কপালকুণ্ডলা (১৮৭০)/তৃতীয় খণ্ড/দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ।
পথান্তরে।
“যে মাটীতে পড়ে লোকে উঠে তাই ধরে।
বারেক নিরাশ হয়ে কে কোথায় মরে॥
তুফানে পতিত কিন্তু ছাড়িব না হাল।
আজিকে বিফল হলো, হতে পারে কাল॥”
যে দিন নবকুমারকে বিদায় করিয়া মতি বিবি বা লুৎফ্-উন্নিসা বৰ্দ্ধমানাভিমুখে যাত্রা করিলেন, সে দিন তিনি বর্দ্ধমান পর্যন্ত যাইতে পারিলেন না। অন্য চটীতে রহিলেন। সন্ধ্যার সময়ে পেষ্মনের সহিত একত্রে বসিয়া কথোপকথন হইতেছিল, এমত কালে মতি সহসা পেষ্মনকে জিজ্ঞাসা করিলেন,
“পেষ্মন! আমার স্বামীকে কেমন দেখিলে?”
পেষ্মন্, কিছু বিস্মিত হইয়া কহিল, “কেমন আর দেখিব?” মতি কহিলেন “সুন্দর পুৰুষ বটে কি না?”
নবকুমারের প্রতি পেষ্মনের বিশেষ বিরাগ জন্মিয়াছিল। যে অলঙ্কার গুলিন মতি কপালকুণ্ডলাকে দিয়াছিলেন, তৎপ্রতি পেষ্মনের বিশেষ লোভ ছিল; মনে মনে ভরসা ছিল এক দিন চাহিয়া লইবেন। সেই আশা নির্মূল হইয়াছিল, সুতরাং কপালকুণ্ডলা এবং তাঁহার স্বামী উভয়ের প্রতি তাঁহার দারুণ বিরক্তি। অতএব কামিনীর প্রশ্নে উত্তর করিলেন,
“দরিদ্র ব্রাহ্মণ আবার সুন্দর কুৎসিত কি?”
মতি সহচরীর মনের ভাব বুঝিয়া হাস্য করিলেন, "দরিদ্র ব্রাহ্মণ যদি ওমরাহ হয়, তবে সুন্দর পুৰুষ হইবে কি না?”
পে। “সে আবার কি?”
মতি। “কেন, তুমি কি জান না যে বেগম স্বীকার করিয়াছেন, যে খস্রু বাদশাহ হইলে আমার স্বামী ওমরাহ হইবে?”
পে। “তা ত জানি। কিন্তু তোমার পূর্ব্বস্বামী ওমরাহ হইবেন কেন?”
মতি। “তবে আমার আর কোন স্বামী আছে?”
পে। “যিনি নূতন হইবেন।”
মতি ঈষৎ হাসিয়া কহিলেন, আমার ন্যায় সতীর দুই স্বামী, এ বড় অন্যায় কথা।——ও কে যাইতেছে?”
যাহাকে দেখিয়া মতি কহিলেন, “ও কে যাইতেছে?” পেষ্মন তাহাকে চিনিল; সে আগ্রা নিবাসী, খা আজিমের আশ্রিত ব্যক্তি। উভয়ে ব্যস্ত হইলেন। পেষ্মন্ তাহাকে ডাকিলেন; সে ব্যক্তি আসিয়া লুৎফ্-উন্নিসাকে অভিবাদন পূর্ব্বক এক খানি পত্র দান করিল; কহিল,
“পত্র লইয়া উড়িষ্যা যাইতেছিলাম। পত্র জরূরি।”
পত্র পড়িয়া মতিবিবির আশা ভরসা সকল অন্তর্হিত হইল। পত্রের মর্ম্ম এই,
“আমাদিগের যত্ন বিফল হইয়াছে। মৃত্যুকালেও আকবরশাহ আপন বুদ্ধিবলে আমাদিগের পরাভূত করিয়াছেন। তাঁহার পরলোকে গতি হইয়াছে। তাঁহার আজ্ঞাবলে, কুমার সেলিম এক্ষণে জাঁহাগীর শাহ হইয়াছেন। তুমি খস্ৰুর জন্য ব্যস্ত হইবে না। এই উপলক্ষে কেহ তোমার শত্রুতা সাধিতে না পারে, এমত চেষ্টার জন্য তুমি শীঘ্র আগ্রায় ফিরিয়া আসিবা।”
আকবর শাহ যে প্রকারে এ ষড়যন্ত্র নিষ্ফল করেন, তাহা ইতিহাসে বর্ণিত আছে; এ স্থলে তদুল্লেখের আবশ্যক নাই।
পুরস্কার পূর্ব্বক দূতকে বিদায় করিয়া মতি, পেষ্মনকে পত্র শুনাইলেন। পেষ্মন্ কহিল,
“এক্ষণে উপায়?”
মতি। “এখন আর উপায় নাই।”
পে। (ক্ষণেক চিন্তা করিয়া) “ভাল ক্ষতিই কি? যেমন ছিলে, তেমনিই থাকিবে, মোগল বাদশাহের পুরস্ত্রী মাত্রেই অন্য রাজ্যের পাটরাণী অপেক্ষা ও বড়।
মতি। (ঈষৎ হাসিয়া) “তাহা আর হয় না। আর সে রাজপুরে থাকিতে পারিব না। শীঘ্রই মেহের-উন্নিসার সহিত জাঁহাগীরের বিবাহ হইবে। মেহের-উন্নিসাকে আমি কিশোর বয়োবধি ভাল জানি; একবার সে পুরবাসিনী হইলে সেই বাদশাহ হইবে; জাঁহাগীর বাদশাহ নাম মাত্র থাকিবে। আমি যে তাহার সিংহাসনারোহণের পথরোধের চেষ্টা পাইয়াছিলাম, ইহা তাহার অবিদিত থাকিবে না। তখন আমার দশা কি হইবে?”
পেষ্মন্ প্রায় রোদনোম্মুখী হইয়া কহিল, “তবে কি হইবে?”
মতি কহিলেন, “এক ভরসা আছে। মেহের-উন্নিসার চিত্ত জাঁহাগীরের প্রতি কিরূপ? তাহার যেরূপ দার্ঢ্য তাহাতে যদি সে জাঁহাগীরের প্রতি অনুরাগিণী না হইয়া স্বামীর প্রতি যথার্থ স্নেহশালিনী হইয়া থাকে, তবে জাঁহাগীর শত শের আফগান বধ করিলেও, মেহের-উন্নিসাকে পাইবেন না। আর যদি মেহের-উন্নিসা জাঁহাগীরের যথার্থ অভিলাষিণী হয়, তবে আর কোন ভরসা নাই।”
পে। “মেহের-উন্নিসার মন কি প্রকারে জানিবে?”
মতি হাসিয়া কহিলেন, “লুৎফ্-উন্নিসার অসাধ্য কি? মেহের-উন্নিসা আমার বালসখী;—কালি বর্দ্ধমানে গিয়া তাঁহার নিকট দুই দিন অবস্থিতি করিব।”
পে। “যদি মেহের-উন্নিসা বাদশাহের অনুরাগিণী হন, তাহা হইলে কি করিবে?”
ম। “পিতা কহিয়া থাকেন, ‘ক্ষেত্রে কর্ম্ম বিধীয়তে।’ উভয়ে ক্ষণেক নীরব হইয়া রহিলেন। ঈষৎ হাসিতে মতির ওষ্ঠাধর কুঞ্চিত হইতে লাগিল। পেষ্মন্ জিজ্ঞাসা করিল, “হাসিতেছ কেন?”
মতি কহিলেন, “কোন নূতন ভাব উদয় হইতেছে।”
পে। “কি নূতন ভাব?”
মতি তাহা পেষ্মন্কে বলিলেন না। আমরাও তাহা পাঠককে বলিব না। পশ্চাৎ প্রকাশ পাইবে।