কপালকুণ্ডলা (১৮৭০)/চতুর্থ খণ্ড/প্রথম পরিচ্ছেদ
কপালকুণ্ডলা।
চতুর্থ খণ্ড।
প্রথম পরিচ্ছেদ।
গ্রন্থ খণ্ডারম্ভে।
“Real Fatalism is of two kinds. Pure or Asiatic Fatalism, the Fatalism of Œdipus, holds that our actions do not depend upon our desires. Whatever our wishes may be, a superior power, or an abstract Destiny, will overrule them, and compel us to act, not as we desire, but in the manner pre-destined. The other kind, modified Fatalism I will call it, holds that our actions are determined by our will, our will by our desires, and our desires by the joint influence of the motives presented to us and of our individual character."
এত দূরে এ আখ্যায়িকা হৃদয়ঙ্গামিত্ব প্রাপ্ত হইল। চিত্রকর চিত্রপুত্তলী লিখিতে অগ্রে পাদাদির রেখানিচয় পৃথক্ পৃথক্ করিয়া অঙ্কিত করে, শেষে তৎসমুদয় পরস্পর সংলগ্ন করিয়া ছায়ালোকভিন্নতা লিখে। আমরা এ পর্য্যন্ত এই মানসচিত্রের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ পৃথক্ পৃথক্ রেখাঙ্কিত করিয়াছি; এক্ষণে তৎসমুদায় পরস্পর সংলগ্ন করিয়া তাহার ছায়ালোক সন্নিবেশ করিব।
রবিকরাকৃষ্ট বারিবাষ্পে মেঘের জন্ম। দিন দিন, তিল তিল করিয়া, মেঘ সঞ্চারের আয়োজন হইতে থাকে তখন মেঘ কাহারও লক্ষ্য হয় না; কেহ মেঘ মনে করে না; শেষে অকস্মাৎ একেবারে পৃথিবী ছায়ান্ধকারময়ী করিয়া বজ্রপাত করে। যে মেঘে অকস্মাৎ কপালকুণ্ডলার জীবনযাত্রা গাহমান হইল, আমরা এত দিন তিল তিল করিয়া তাহার বারিবাষ্প সঞ্চয় করিতেছিলাম।
পাঠক মহাশয় “অদৃষ্ট” স্বীকার করেন? ললাটলিপির কথা বলিতেছি না, সে ত অলস ব্যক্তির আত্মপ্রবোধ জন্য কল্পিত গল্পমাত্র। কিন্তু, কখন কখন যে, কোন ভবিষ্যৎ ঘটনার জন্য পূর্ব্বাবধি এরূপ আয়োজন হইয়া আইসে, তৎসিদ্ধিসূচক কার্য্য সকল এরূপ দুর্দ্দমনীয় বলে সম্পন্ন হয়, যে মানুষিক শক্তি তাহার নিবারণে অসমর্থ হয়, ইহা তিনি স্বীকার করেন কি না? সর্ব্বদেশে সর্ব্বকালে দূরদর্শিগণ কর্ত্তৃক ইহা স্বীকৃত হইয়াছে। এই অদৃষ্ট যুনানী নাটকাবলির প্রাণ, সর্ব্বজ্ঞ সেক্স্পীয়রের মাক্বেথের আধার; ওয়ালটর্ স্কটের “ব্রাইড্ অব্ লেমার মুরে” ইহার ছায়াপাত হইয়াছে; গেটে প্রভৃতি জর্ম্মান কবিগুৰুগণ ইহার স্পষ্টতঃ সমালোচনা করিয়াছেন। রূপান্তরে, “ফেট্” ও “নেসেসিটি” নাম ধারণ করিয়া ইহা ইউরোপীয় দার্শনিকদিগের মধ্যে প্রধান মতভেদের কারণ হইয়াছে।
অস্মদেশে এই “অদৃষ্ট“জনসমাজে বিলক্ষণ পরিচিত। যে করিগুৰু কুৰুকূলসংহার কল্পনা করিয়াছিলেন, তিনি এই মোহমন্ত্রে প্রকৃষ্টরূপে দীক্ষিত; কৌরবপাণ্ডবের বাল্যক্রীড়াবধি এই করালছায়া কুৰুশিরে বিদ্যমান; শ্রীকৃষ্ণ ইহার অবতার স্বরূপ। “যদা শ্রৌষং জাতুষাদেষ্মণস্তান্” ইত্যাদি ধৃতরাষ্ট্রবিলাপে কবি স্বয়ং ইহা প্রাঞ্জলীকৃত করিয়াছেন। দার্শনিকদিগের মধ্যে অদৃষ্টবাদীর অভাব নাই। শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা এই অদৃষ্টবাদে পরিপূর্ণ। অধুনা “ত্বয়া ঋষীকেশ হৃদিস্থিতেন যথা নিযুক্তোস্মি তথা করোমি” ইতি কবিতার্দ্ধ পাঠ করিয়া অনেকে অদৃষ্টের পূজা করেন। অপর সকলে “কপাল!” বলিয়া নিশ্চিন্ত থাকেন।
অদৃষ্টের তাৎপর্য্য যে কোন দৈব বা অনৈসর্গিক শক্তিতে অস্মদাদির কার্য্য সকলকে গতিবিশেষ প্রাপ্ত করায় এমন আমি বলিতেছি না। অনীশ্বরবাদীও অদৃষ্ট স্বীকার করিতে পারেন। সাংসারিক ঘটনাপরম্পরা ভৌতিক নিয়ম ও মনুষ্যচরিত্রের অনিবার্য্য ফল; মনুষ্যচরিত্র মানসিক ও ভৌতিক নিয়মের ফল; সুতরাং অদৃষ্ট মানসিক ও ভৌতিক নিয়মের ফল; কিন্তু সেই সকল নিয়ম মনুষ্যের জ্ঞানাতীত বলিয়া অদৃষ্ট নাম ধারণ করিয়াছে।
কোন কোন পাঠক এ গ্রন্থশেষ পাঠ করিয়া ক্ষুণ্ণ হইতে পারেন। বলিতে পারেন, “এরূপ সমাপ্তি সুখের হইল না; গ্রন্থকার অন্যরূপ করিতে পারিতেন।” ইহার উত্তর, “অদৃষ্টের গতি। অদৃষ্ট কে খণ্ডাইতে পারে? গ্রন্থকারের সাধ্য নহে। গ্রন্থারম্ভে যেখানে যে বীজ বপন হইয়াছে, সেই খানে সেই বীজের ফল ফলিবে। তদ্বিপরীতে সত্যের বিঘ্ন ঘটিবে।”
এক্ষণে আমরা অদৃষ্টগতির অনুগামী হই। সূত্র প্রস্তুত হইয়াছে; গ্রন্থিবন্ধন করি।