কথা (১৯১২)/বিবাহ
বিবাহ
(রাজস্থান )
প্রহরখানেক রাত হয়েছে শুধু,
ঘন ঘন বেজে ওঠে শাঁখ।
বর-কন্যা যেন ছবির মত
আঁচল বাঁধা দাঁড়িয়ে আঁখি-নত,
জানলা খুলে পুরাঙ্গনা যত
দেখচে চেয়ে ঘােমটা করি ফাঁক।
বর্ষারাতে মেঘের গুরু গুরু
তারি সঙ্গে বাজে বিয়ের শাঁখ।
ঈশান কোনে থম্কে আছে হাওয়া,
মেঘে মেঘে আকাশ আছে যেরি।
সভাকক্ষে হাজার দীপালােকে
মণিমালায় ঝিলিক্ হানে চোখে;
সভার মাঝে হঠাৎ এল ও কে!
বাহির দ্বারে বেজে উঠল ভেরী।
চমকে ওঠে সভার যত লােকে,
উঠে দাঁড়ায় বর-কনেরে ঘেরি।
টোপর পরা মেত্রি-রাজকুমারে
কহে তখন মাড়ােয়ারের দূত-
“যুদ্ধ বাধে বিদ্রোহীদের সনে,
রাম সিংহ রাণা চলেন রণে,
তােমরা এস তাঁরি নিমন্ত্রণে
যে যে আছ মর্ত্তিয়া রাজপুত।”
জয় রাণ। রামসিঙের জয়-
গর্জ্জি উঠে মাড়ােয়ায়ের দূত।
জয় রাণা রামসিঙের জয়-
মেত্রিপতি উৰ্দ্ধস্বরে কয়।
কনের বক্ষ কেঁপে ওঠে ডরে,
দুটি চক্ষু ছল-ছল করে,
বরযাত্রী হাঁকে সমস্বরে
জয়রে রাণা রামসিঙের জয়।
“সময় নাহি মেত্রি রাজকুমার”
মহারাণার দূত উচ্চে কয়।
বৃথা কেন উঠে হুলুধ্বনি
বৃথা কেন বেজে ওঠে শাঁখ।
বাঁধা আচল খুলে ফেলে বর,
মুখের পানে চাহে পরম্পর,
কহে -“প্রিয়ে নিলেম অবসর,
এসেছে ঐ মৃত্যুসভার ডাক।”
বৃথা এখন ওঠে হুলুধ্বনি,
বৃথা এখন বেজে ওঠে শাঁখ।
বরের বেশে টোপর পরি শিরে
ঘােড়ায় চড়ি ছুটে রাজকুমার।
মলিনমুখে নম্র নতশিরে
কন্যা গেল অন্তঃপুরে ফিরে,
হাজার বাতি নিবল ধীরে ধীরে
রাজার সভা হল অন্ধকার।
গলায় মালা টোপর-পরা শিরে
ঘােড়ায় চড়ি ছুটে রাজকুমার।
মাতা কেঁদে কহেন—বধূ-বেশ
খুলিয়া ফেল্ হায় রে হতভাগী!
শান্তভাষে কন্যা কহে মায়ে-
কেঁদনা মা ধরি তােমার পায়ে!
বধূসজ্জা থাক্ মা আমার গায়ে
মেত্রি-পুরে যাইব তাঁর লাগি।
শুনে মাতা কপালে কর হানি
কেঁদে কহেন—হায় রে হতভাগী!
গ্রহবিপ্র আশীর্ব্বাদ করি
ধানদূর্ব্বা দিল তাহার মাথে।
চড়ে কন্যা চতুর্দ্দোলা পরে,
পুরনারী হুলুধ্বনি করে,
রঙীন বেশে কিঙ্করী কিঙ্করে
সারি সারি চলে বালার সাথে।
মাতা আসি চুমো খেলেন মুখে,
পিতা আসি হস্ত দিলেন মাথে।
নিশীথ রাতে আকাশ আলাে করি
কে এল রে মেত্রিপুর দ্বারে।
“থামাও বাঁশি” কহে “থামাও বাঁশি-
চতুর্দ্দোলা নামাও রে দাস দাসী,
মিলেছি আজ মেত্রি-পুরবাসী
মেত্রিপতির চিতা রচিবারে।
মেত্রিরাজা যুদ্ধে হত আজি
দুঃসময়ে কারা এলে দ্বারে!”
"বাজাও বাঁশি ওরে বাজাও বাঁশি"
চতুর্দ্দোলা হতে বধূ বলে।
এবার লগ্ন নাহি হবে পার,
আঁচলের গাঁঠ খুলবে নাক আর,
শেষমন্ত্র পড়িব এইবার
শ্মশান সভায় দীপ্ত চিতানলে।
বাজাও বাঁশি ওরে বাজাও বাঁশি
চতুর্দ্দোলা হতে বধু বলে।
বরের বেশে মােতির মালা গলে
মেত্রিপতি চিতার পরে শুয়ে।
দোলা হতে নামল আসি নারী,
আঁচল বাঁধি’ রক্তবাসে তাঁরি
শিয়র পরে বৈসে রাজকুমারী
বরের মাথা কোলের পরে থুয়ে।
নিশীথ রাতে বরসজ্জা পরা
মেত্রিপতি চিতার পরে শুয়ে।
ঘন ঘন করি হুলুধ্বনি
দলে দলে আসে পুরাঙ্গনা।
পুরুত কহে- ধন্য সুচরিতা,
গাহিছে ভাট—ধন্য মৃত্যুজিতা,—
ধূধূ করে জ্বলে উঠল চিতা,—
কন্যা বসে আছেন যোগাসনা।
জয়ধ্বনি উঠে শ্মশান মাঝে,
হুলুধ্বনি করে পুরাঙ্গনা।