কপালকুণ্ডলা (১৮৭০)/চতুর্থ খণ্ড/দশম পরিচ্ছেদ

দশম পরিচ্ছেদ।

প্রেতভূমে।

বপুষা করণোজ্ঝিতেন সা নিপতন্তী পতিমপ্যপাতয়ৎ।
ননু তৈলনিষেকবিন্দুনা সহ দীপ্তাৰ্চ্চিৰুপৈতি মেদিনীম্॥

রঘুবংশ।

চন্দ্রমা অস্তমিত হইল। বিশ্বমণ্ডল অন্ধকারে পরিপূর্ণ হইল। কাপালিক যথায় আপন পূজা স্থান সংস্থাপন করিয়াছিলেন তথায় কপালকুণ্ডলাকে লইয়া গেলেন। সে গঙ্গাতীরে এক বৃহৎ সৈকতভূমি। তাহারই সম্মুখে আরও বৃহত্তর দ্বিতীয় এক খণ্ড সিকতাময় স্থান। সেই সৈকতে শ্মশানভূমি। উভয় সৈকত মধ্যে জলোচ্ছ্বাস কালে অল্প জল থাকে, ভাঁটার সময়ে জল থাকে না। এক্ষণে জল ছিল না। শ্মশানভূমির যে মুখ গঙ্গাসম্মুখীন, সেই মুখ অত্যুচ্চ, জলে অবতরণ করিতে গেলে একেবারে উচ্চ হইতে অগাধ জলে পড়িতে হয়। তাহাতে আবার অবিরতবায়ুতাড়িত তরঙ্গাভিঘাতে উপকূলতল ক্ষয়িত হইয়াছিল; কখন কখন মৃত্তিকাখণ্ড স্থানচ্যুত হইয়া অগাধ জলে পড়িয়া যাইত। পূজাস্থানে দীপ নাই—কাষ্ঠখণ্ড মাত্রে অগ্নি জ্বলিতেছিল, তদালোকে অতি অস্পষ্টদৃষ্ট শ্মশানভূমি আরও ভীষণ দেখাইতেছিল। নিকটে পূজা হোম বলি প্রভৃতির সমগ্র আয়োজন ছিল। বিশাল তরঙ্গিণী হৃদয় অন্ধকারে বিস্তৃত হইয়া রহিয়াছে। চৈত্র মাসের বায়ু অপ্রতিহত বেগে গঙ্গাহৃদয়ে প্রধাবিত হইতেছিল; তাহার কারণে তরঙ্গাভিঘাতজনিত কলকল রব গগন ব্যাপ্ত করিতেছিল। শ্মশানভূমিতে শবভুক্ পশুগণ কর্কশ কণ্ঠে ক্বচিৎ ধ্বনি করিতেছিল। কপালকুণ্ডলা মানস চক্ষে সেই প্রেতভূমিতে কত প্রেতিনীকে নরদেহ চর্ব্বণ করিতে দেখিতে লাগিলেন; কত পিশাচীকে কর্দ্দমোপরে সশব্দে নাচিয়া বেড়াইতে শুনিতে লাগিলেন।

 কাপালিক উভয়কে উপযুক্ত স্থানে কুশাসনে উপবেশন করাইয়া তন্ত্রাদির বিধানানুসারে পূজারম্ভ করিলেন। উপযুক্ত সময়ে নবকুমারের প্রতি আদেশ করিলেন যে কপালকুণ্ডলাকে স্নাত করিয়া আন। নবকুমার কপালকুণ্ডলার হস্ত ধারণ করিয়া শ্মশানভূমির উপর দিয়া স্নান করাইতে লইয়া চলিলেন। তাঁহাদিগের চরণে অস্থি ফুটিতে লাগিল। নবকুমারের জানুর আঘাতে একটা জলপূর্ণ শ্মশানকলস ভগ্ন হইয়া গেল। তাহার নিকটেই শব পড়িয়াছিল—হতভাগার কেহ সৎকারও করে নাই। দুই জনেরই তাহাতে পদ স্পর্শ হইল। কপালকুণ্ডলা তাহাকে বেড়িয়া গেলেন, নবকুমার তাহাকে চরণে দলিত করিয়া গেলেন। চতুর্দ্দিক্ বেড়িয়া শবমাংশভুক্ পশু সকল ফিরিতেছিল; মনুষ্য দুই জনের আগমনে উচ্চকণ্ঠে রব করিতে লাগিল, কেহ আক্রমণ করিতে আসিল, কেহ বা পদশব্দ করিয়া চলিয়া গেল। কপালকুণ্ডলা দেখিলেন নবকুমারের হস্ত কাঁপিতেছে; কপালকুণ্ডলা স্বয়ং নির্ভীত, নিষ্কম্প।

 কপালকুণ্ডলা জিজ্ঞাসা করিলেন, “স্বামিন্! ভয় পাইতেছ?”

 নবকুমারের মদিরার মোহ ক্রমে শক্তিহীন হইয়া আসিতেছিল। অতি গম্ভীর স্বরে নবকুমার উত্তর করিলেন,

 “ভয়ে, মৃণ্ময়ি? তাহা নহে।”

 কপালকুণ্ডলা জিজ্ঞাসা করিলেন, “তবে কাঁপিতেছ কেন?”

 এই প্রশ্ন কপালকুণ্ডলা যে স্বরে করিলেন, তাহা কেবল রমণীকণ্ঠেই সম্ভবে। যখন রমণী পরদুঃখে গলিয়া যায় কেবল তখনই রমণীকণ্ঠে সে স্বর সম্ভবে। কে জানিত যে আসন্ন কালে শ্মশানে আসিয়া কপালকুণ্ডলার কণ্ঠ হইতে এ স্বর নির্গত হইবে?

 নবকুমার কহিলেন, “ভয় নহে। কাঁদিতে পারিতেছি না, এই ক্রোধে কাঁপিতেছি।”

 কপালকুণ্ডলা জিজ্ঞাসিলেন “কাঁদিবে কেন?”

 আবার সেই কণ্ঠ!

 নবকুমার কহিলেন, “কাঁদিব কেন? তুমি কি জানিবে মৃণ্ময়ি! তুমিত কখন রূপ দেখিয়া উন্নত হও নাই—” বলিতে বলিতে নবকুমারের কণ্ঠস্বর যাতনায় ৰুদ্ধ হইয়া আসিতে লাগিল। “তুমিত কখন আপনার হৃৎপিণ্ড আপনি ছেদন করিয়া শ্মশানে ফেলিতে আইস নাই।” এই বলিয়া সহসা নবকুমার চীৎকার করিয়া রোদন করিতে করিতে কপালকুণ্ডলার পদতলে আছাড়িয়া পড়িলেন।

 “মৃণ্ময়ি!—কপালকুণ্ডলে! আমায় রক্ষা কর। এই তোমার পায়ে লুটাইতেছি—একবার বল যে তুমি অবিশ্বাসিনী নও—একবার বল, আমি তোমায় হৃদয়ে তুলিয়া গৃহে লইয়া যাই।”

 কপালকুণ্ডলা হাত ধরিয়া নবকুমারকে উঠাইলেন—মৃদু স্বরে কহিলেন, “তুমিত জিজ্ঞাসা কর নাই।”

 যখন এই কথা হইল তখন উভয়ে একেবারে জলের ধারে আসিয়া দাঁড়াইয়াছিলেন; কপালকুণ্ডলা অগ্রে, নদীর দিকে পশ্চাৎ করিয়াছিলেন; তাঁহার পশ্চাতে এক পদ পরেই জল। এখন জলোচ্ছ্বাস আরম্ভ হইয়াছিল, কপালকুণ্ডলা একটা আড়রির উপর দাঁড়াইয়াছিলেন। তিনি উত্তর করিলেন “তুমি ত জিজ্ঞাসা কর নাই।”

 নবকুমার ক্ষিপ্তের ন্যায় কহিলেন, “চৈতন্য হারাইয়াছি, কি জিজ্ঞাসা করিব—বল—মৃণ্ময়ি! বল—বল—বল—আমায় রাখ।—গৃহে চল।”

 কপালকুণ্ডলা কহিলেন, “যাহা জিজ্ঞাসা করিলে বলিব। আজি যাহাকে দেখিয়াছ—সে পদ্মাবতী। আমি অবিশ্বাসিনী নহি। এ কথা স্বরূপ বলিলাম। কিন্তু আর আমি গৃহে যাব না। ভবানীর চরণে দেহ বিসর্জ্জন করিতে আসিয়াছি—নিশ্চিত তাহা করিব। স্বামিন্! তুমি গৃহে যাও! আমি মরিব! আমার জন্য রোদন করিও না।”

 “না—মৃণ্ময়ি—না!” এই রূপ উচ্চ শব্দ করিয়া নবকুমার কপালকুণ্ডলাকে হৃদয়ে ধারণ করিতে বাহু প্রসারণ করিলেন। কপালকুণ্ডলাকে আর পাইলেন না। চৈত্রবায়ুতাড়িত এক বিশাল নদীতরঙ্গ আসিয়া তীরে যথায় কপালকুণ্ডলা দাঁড়াইয়া, তথায় তটাধোভাগে প্রহত হইল; অমনি তটমৃত্তিকাখণ্ড কপালকুণ্ডলা সহিত ঘোর রবে নদীপ্রবাহ মধ্যে ভগ্ন হইয়া পড়িল।

 নবকুমার তীরভঙ্গের শব্দ শুনিলেন, কপালকুণ্ডলা অন্তর্হিত হইল দেখিলেন। অমনি তৎপশ্চাৎ লম্ফ দিয়া জলে পড়িলেন। নবকুমার সন্তরণে নিতান্ত অক্ষম ছিলেন না। কিছু ক্ষণে সাঁতার দিয়া কপালকুণ্ডলার অন্বেষণ করিতে লাগিলেন। তাঁহাকে পাইলেন না। তিনিও উঠিলেন না।

 কাপালিক আসনে বসিয়া দেখিলেন ইহাদের প্রত্যাগমনের সময় অতীত হইয়া গিয়াছে। তাঁহারা বাটী প্রত্যাগমন করিলেন, কি কি, এই আশঙ্কায় কাপালিক আসন ত্যাগ করিয়া শ্মশানভূমির উপর দিয়া কূলে গমন করিলেন। কাহাকেও দেখিতে পাইলেন না। ক্ষণেক পরে জলমধ্যে কোন পদার্থ ভাসিয়া ডুবিল দেখিলেন—বোধ হইল যেন মনুষ্যহস্ত। লম্ফ দিয়া বহুকষ্টে দৃষ্ট পদার্থ কূলে তুলিলেন। দেখিলেন এ নবকুমারের প্রায় অচৈতন্য দেহ। অনুভবে বুঝিলেন কপালকুণ্ডলাও জলমগ্না আছেন। পুনরপি অবতরণ করিয়া তাঁহার অনুসন্ধান করিলেন, কিন্তু তাঁহাকে পাইলেন না।

 তীরে পুনরারোহণ করিয়া কাপালিক নবকুমারের চৈতন্যবিধানের উদ্যোগ করিতে লাগিলেন। নবকুমারের সংজ্ঞালাভ হইবামাত্র, নিশ্বাস সহকারে বাক্যস্ফূর্ত্তি হইল। সে বাক্য কেবল “মৃণ্ময়ি! মৃণ্ময়ি!”

 কপালিক জিজ্ঞাসা করিলেন “মৃণ্ময়ী কোথায়?” নবকুমার উত্তর করিলেন, “মৃণ্ময়ি—মৃণ্ময়ি—মৃণ্ময়ি!”


চতুর্থঃ খণ্ডঃ সমাপ্তঃ।