কথামালা (১৮৭৭)/সারসী ও তাহার শিশু সন্তান

সারস ও তাহার শিশু সন্তান

এক সারসী, শিশু সন্তানগুলি লইয়া, কোনও ক্ষেত্রে বাস করিত। ঐ ক্ষেত্রের শস্য সকল পাকিয়া উঠিলে, সারসী বিবেচনা করিল, অতঃপর কৃষকেরা শস্য কাটিতে আরম্ভ করিবেক। এই নিমিত্ত, প্রতিদিন, আহারের অন্বেষণে বাহিরে যাইবার সময়, সে শিশু সন্তানদিগকে কহিয়া যাইত, তোমরা, আমার আসিবার পূর্ব্বে, যাহা কিছু শুনিবে, আমি আসিব মাত্র, সে সমুদয় অবিকল কহিবে।

 এক দিন, সারসী বাসা হইতে বহির্গত হইয়াছে, এমন সময়ে ক্ষেত্রস্বামী, শস্য কাটিবার সময় হইয়াছে কি না, বিবেচনা করিয়া দেখিবার নিমিত্ত, তথায় উপস্থিত হইল, এবং চারি দিক নিরীক্ষণ করিয়া কহিল, শস্য সকল পাকিয়া উঠিয়াছে, আর কাটিতে বিলম্ব করা উচিত নয়। অমুক অমুক প্রতিবেশীকে ভার দি, তাহারা কাটিয়া দিবে। এই বলিয়া সে চলিয়া গেল।

 সারসী বাসায় আসিলে, তাহার সন্তানেরা ঐ সমস্ত কথা জানাইল, এবং কহিল, মা! তুমি আমাদিগকে শীঘ্র স্থানান্তরে লইয়া যাও। আর তুমি, আমাদিগকে এখানে রাখিয়া, বাহিরে যাইও না। যাহারা শস্য কাটিতে আসিবেক, তাহারা, দেখিলেই, আমাদের প্রাণ বধ করিবেক। সারসী কহিল, বাছা সকল! তোমরা এখনই ভয় পাইতেছ কেন। ক্ষেত্রস্বামী যদি, প্রতিবেশীদিগের উপর ভার দিয়া, নিশ্চিন্ত থাকে, তাহা হইলে, শস্য কাটিতে আসিবার অনেক বিলম্ব আছে।

 পর দিবস, ক্ষেত্রস্বামী পুনরায় তথায় উপস্থিত হইল; দেখিল, যাহাদিগকে ভার দিয়াছিল, তাহারা শস্য কাটিতে আইসে নাই। কিন্তু, শস্য সকল সম্পূর্ণ পাকিয়া উঠিয়াছিল; অতঃপর না কাটিলে হানি হইতে পারে, এই নিমিত্ত, সে কহিল, আর সময় নষ্ট করা হয় না; প্রতিবেশীদের উপর ভার দিয়া নিশ্চিন্ত থাকিলে, বিস্তর ক্ষতি হইবেক। আর তাহাদের ভরসায় না থাকিয়া, আপন ভাই বন্ধু দিগকে বলি, তাহারা সত্বর কাটিয়া দিবেক। এই বলিয়া, সে আপন পুত্রের দিকে মুখ ফিরাইয়া কহিল, তুমি তোমার খুড়াদিগকে আমার নাম করিয়া বলিবে, যেন তাহারা, সকল কর্ম্ম রাখিয়া, কাল সকালে আসিয়া, শস্য কাটিতে আরম্ভ করে। এই বলিয়া তাহারা পিতা পুত্রে চলিয়া গেল।

 সারসশিশুগণ শুনিয়া অতিশয় ভীত হইল, এবং সারসী আসিবা মাত্র, কাতর বাক্যে কহিতে লাগিল, মা! আজ ক্ষেত্রস্বামী আসিয়া এই এই কথা বলিয়া গিয়াছে। তুমি আমাদের একটা উপায় কর। কাল তুমি, আমাদিগকে এখানে ফেলিয়া, যাইতে পারিবে না। যদি যাও, আসিয়া আর আমাদিগকে দেখিতে পাইবে না। সারসী, শুনিয়া, ঈষৎ হাস্য করিয়া, কহিল, যদি এই কথা মাত্র শুনিয়া থাক, তাহা হইলে, ভয়ের বিষয় নাই। যদি ক্ষেত্রস্বামী, ভাই বন্ধু দিগের উপর ভার দিয়া, নিশ্চিন্ত থাকে, তাহা হইলে, শস্য কাটিতে আসিবার, এখনও, অনেক বিলম্ব আছে। তাহাদেরও শস্য পাকিয়া উঠিয়াছে; তাহারা, আগে আপনাদের শস্য না কাটিয়া, কখনও, ইহার শস্য কাটিতে আসিবেক না। কিন্তু ক্ষেত্রস্বামী, কাল সকালে আসিয়া, যাহা কহিবেক, তাহা মন দিয়া শুনিও, এবং আমি আসিলে, বলিতে ভুলিও না।

 পর দিন প্রত্যূষে, সারসী আহারের অন্বেষণে বহির্গত হইলে, ক্ষেত্রস্বামী তথায় উপস্থিত হইল; দেখিল, কেহই শস্য কাটিতে আইসে নাই; আর শস্য সকল অধিক পাকিয়াছিল, এজন্য ঝরিয়া ভূমিতে পড়িতেছে। তখন সে, বিরক্ত হইয়া আপন পুত্রকে কহিল, দেখ, আর প্রতিবেশীর, অথবা ভাই বন্ধুর, মুখ চাহিয়া থাকা উচিত নহে। আজ রাত্রিতে তুমি, যত জন পাও, ঠিকা লোক স্থির করিয়া রাখ। কাল সকালে, তাহাদিগকে লইয়া, আপনারাই কাটিতে আরম্ভ করিব; নতুবা বিস্তর ক্ষতি হইবেক।

 সারসী, বাসায় আসিয়া, এই সমস্ত কথা শুনিয়া কহিল, অতঃপর, এখানে আর থাকা হয় না। এখন, অন্যত্র যাওয়া কর্ত্তব্য। যখন কেহ, অন্যের উপর ভার দিয়া নিশ্চিন্ত না থাকিয়া, স্বয়ং আপন কর্ম্মে মন দেয়, তখন ইহা স্থির বটে যে, সে যথার্থই সে কর্ম্ম সম্পন্ন করা মনস্থ করিয়াছে।