যদি ভাই! আসিয়াছ, দূরে দাঁড়াইয়া রহিলে কেন? নিকটে এস, দুটা মিষ্ট কথা বল, আমার কর্ণ শীতল হউক। দেখ ভাই! আমার শেষ দশা উপস্থিত; আর অধিক দিন বাঁচিব না।
শুনিয়া শৃগাল কহিল, মহারাজ! প্রার্থনা করি, শীঘ্র সুস্থ হউন। কিন্তু, আমায় ক্ষমা করিবেন, আমি আর অধিক নিকটে যাইতে, অথবা অধিক ক্ষণ এখানে থাকিতে, পারিব না। বলিতে কি মহারাজ! পদচিহ্ন দেখিয়া স্পষ্ট বোধ হইতেছে, এই গুহার মধ্যে অনেক পশু প্রবেশ করিয়াছে, কিন্তু প্রবেশ করিয়া, কেহ পুনরায় বহির্গত হইয়াছে, তাহা কোনও ক্রমে বোধ হইতেছে না। ইহাতে আমার অন্তঃকরণে অত্যন্ত আশঙ্কা উপস্থিত হইয়াছে। আর আমার এখানে থাকিতে সাহস হইতেছে না, আমি চলিলাম! এই বলিয়া, শৃগাল পলায়ন করিল।