কপালকুণ্ডলা (১৮৭০)/তৃতীয় খণ্ড/ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ।
চরণ তলে।
কায় মনঃ প্রাণ আমি সঁপিব তোমারে।
ভুঞ্জ আসি রাজভোগ দাসীর আলয়ে॥
ক্ষেত্রে বীজ রোপিত হইলে আপনিই অঙ্কুর হয়। যখন অঙ্কুর হয়, তখন কেহ জানিতে পারে না—কেহ দেখিতে পায় না। কিন্তু একবার বীজ রোপিত হইলে, রোপনকারী যথায় থাকুন না কেন, ক্রমে অঙ্কুর হইতে বৃক্ষ মস্তকোন্নত করিতে থাকে। অন্য বৃক্ষটী অঙ্গুলি পরিমেয় মাত্র, কেহ দেখিয়াও দেখিতে পায় না। ক্রমে তিল তিল বৃদ্ধি। ক্রমে বৃক্ষটী অৰ্দ্ধহস্ত, একহস্ত, দুইহস্ত পরিমাণ হইল; যদি তাহাতে কাহারও স্বার্থসিদ্ধির সম্ভাবনা না রহিল, তবে তথাপি কেহ দেখে না, দেখিয়াও দেখে না। দিন যায়, মাস যায়, বৎসর যায়, ক্রমে তাহার উপর চক্ষু পড়ে। আর অমনোযোগের কথা নাই,—ক্রমে বৃক্ষ বড় হয়, তাহার ছায়ায় অন্য বৃক্ষ নষ্ট করে,—চাহি কি, ক্ষেত্র অনন্যপাদপ হয়।
লুৎফ্-উন্নিসার প্রণয় এরূপ বাড়িয়াছিল। প্রথম এক দিন অকস্মাৎ প্রণয়ভাজনের সহিত সাক্ষাৎ হইল, তখন প্রণয় সঞ্চার বিশেষ জানিতে পারিলেন না। কিন্তু তখনই অঙ্কুর হইয়া রহিল। তাহার পর আর সাক্ষাৎ হইল না। কিন্তু অসাক্ষাতে পুনঃ পুনঃ সেই মুখমণ্ডল মনে পড়িতে লাগিল, স্মৃতিপটে সে মুখমণ্ডল চিত্রিত করা কতক কতক সুখকর বলিয়া বোধ হইতে লাগিল। বীজে অঙ্কুর জন্মিল। মূর্ত্তি প্রতি অনুরাগ জন্মিল। চিত্তের ধর্ম্ম এই যে, যে মানসিক কর্ম্ম যত অধিক বার করা যায়, সে কর্ম্মে তত অধিক প্রবৃত্তি হয়; সে কর্ম্ম ক্রমে স্বভাবসিদ্ধ হয়। লুৎফ-উন্নিসা সেই মূর্ত্তি অহরহ মনে ভাবিতে লাগিলেন। দাৰুণ দর্শনাভিলাষ জন্মিল; সঙ্গে সঙ্গে তাঁহার সহজ স্পৃহাপ্রবাহও দুর্ন্নিবার্য হইয়া উঠিল। দিল্লীর সিংহাসনলালসাও তাহার নিকট লঘু হইল। সিংহাসন যেন মন্মথশরসম্ভূত অগ্নিরাশিবেষ্টিত বোধ হইতে লাগিল। রাজা, রাজধানী, রাজসিংহাসন, সকল বিসর্জ্জন দিয়া প্রিয়জনসন্দর্শনে ধাবিত হইলেন। সে প্রিয়জন নবকুমার।
এই জন্যেই লুৎফ্-উন্নিসা মেহের-উন্নিসার আশানাশক কথা শুনিয়াও অসুখী হয়েন নাই; এই জন্যই আগ্রায় আসিয়া সম্পদ রক্ষায় কোন যত্ন পাইলেন না; এই জন্যই জন্মের মত বাদশাহের নিকট বিদায় লইলেন।
লুৎফ্-উন্নিসা সপ্তগ্রামে আসিলেন। রাজপথের অনতিদূরে নগরীর সর্ব্বমধ্যে এক অট্টালিকায় আপন বাসস্থান করিলেন। রাজপথের পথিকেরা দেখিলেন, অকস্মাৎ এই অট্টালিকা সুবর্ণখচিতবসনভূষিত দাসদাসীতে পরিপূর্ণ হইয়াছে। কক্ষ্যায় কক্ষ্যায় হর্ম্মসজ্জা অতি মনোহর। গন্ধদ্রব্য, গন্ধবারি, কুসুমদাম সর্ব্বত্র আমোদ করিতেছে। স্বর্ণ, রৌপ্য, গজদন্তাদি খচিত গৃহশোভার্থ নানা দ্রব্য সকল স্থানেই আলো করিতেছে। এইরূপ সজ্জীভূত এক কক্ষ্যায় লুৎফ্-উন্নিসা অধোবদনে বসিয়া আছেন; পৃথগাসনে নবকুমার বসিয়া আছেন। সপ্তগ্রামে নবকুমারের সহিত লুৎফ্-উন্নিসার আর দুই এক বার সাক্ষাৎ হইয়াছিল; তাহাতে লুৎফ্-উন্নিসার মনোরথ কতদূর সিদ্ধ হইয়াছিল তাহা অদ্যকার কথায় প্রকাশ হইবে।
নবকুমার কিছু ক্ষণ নীরবে থাকিয়া কহিলেন, “তবে আমি এক্ষণে চলিলাম। তুমি আর আমাকে ডাকিও না।”
লুৎফ্-উন্নিসা কহিল “যাইও না। আর একটু থাক। আমার যাহা বক্তব্য তাহা সমাপ্ত করি নাই।”
নবকুমার আরও ক্ষণেক প্রতীক্ষা করিলেন, কিন্তু লুৎফ্-উন্নিসা কিছু বলিলেন না। ক্ষণেক পরে নবকুমার জিজ্ঞাসা করিলেন, “আর কি বলিবে?” লুৎফ্-উন্নিসা কোন উত্তর করিলেন না—তিনি নীরবে রোদন করিতেছিলেন।
নবকুমার ইহা দেখিয়া গাত্রোত্থান করিলেন; লুৎফ্ উন্নিসা তাঁহার বস্ত্রাগ্র ধৃত করিলেন। নবকুমার ঈষৎ বিরক্ত হইয়া কহিলেন, “কি বল না?”
লুৎফ্-উন্নিসা কহিলেন “তুমি কি চাও? পৃথিবীতে কিছু কি প্রার্থনীয় নাই? ধন, সম্পদ, মান, প্রণয়, রঙ্গ, রহস্য, পৃথিবীতে যাহাকে যাহাকে সুখ বলে, সকলই দিব; কিছুই তাহার প্রতিদান চাহি না; কেবল তোমার দাসী হইতে চাহি। তোমার যে পত্নী হইব, এ গৌরবও চাহি না, কেবল দাসী!”
নবকুমার কহিলেন, “আমি দরিদ্র ব্রহ্মণ, ইহ জন্মে দরিদ্র ব্রাহ্মণই থাকিব। তোমার দত্ত ধন সম্পদ লইয়া যবনীজার হইতে পারিব না।”
যবনীজার? নবকুমার এ পর্য্যন্ত জানিতে পারেন নাই যে, এই রমণী তাঁহার পত্নী। লুৎফ্-উন্নিসা অধোবদনে রহিলেন। নবকুমার তাঁহার হস্ত হইতে বস্ত্রাগ্রভাগ মুক্ত করিলেন। লুৎফ্-উন্নিসা আবার তাঁহার বস্ত্রাগ্র ধরিয়া কহিলেন,
“ভাল, সে যাউক। বিধাতার যদি সেই ইচ্ছা, তবে চিত্তবৃত্তি সকল অতল জলে ডুবাইব। আর কিছু চাহি না, এক এক বার তুমি এই পথে যাইও; দাসী ভাবিয়া এক এক বার দেখা দিও; কেবল চক্ষু পরিতৃপ্ত করিব।”
নব। তুমি যবনী—পরস্ত্রী—তোমার সহিত এরূপ আলাপেও দোষ। তোমার সহিত আর আমার সাক্ষাৎ হইবে না।”
ক্ষণেক নীরব। লুৎফ্-উন্নিসার হৃদয়ে ঝটিকা বহিতে ছিল। প্রস্তরময়ীমূর্ত্তিবৎ নিস্পন্দ রহিলেন। নবকুমারের বস্ত্রাগ্রভাগ ত্যাগ করিলেন। কহিলেন, “যাও।”
নবকুমার চলিলেন। দুই চারি পদ চলিয়াছিলেন মাত্র, সহসা লুৎফ-উন্নিসা বাতোন্মূলিত পাদপের ন্যায় তাঁহার পদতলে পড়িলেন। বাহুলতায় চরণযুগল বদ্ধ করিয়া কাতর স্বরে কহিলেন,
“নির্দ্দয়! আমি তোমার জন্য আগ্রার সিংহাসন ত্যাগ করিয়া আসিয়াছি। তুমি আমায় ত্যাগ করিও না!”
নবকুমার কহিলেন, “তুমি আবার আগ্রাতে ফিরিয়া যাও; আমার আশা ত্যাগ কর।”
“এ জন্মে নহে!” লুতফ্-উন্নিসা তীরবৎ দাঁড়াইয়া উঠিয়া সদর্পে কহিলেন, “এ জন্মে তোমার আশা ছাড়িব না!” মস্তকোন্নত করিয়া, ঈষৎ বঙ্কিম গ্রীবাভঙ্গী করিয়া, নবকুমারের মুখপ্রতি অনিমিক্ আয়ত চক্ষু স্থাপিত করিয়া, রাজরাজমোহিনী দাঁড়াইলেন। যে অনবনমনীয় গর্ব্ব হৃদয়াগ্নিতে গলিয়া গিয়াছিল, আবার তাহার জ্যোতিঃ স্ফুরিল; যে অজেয় মানসিক শক্তি ভারতরাজ্য শাসনকল্পনায় ভীত হয় নাই, সেই শক্তি আবার প্রণয়দুর্ব্বল দেহে সঞ্চারিত হইল। ললাটদেশে ধমনী সকল স্ফীত হইয়া রমণীয় রেখা দিল; জ্যোতির্ম্ময় চক্ষু রবিকরমুখরিত সমুদ্রবারিবৎ ঝলসিতে লাগিল; নাসারন্ধ কাঁপিতে লাগিল। স্রোতোবিহারিণী রাজহংসী যেমন গতিবিরোধির প্রতি গ্রীবাভঙ্গী করিয়া দাঁড়ায়, দলিতফণা ফণিনী যেমন ফণা তুলিয়া দাঁড়ায়, তেমনি উন্মাদিনী যবনী মস্তক তুলিয়া দাঁড়াইলেন। কহিলেন, “এজন্মে না। তুমি আমারই হইবে।”
সেই কুপিতফণিনী মূর্ত্তি প্রতি নিরীক্ষণ করিতে করিতে নবকুমার ভীত হইলেন। লুৎফ্-উন্নিসার অনির্ব্বচনীয় দেহমহিমা এখন যেরূপ দেখিতে পাইলেন, সেরূপ আর কখন দেখেন নাই। কিন্তু সে শ্রী বজ্রসূচক বিদ্যুতের ন্যায় মনোমোহিনী; দেখিয়া ভয় হইল। নবকুমার চলিয়া যান, তখন সহসা তাঁহার আর এক তেজোময়ী মূর্ত্তি মনে পড়িল। এক দিন নবকুমার তাঁহার প্রথমা পত্নী পদ্মাবতীর প্রতি বিরক্ত হইয়া তাঁহাকে শয়নাগার হইতে বহিষ্কৃতা করিতে উদ্যত হইয়াছিলেন। দ্বাদশবর্ষীয়া বালিকা তখন সদর্পে তাঁহার দিকে ফিরিয়া দাঁড়াইয়াছিল; এমনই তাহার চক্ষু প্রদীপ্ত হইয়াছিল; এমনই ললাটে রেখা বিকাশ হইয়াছিল; এমনই নাসারন্ধ্র কাঁপিয়াছিল; এমনই মস্তক হেলিয়াছিল। বহুকাল সে মূর্ত্তি মনে পড়ে নাই, এখন মনে পড়িল। অমনই সাদৃশ্য অনুভূত হইল। সংশয়াধীন হইয়া নবকুমার সঙ্কুচিত স্বরে, ধীরে ধীরে কহিলেন, “তুমি কে?”
যবনীর নয়নতারা আরও বিস্ফারিত হইল। কহিলেন, “আমি পদ্মাবতী।”
উত্তর প্রতীক্ষা না করিয়া লুৎফ-উন্নিসা স্থানান্তরে চলিয়া গেলেন। নবকুমারও অন্যমনে কিছু শঙ্কান্বিত হইয়া, আপন আলয়ে গেলেন।