কপালকুণ্ডলা (১৮৭০)/চতুর্থ খণ্ড/নবম পরিচ্ছেদ
নবম পরিচ্ছেদ।
গৃহাভিমুখে।
"No spectre greets me—no vain shadow this."
কপালকুণ্ডলা ধীরে ধীরে গৃহাভিমুখে চলিলেন। অতি ধীরে ধীরে, অতি মৃদু মৃদু চলিলেন। তাহার কারণ তিনি অতি গভীর চিন্তামগ্ন হইয়া যাইতে ছিলে লুৎফ্-উন্নিসার সম্বাদে কপালকুণ্ডলার একেবারে চিত্তভাব পরিবর্ত্তিত হইল; তিনি আত্মবিসর্জ্জনে প্রস্তুত হইলেন। আত্মবিসর্জ্জন কিজন্য? লুৎফ্-উন্নিসার জন্য? তাহা নহে।
কপালকুণ্ডলা অন্তঃকরণ সম্বন্ধে তান্ত্রিকের সন্তান; তান্ত্রিক যেরূপ কালিকাপ্রসাদাকাঙ্ক্ষায় পরপ্রাণ সংহারে সঙ্কোচশূন্য—কপালকুণ্ডলা সেই আকাঙ্ক্ষায় আত্মজীবন বিসর্জ্জনে তদ্রূপ। কপালকুণ্ডলা যে কাপালিকের ন্যায় অনন্যচিত্ত হইয়া শক্তিপ্রসাদ প্রার্থিনী হইয়াছিলেন তাহা নহে, তথাপি অহর্নিশ শক্তিভক্তি শ্রবণ দর্শন ও সাধনে কালিকানুরাগ বিশিষ্ট প্রকারে জন্মিয়াছিল, ভৈরবী যে সৃষ্টি শাসনকর্ত্রী, মুক্তিদাত্রী ইহা বিশেষ মতে প্রতীত হইয়াছিল। কালিকার পূজাভূমি যে নরশোণিতে প্লাবিত হয় ইহা তাঁহার পরদুঃখদুঃখিত হৃদয়ে সহিত না, কিন্তু আর কোন কার্য্যে ভক্তিপ্রদর্শনের ত্রুটি ছিল না। এখন সেই জগৎশাসনকর্ত্রী, সুখদুঃখবিধায়িনী কৈবল্যদায়িনী ভৈরবী স্বপ্নে তাঁহার জীবন সমর্পণ আদেশ করিয়াছেন। কেনই বা কপালকুণ্ডলা সে আদেশ পালন না করিবেন?
তুমি আমি প্রাণ ত্যাগ করিতে চাহি না। রাগ করিয়া যাহা বলি, এ সংসার সুখময়। সুখের প্রত্যাশাতেই বর্ত্তুলবৎ সংসার মধ্যে ঘুরিতেছি—দুঃখের প্রত্যাশায় নহে। কদাচিৎ যদি আত্মকর্ম্মদোষে সেই প্রত্যাশা সফলীকৃত না হয়, তবেই দুঃখ বলিয়া উচ্চ কলরব আরম্ভ করি। তাহা হইলেই দুঃখ নিয়ম নহে সিদ্ধান্ত হইল; নিয়মের ব্যতিক্রম মাত্র। তোমার আমার সর্ব্বত্র সুখ। সেই সুখে আমরা সংসার মধ্যে বদ্ধমূল; ছাড়িতে চাহি না। কিন্তু এ সংসারবন্ধনে প্রণয় প্রধান রজ্জু। কপালকুণ্ডলার সে বন্ধন ছিল না—কোন বন্ধনই ছিল না। তবে কপালকুণ্ডলাকে কে রাখে?
যাহার বন্ধন নাই; তাহারই অপ্রতিহত বেগ। গিরিশিখর হইতে নির্ঝরিণী নামিলে কে তাহার গতিরোধ করে? এক বার বায়ু তাড়িত হইলে কে তাহার সঞ্চারণ নিবারণ করে? কপালকুণ্ডলার চিত্ত চঞ্চল হইলে কে তাহার স্থিতিস্থাপন করিবে? নবীন করিকরভ মাতিলে কে তাহাকে শান্ত করিবে?
কপালকুণ্ডলা আপন চিত্তকে জিজ্ঞাসা করিলেন “কেনই বা এ শরীর জগদীশ্বরীর চরণে সমর্পণ না করিব? পঞ্চ ভূত লইয়া কি হইবে?” প্রশ্ন করিতেছিলেন অথচ কোন নিশ্চিত উত্তর দিতে পারিতেছিলেন না। সংসারের অন্য কোন বন্ধন না থাকিলেও পঞ্চ ভূতের এক বন্ধন আছে।
কপালকুণ্ডলা অধোবদনে চলিতে লাগিলেন। যখন মনুষ্যহৃদয় কোন উৎকট ভাবে আচ্ছন্ন হয়, চিন্তার একাগ্রতায় বাহ্যসৃষ্টির প্রতি লক্ষ্য থাকে না, তখন অনৈসর্গিক পদার্থও প্রত্যক্ষীভূত বলিয়া বোধ হয়। কপালকুণ্ডলার সেই অবস্থা হইয়াছিল। যেন ঊর্দ্ধ হইতে তাঁহার কর্ণকুহরে এই শব্দ প্রবেশ করিল, “বৎসে—আমি পথ দেখাইতেছি।” কপালকুণ্ডলা চকিতের ন্যায় ঊর্দ্ধদৃষ্টি করিলেন। দেখিলেন যেন আকাশমণ্ডলে নবনীরদনিন্দিত মূর্ত্তি! গলবিলম্বিতনরকপালমালা হইতে শোণিতশ্রুতি হইতেছে; কটিমণ্ডল বেড়িয়া নরকররাজি দুলিতেছে—বাম করে নরকপাল—অঙ্গে ৰুধির ধারা, ললাটে বিষমোজ্জ্বলজ্বালাবিভাসিত লোচন প্রান্তে বালশশী সুশোভিত! যেন ভৈরবী দক্ষিণ হস্ত উত্তোলন করিয়া কপালকুণ্ডলাকে ডাকিতেছেন।
কপালকুণ্ডলা ঊর্দ্ধমুখী হইয়া চলিলেন। সেই নবকাদম্বিনীসন্নিভ রূপ আকাশমার্গে তাঁহার আগে আগে চলিল। কখন কপালমালিনীর অবয়ব মেঘে লুক্কায়িত হয়, কখন নয়নপথে স্পষ্ট বিকশিত হয়। কপালকুণ্ডলা তাঁহার প্রতি চাহিয়া চলিলেন।
নবকুমার বা কাপালিক এ সব কিছুই দেখে নাই। নবকুমার সুরাগরলপ্রজ্বলিতহৃদয়—কপালকুণ্ডলার ধীর পদক্ষেপ অসহিষ্ণু হইয়া সঙ্গীকে কহিলেন,
“কাপালিক!”
কাপালিক কহিল “কি?”
“পানীয়ং দেহি মে”
কাপালিক পুনরপি তাঁহাকে সুরা পান করাইল।
নবকুমার কহিলেন, “আর বিলম্ব কি?”
কাপালিক উত্তর করিল “আর বিলম্ব কি!”
নবকুমার ভীমনাদে ডাকিলেন “কপালকুণ্ডলে!”
কপালকুণ্ডলা শুনিয়া চমকিতা হইলেন। ইদানীন্তন কেহ তাঁহাকে কপালকুণ্ডলা বলিয়া ডাকিত না। তিনি মুখ ফিরাইয়া দাঁড়াইলেন। নবকুমার ও কাপালিক তাঁহার সম্মুখে আসিলেন। কপালকুণ্ডলা প্রথমে তাঁহাদিগকে চিনিতে পারিলেন না—কহিলেন,
“তোমরা কে? যমদূত?
পরক্ষণেই চিনিতে পারিয়া কহিলেন, “না না পিতঃ, তুমি কি আমায় বলি দিতে আসিয়াছ?”
নবকুমার দৃঢ়মুষ্টিতে কপালকুণ্ডলার হস্ত ধারণ করিলেন। কাপালিক কৰুণাদ্র, মধুময় স্বরে কহিলেন,
“বংসে! আমাদিগের সঙ্গে আইস।” এই বলিয়া কাপালিক শ্মশানাভিমুখে পথ দেখাইয়া চলিলেন।
কপালকুণ্ডলা আকাশে দৃষ্টি নিক্ষেপ করিলেন; যথায় গগনবিহারিণী ভয়ঙ্করী দেখিয়াছিলেন, সেই দিকে চাহিলেন, দেখিলেন রণরঙ্গিণী খল খল হাসিতেছে; এক দীর্ঘ ত্রিশূল করে ধরিয়া কাপালিকগতপথ প্রতি সঙ্কেত করিতেছে। কপালকুণ্ডলা ভবিতব্যবিমূঢ়ার ন্যায় বিনা বাক্যব্যয়ে কাপালিকের অনুসরণ করিলেন। নবকুমার পূর্ব্ববৎ দৃঢ়মুষ্টিতে তাঁহার হস্ত ধারণ করিয়া চলিলেন।