কপালকুণ্ডলা (১৮৭০)/তৃতীয় খণ্ড/সপ্তম পরিচ্ছেদ

সপ্তম পরিচ্ছেদ।

উপনগরপ্রান্তে।

——————I am settled, and bend up
Each corporal agent to this terrible feat.

Macbeth.

কক্ষ্যান্তরে গিয়া লুৎফ-উন্নিসা দ্বার ৰুদ্ধ করিলেন। দুই দিন পর্য্যন্ত সেই কক্ষ্যা হইতে নির্গত হইলেন না। এই দুই দিনে তিনি নিজ কর্ত্তব্যাকর্ত্তব্য স্থির করিলেন। স্থির করিয়া দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হইলেন। সূর্য অস্তাচলগামী। তখন লুংফ্-উন্নিসা পেষ্‌মনের সাহায্যে বেশভূষা করিতেছিলেন। আশ্চর্য্য বেশভূষা! পেশওয়াজ নাই—পায়জামা নাই—ওড়না নাই; রমণীবেশের কিছু মাত্র চিহ্ন নাই। যে বেশভূষা করিলেন, তাহা মুকুরে দেখিয়া পেষ্‌মন্‌কে কহিলেন, “কেমন, পেষ্‌মন, আর আমাকে চেনা যায়?”

 পেষ্‌মন কহিল “কার সাধ্য?”

 লু। “তবে আমি চলিলাম। আমার সঙ্গে যেন কোন দাস দাসী না যায়।”

 পেষ্‌মন কিছু শঙ্কুচিতচিত্তে কহিল, “যদি দাসীর অপরাধ ক্ষমা করেন, তবে একটী কথা জিজ্ঞাসা করি।” লুৎফ্-উন্নিসা কহিলেন, “কি?”। পেষ্‌মন কহিল, “আপনার উদ্দেশ্য কি?”

 লুৎফ্-উন্নিসা কহিলেন, “আপাততঃ কপালকুণ্ডলার সহিত স্বামীর চিরবিচ্ছেদ। পরে তিনি আমার হইবেন।”

 পে। “বিবি! ভাল করিয়া বিবেচনা কৰুন; সে নিবিড় বন, রাত্রি আগত; আপনি একাকিনী।”

 লুৎফ্-উন্নিসা এ কথার কোন উত্তর না করিয়া গৃহ হইতে বহির্গতা হইলেন। সপ্তগ্রামের যে জনহীন বনময় উপনগর প্রান্তে নবকুমারের বসতি, সেই দিকে চলিলেন। তৎপ্রদেশে উপনীত হইতে রাত্রি হইয়া আসিল। নবকুমারের বাটীর অনতিদূরে এক নিবিড় বন আছে, পাঠক মহাশয়ের স্মরণ হইতে পারে। তাহারই প্রান্তভাগে উপনীত হইয়া এক বৃক্ষতলে উপবেশন করিলেন। কিছু কাল বসিয়া যে দুঃসাহসিক কার্য্যে প্রবৃত্ত হইয়াছিলেন তদ্বিষয়ে চিন্তা করিতে লাগিলেন। ঘটনাক্রমে তাঁহার অননুভূতপূর্ব্ব সহায় উপস্থিত হইল।

 লুৎফ্-উন্নিসা যথায় বসিয়াছিলেন, তথা হইতে এক অনবরত সমানোচ্চারিত মনুষ্যকণ্ঠনির্গত শব্দ শুনিতে পাইলেন। উঠিয়া দাঁড়াইয়া চারি দিক্ চাহিয়া দেখিলেন যে, বন মধ্যে একটী আলো দেখা যাইতেছে। লুৎফ্-উন্নিসা সাহসে পুৰুষের অধিক, যথায় আলো জ্বলিতেছে সেই স্থানে গেলেন। প্রথমে বৃক্ষান্তরাল হইতে দেখিলেন ব্যাপার কি? দেখিলেন যে, যে আলো জ্বলিতে ছিল, সে হোমের আলো; যে শব্দ শুনিতে পাইয়াছিলেন সে মন্ত্রপাঠের শব্দ। মন্ত্র মধ্যে একটী শব্দ বুঝিতে পারিলেন, সে একটী নাম। নাম শুনিবামাত্র লুৎফ-উন্নিসা হোমকারীর নিকট গিয়া বসিলেন।

 এক্ষণে তিনি তথায় বসিয়া থাকুন, পাঠক মহাশয় বহুকাল কপালকুণ্ডলার কোন সম্বাদ পান নাই, সুতরাং কপালকুণ্ডলার সম্বাদ আবশ্যক হইয়াছে।

তৃতীয়ঃ খণ্ডঃ সমাপ্তঃ।