হােরিখেলা



(রাজস্থান)



পত্র দিল পাঠান কেসর খাঁরে
 কেতুন হতে ভুনাগ রাজার রাণী,—
লড়াই করি আশ মিটেছে মিঞা?
বসন্ত যায় চোখের উপর দিয়া,
এস তােমার পাঠান সৈন্য নিয়া
 হােরি খেলব আমরা রাজপুতানী।
যুদ্ধে হারি কোটা সহর ছাড়ি
 কেতু হতে পত্র দিল রাণী।

পত্র পড়ি কেসর উঠে হাসি,
 মনের সুখে গোঁফে দিল চাড়া।
রঙীন্ দেখে পাগড়ি পরে মাথে,
সুম্মা আঁকি দিল আঁখির পাতে,
গন্ধভরা রুমাল নিল হাতে
 সহস্রবার দাড়ি দিল ঝাড়া।
পাঠান সাথে হােরি খেলবে রাণী
 কেসর হাসি গোঁফে দিল চাড়া।

ফাগুন মাসে দখিন হতে হাওয়া
 বকুলবনে মাতাল হয়ে এল।

বােল ধরেছে আম্র বনে বনে,
ভ্রমরগুলো কে কার কথা শােনে,
গুনগুনিয়ে আপন মনে মনে
 ঘুরে ঘুরে বেড়ায় এলােমেলো।
কেতুন পুরে দলে দলে আজি
 পাঠান সেনা হেরি খেলতে এল।

কেতুনপুরে রাজার উপবনে
 তখন সবে ঝিকিমিকি বেলা।
পাঠানেরা দাঁড়ায় বনে আসি,
মূলতানেতে তান ধরেছে বাঁশি,
এল তখন একশো রাণীর দাসী
 রাজপুতানী করতে হােরি-খেলা।
রবি তখন রক্তরাগে রাঙা,
 সবে তখন ঝিকিমিকি বেলা।

পায়ে পায়ে ঘাগরা উঠে দুলে
 ওড়না ওড়ে দক্ষিণে বাতাসে।
ডাহিন্ হাতে বহে ফাগের থারি,
নীবিবন্ধে ঝুলিছে পিচকারী,
বামহস্তে গুলাব, ভরা ঝারী।
 সারি সারি রাজপুতানী আসে।
পায়ে পায়ে ঘাগরা উঠে দুলে,
 ওড়না ওড়ে দক্ষিণে বাতাসে।

আঁখির ঠারে চতুর হাসি হেসে-
 কেসর তবে কহে কাছে আসি,—
বেঁচে এলেম অনেক যুদ্ধ করি’-
আজকে বুঝি জানে-প্রাণে মরি!-
শুনে রাজার শতেক সহচরী
 হঠাৎ সবে উঠল অট্ট হাসি।
রাঙা পাগড়ি হেলিয়ে কেসর খ।
 রঙ্গভরে সেলাম করে আসি।

সুরু হল হােরির মাতামাতি,
 উড়তেছে ফাগ, রাঙা সন্ধ্যাকাশে।
নব-বরণ ধরল বকুল ফুলে,
রক্তরেণু ঝরল তরুমূলে,
ভয়ে পাখী কূজন গেল ভুলে
 রাজপুতানীর উচ্চ উপহাসে।
কোথা হতে রাঙা কুজ্ঝটিকা
 লাগল যেন রাঙা সন্ধ্যাকাশে।

চোখে কেন লাগচে নাকো নেশা?—
 মনে মনে ভাবচে কেসর খা।
বক্ষ কেন উঠচে নাকো দুলি?
নারীর পায়ে বাঁকা নূপুরগুলি
কেমন যেন বলচে বেসুর বুলি,
 তেমন করে কাঁকন বাজচে না।

চোখে কেন লাগচে নাকো নেশা?
 মনে মনে ভাবচে কেসর খাঁ।

পাঠান কহে-রাজপুতানীর দেহে
 কোথাও কিছু নাই কি কোমলতা?
বাহু যুগল নয় মৃণালের মত,
কণ্ঠস্বরে বজ্র লজ্জাহত,
বড় কঠিন শুষ্ক স্বাধীন যত
 মঞ্জরীহীন মরুভূমির লতা।
পাঠান ভাবে দেহে কিম্বা মনে
 রাজপুতানীর নাইক কোমলতা।

তান ধরিয়া ইমন ভূপালিতে
 বাঁশি বেজে উঠল দ্রুত তালে।
কুণ্ডলেতে দোলে মুক্তামালা,
কঠিন হাতে মােটা সােনার বালা,
দাসীর হাতে দিয়ে ফাগের থালা
 রাণী বনে এলেন হেনকালে।
তান ধরিয়া ইমন্ ভূপালিতে
 বাঁশি তখন বাজচে দ্রুত তালে।

কেসর কহে—তােমারি পথ চেয়ে
 দুটি চক্ষু করেছি প্রায় কানা।—
রাণী কহে—আমারো সেই দশা!-

একশো সখী হাসিয়া বিবশা-,
পাঠানপতির ললাটে সহসা
 মারেন রাণী কঁসার থালাখানা।
রক্তধারা গড়িয়ে পড়ে বেগে।
 পাঠান পতির চক্ষু হল কানা।

বিনা মেঘে বজ্ররবের মত
 উঠল বেজে কাড়া নাকাড়া।
জ্যোৎস্নাকাশে চমকে ওঠে শশি,
ঝনঝনিয়ে ঝিকিয়ে ওঠে অসি,
সানাই তখন দ্বারের কাছে বসি
 গভীর সুরে ধরল কানাড়া।
কুঞ্জবনের তরু তলে তলে
 উঠল বেজে কাড়া-নাকাড়া।

বাতাস বেয়ে ওড়না গেল উড়ে,
 পড়ল খসে ঘাগরা ছিল যত।
মন্ত্রে যেন কোথা হতে কেরে
বাহির হল নারী-সজ্জা ছেড়ে,
এক শত বীর ঘিরল পাঠানেরে
 পুষ্প হতে একশো সাপের মত।
স্বপ্ন সম ওড়না গেল উড়ে,
 পড়ল খসে ঘাগরা ছিল যত।

যে পথ দিয়ে পাঠান এসেছিল
 সে পথ দিয়ে ফিরল নাকো তারা।
ফাগুন রাতে কুঞ্জ বিতানে
মত্ত কোকিল বিরাম না জানে,
কেতুনপুরে বকুল বাগানে
 কেসর খাঁয়ের খেলা হল সারা।
যে পথ দিয়ে পাঠান এসেছিল
 সে পথ দিয়ে ফিরল নাকো তারা।

৯ই কার্তিক, ১৩০৬