কপালকুণ্ডলা (১৮৭০)/তৃতীয় খণ্ড/প্রথম পরিচ্ছেদ

কপালকুণ্ডলা।

তৃতীয় খণ্ড।

প্রথম পরিচ্ছেদ।


ভূতপূর্ব্বে।

“কষ্টোয়ং খলুভৃত্যভাবঃ।”

 যখন নবকুমার কপালকুণ্ডলাকে লইয়া চটী হইতে যাত্রা করেন, তখন মতিবিবি পথান্তরে বর্দ্ধমানাভিমুখে যাত্রা করিলেন। যতক্ষণ মতিবিবি পথবাহন করেন ততক্ষণ আমরা তাঁহার পূর্ব্ববৃত্তান্ত কিছু বলি। মতির চরিত্র মহাদোষ-কলুষিত, মহদ্গুণেও শোভিত। এরূপ চরিত্রের বিস্তারিত বৃত্তান্তে পাঠক মহাশয় অসন্তুষ্ট হইবেন না।

 যখন ইহাঁর পিতা মহম্মদীয় ধর্ম্মাবলম্বন করিলেন, তখন ইহাঁর হিন্দুনাম পরিবর্ত্তিত হইয়া লুৎফ্-উন্নিসা নাম হইল। মতিবিবি কোন কালেও ইহাঁর নাম নহে। তবে কখন কখন ছদ্মবেশে দেশবিদেশ ভ্রমণ কালে ঐ নাম গ্রহণ করিতেন। ইহার পিতা ঢাকায় আসিয়া রাজকার্য্যে নিযুক্ত হইলেন। কিন্তু তথায় অনেক নিজ দেশীয় লোকের সমাগম। দেশীয় সমাজে সমাজচ্যুত হইয়া সকলের থাকিতে ভাল লাগে না। অতএব তিনি কিছুদিনে সুবাদারের নিকট প্রতিপত্তি লাভ করিয়া তাঁহার সুহৃৎ অনেকানেক ওমরাহের নিকট পত্র সংগ্রহপূর্ব্বক সপরিবারে আগ্রা আসিলেন। আকবরশাহের নিকট কাহারও গুণ অবিদিত থাকিত না; শীঘ্রই তিনি ইহার গুণগ্রহণ করিলেন। লুৎফ্-উন্নিসার পিতা শীঘ্রই উচ্চপদস্থ হইয়া আগ্রার প্রধান ওমরাহ মধ্যে গণ্য হইলেন। এদিকে লুৎফ্-উন্নিসা ক্রমে বয়ঃপ্রাপ্ত হইতে লাগিলেন। আগ্রাতে আসিয়া তিনি পারসীক, সংস্কৃত, নৃত্য, গীত, রসবাদ ইত্যাদিতে সুশিক্ষিতা হইলেন। রাজধানীর অসংখ্য রূপবতী-গুণবতী দিগের মধ্যে অর্থগণ্যা হইতে লাগিলেন। দুর্ভাগ্য বশতঃ বিদ্যাসম্বন্ধে তাঁহার ঈদৃশ শিক্ষা হইয়াছিল, নীতিসম্বন্ধে তাহার কিছুই হয় নাই। লুৎফ্-উন্নিসার বয়স পূর্ণ হইলে প্রকাশ পাইতে লাগিল যে, তাঁহার মনোবৃত্তি সকল দুর্দ্দমবেগবতী। ইন্দ্রিয়দমনের কিছুমাত্র ক্ষমতাও নাই, ইচ্ছাও নাই। সদসতে সমান প্রবৃত্তি। একার্য্য সৎ, একার্য্য অসৎ এমত বিচার করিয়া তিনি কোন কর্ম্মে প্রবৃত্ত হই তেন না; যাহা ভাল লাগিত, তাহাই করিতেন। যখন সৎকর্ম্মে অন্তঃকরণ সুখী হইত, তখন সৎকর্ম্ম করিতেন; যখন অসৎকর্ম্মে অন্তঃকরণ সুখী হইত, তখন অসৎকর্ম্ম করিতেন; যৌবন কালের মনোবৃত্তি দুর্দ্দম হইলে যে সকল দোষ জন্মে তাহা লুৎফ্-উন্নিসা সম্বন্ধে জন্মিল। তাঁহার পূর্ব্বস্বামী বর্ত্তমান;—ওমরাহেরা কেহ তাঁহাকে বিবাহ করিতে সম্মত হইলেন না। তিনিও বড় বিবাহের অনুরাগিনী হইলেন না। মনে মনে ভাবিতেন, কুসুমে কুসুমে বিহারিনী ভ্রমরীর পক্ষচ্ছেদ কেন করাইব? প্রথমে কাণাকাণি, শেষে কালিমাময় কলঙ্ক রটিল। তাঁহার পিতা বিরক্ত হইয়া তাঁহাকে আপন গৃহ হইতে বহিষ্কৃত করিয়া দিলেন।

 লুৎফ্—উন্নিসা গোপনে যাহাদিগের কৃপাবিতরণ করিতেন, তন্মধ্যে যুবরাজ সেলিম এক জন। একজন ওমরাহের কুলকলঙ্ক জন্মাইলে, পাছে আপন অপক্ষপাতি পিতার কোপানলে পড়িতে হয়, এই আশঙ্কায় সেলিম এপর্যন্ত লুৎফ্-উন্নিসাকে আপন অবরোধ বাসিনী করিতে পারেন নাই। এক্ষণে সুযোগ পাইলেন। রাজপুতপতি মানসিংহের ভগিনী, যুবরাজের প্রধানা মহিষী ছিলেন। যুবরাজ লুৎফ্-উন্নিসাকে তাঁহার প্রধান সহচরী করিলেন। লুৎফ্-উন্নিসা প্রকাশ্যে বেগমের সখী, পরোক্ষে যুবরাজের উপপত্নী হইলেন।

 লুৎফ্-উন্নিসার ন্যায় বুদ্ধিমতী মহিলা যে অল্পদিনেই রাজকুমারের হৃদয়াধিকার করিবেন, ইহা সহজেই উপলদ্ধি হইতে পারে। সেলিমের চিত্তে তাঁহার প্রভুত্ব এরূপ প্রতিযোগশূন্য হইয়া উঠিল যে লুৎফ্-উন্নিসা উপযুক্ত সময়ে তাঁহার পাটরাণী হইবেন ইহা তাঁহার স্থির প্রতিজ্ঞা হইল। কেবল লুৎফ্-উন্নিসার স্থিরপ্রতিজ্ঞা এমত নহে, রাজপুরবাসী সকলেরই ইহা সম্ভব বোধ হইল। এইরূপ আশার স্বপ্নে লুৎফ্-উন্নিসা জীবন বাহিত করিতে ছিলেন, এমত সময়ে নিদ্রা ভঙ্গ হইল। আকবর শাহের কোষাধ্যক্ষ (আক্‌তিমাদ-উদ্দৌলা) খাজা আয়াসের কন্যা মেহেরউন্নিসা যবনকুলে প্রধান সুন্দরী। এক দিন কোষাধ্যক্ষ রাজকুমার সেলিম ও অন্যান্য প্রধান ব্যক্তিকে নিমন্ত্রণ করিয়া গৃহে আনিলেন। সেই দিন মেহের-উন্নিসার সহিত সেলিমের সাক্ষাৎ হইল, এবং সেই দিন সেলিম মেহের-উন্নিসার নিকট চিত্ত রাখিয়া গেলেন। তাহার পর যাহা যাহা ঘটিয়াছিল, তাহা ইতিহাস পাঠক মাত্রেই অবগত আছেন। সের আফগান নামক একজন মহাবিক্রমশালী ওমরাহের সহিত কোষাধ্যক্ষের কন্যার সম্বন্ধ পূর্ব্বেই হইয়াছিল। সেলিম অনুরাগান্ধ হইয়া সে সম্বন্ধরহিত করিবার জন্য পিতার নিকট যাচমান হইলেন। নিরপেক্ষ পিতার নিকট কেবল তিরস্কৃত হইলেন মাত্র।সুতরাং সেলিমকে আপাততঃ নিরস্ত হইতে হইল। আপাততঃ নিরস্ত হইলেন বটে; কিন্তু আশা ছাড়িলেন না। শের আফগানের সহিত মেহের-উন্নিসার বিবাহ হইল। কিন্তু সেলিমের চিত্তবৃত্তি সকল লুৎফ্-উন্নিসার নখ দর্পণে ছিল;—তিনি নিশ্চিত বুঝিয়াছিলেন, শের আফগানের সহস্র প্রাণ থাকিলেও তাঁহার নিস্তার নাই। আকবরশাহের মৃত্যু হইলেই তাঁহারও প্রাণান্ত হইবে;—মেহের উন্নিসা সেলিমের মহিষী হইবেন। লুতফ্-উন্নিসা সিংহাসনের আশা ত্যাগ করিলেন।

 মহম্মদীয় সম্রাট-কুল-গৌরব আকবরের পরমায়ুঃ শেষ হইয়া আসিল। যে প্রচণ্ড সূর্য্যের প্রভায় তুরকী হইতে ব্রহ্মপুত্র পর্যন্ত প্রদীপ্ত হইয়াছিল, সে সূর্য্য অস্তগামী হইল। এ সময়ে লুতফ্-উন্নিসা আত্ম প্রাধান্য রক্ষার জন্য এক দুঃসাহসিক সঙ্কল্প করিলেন।

 রাজপুতপতি রাজা মানসিংহের ভগিনী সেলিমের প্রধানা মহিষী। খস্রু তাঁহার পুত্ত্র। একদিন তাঁহার সহিত আকবর শাহের পীড়িত শরীর সম্বন্ধে লুতফ্-উন্নিসার কথোপকথন হইতে ছিল; রাজপুত কন্যা এক্ষণে বাদশাহ পত্নী হইবেন, এই কথার প্রসঙ্গ করিয়া লুৎফ-উন্নিসা তাঁহাকে অভিনন্দন করিতেছিলেন, প্রত্যুত্তরে খস্রুর জননী কহিলেন, “বাদশাহের মহিষী হইলে মনুষ্য জন্ম সার্থক বটে, কিন্তু যে বাদশাহ-জননী সেই সর্ব্বোপরি।” উত্তর শুনিবামাত্র এক অপূর্ব্বচিন্তিত অভিসন্ধি লুৎফ্-উন্নিসার হৃদয়ে উদয় হইল। তনিি প্রত্যুত্তর করিলেন, “তাহাই হউন না কেন? সেওত আপনার ইচ্ছাধীন।” বেগম কহিলেন, “সে কি?” চতুরা উত্তর করিলেন, “যুবরাজ পুত্ত্র খস্রুকে সিংহাসন দান করুন।”

 বেগম কোন উত্তর করিলেন না। সে দিন এ প্রসঙ্গ পুনৰুত্থাপিত হইল না, কিন্তু কেহই একথা ভুলিলেন না। স্বামির পরিবর্ত্তে পুত্র যে সিংহাসনারোহণ করেন ইহা বেগমের অনভিমত নহে; মেহের-উন্নিসার প্রতি সেলিমের অনুরাগ লুৎফ্-উন্নিসার যেরূপ হৃদয়শেল, বেগমেরও সেইরূপ। মানসিংহের ভগিনী আধুনিক তুর্কমান কন্যার যে আজ্ঞানুবর্ত্তিনী হইয়া থাকিবেন, তাহা ভাল লাগিবে কেন? লুৎফ্-উন্নিসারও এ সঙ্কল্পে উদ্‌যোগিনী হইবার গাঢ় তাৎপর্য ছিল। অন্যদিন পুনর্ব্বার এ প্রসঙ্গ উত্থাপিত হইল। উভয়ের মত স্থির হইল।

 সেলিমকে ত্যাগ করিয়া খস্রুকে আকবরের সিংহাসনে স্থাপিত কর। অসম্ভাবনীয় বলিয়া বোধ হইবার কোন কারণ ছিল না। এ কথা লুৎফ্-উন্নিসা বেগমের বিলক্ষণ হৃদয়ঙ্গম করাইলেন। তিনি কহিলেন, “মোগলের সাম্রাজ্য রাজপুতের বাহুবলে স্থাপিত রহিয়াছে; সেই রাজপুত জাতির চূড়া রাজা মানসিংহ; তিনি খস্রুর মাতুল; আর মুসলমানদিগের প্রধান খাঁ আজিম; তিনি প্রধান রাজমন্ত্রী; তিনি খস্রুর শ্বশুর; ইহারা দুইজনে উদ্যোগী হইলে, কে ইহাঁদিগের অনুবর্তী না হইবে? আর কাহার বলেই বা যুবরাজ সিংহাসন গ্রহণ করিবেন? রাজা মানসিংহকে এ কার্যে ব্রতী করা, আপনার ভার। খাঁ আজিম ও অন্যান্য মহম্মদীয় ওমরাহগণকে লিপ্ত করা আমার ভার। আপনার আশীর্ব্বাদে কৃতকার্য্য হইব, কিন্তু এক আশঙ্কা, পাছে সিংহাসন আরোহণ করিয়া খস্রু এ দুশ্চারিণীকে পুরবহিষ্কৃত করিয়া দেন?”

 বেগম সহচরীর অভিপ্রায় বুঝিলেন। হাসিয়া কহিলেন, “তুমি আগ্রার যে ওমরাহের গৃহিণী হইতে চাও, সেই তোমার পাণি গ্রহণ করিবে। তোমার স্বামী পঞ্জ হাজারি মন্সরদার হইবেন।”

 লুৎফ্-উন্নিসা সন্তুষ্ট হইলেন। ইহাই তাঁহার উদ্দেশ্য ছিল। যদি রাজপুরী মধ্যে সামান্যাপুরস্ত্রী হইয়া থাকিতে হইল, তবে প্রতিপুষ্পবিহারিণী মধুকরীর পক্ষচ্ছেদ করিয়া কি সুখ হইল? যদি স্বাধীনতা ত্যাগ করিতে হইল, তবে বাল্যসখী মেহেরউন্নিসার দাসীত্বে কি সুখ? তাহার অপেক্ষা কোন প্রধান রাজপুরুষের সর্ব্বময়ী ঘরণী হওয়া গৌরবের বিষয়।

 শুধু এই লোভে লুৎফ্-উন্নিসা এ কর্ম্মে প্রবৃত্ত হইলেন না। সেলিম যে তাঁহাকে উপেক্ষা করিয়া মেহের-উন্নিসার জন্য এত ব্যস্ত, ইহার প্রতিশোধও তাঁহার উদ্দেশ্য।

 খা আজিম প্রভৃতি আগ্রা দিল্লীর ওমরাহেরা লুৎফ্-উন্নিসার বিলক্ষণ বাধ্য ছিলেন। অনেকেই পূর্ব্বকালে লুৎফ্-উন্নিসার প্রণয় ভাগী ছিলেন। খাঁ আজিম যে জামাতার ইষ্ট সাধনে উদ্যুক্ত হইবেন, ইহা বিচিত্র নহে। তিনি এবং আর আর ওমরাহগণ সম্মত হইলেন। খাঁ আজিম লুৎফ-উন্নিসাকে কহিলেন, “মনে কর যদি কোন অসুযোগে আমরা কৃতকার্য্য না হই, তবে তোমার আমার রক্ষা নাই। অতএব প্রাণ বাঁচাইবার একটা পথ রাখা ভাল।”

লুৎফ্-উন্নিসা কহিলেন, “আপনার কি পরামর্শ?” খা আজিম কহিলেন। “উড়িষ্যা ভিন্ন অন্য আশ্রয় নাই। কেবল সেই স্থানে মোগলের শাসন তত প্রখর নহে। উড়িষ্যার সৈন্য আমাদিগের হস্তগত থাকা আবশ্যক। তোমার ভ্রাতা উড়িষ্যায় মন্সরদার আছেন, আমি কল্য প্রচার করিব তিনি যুদ্ধে আহত হইয়াছেন। তুমি তাঁহাকে দেখিবার ছলে কল্যই উড়িষ্যায় যাত্রা কর। তথায় যৎকর্ত্তব্য তাহা সাধন করিয়। শীঘ্র প্রত্যাগমন কর।”

লুৎফ্-উন্নিসা এ পরামর্শে সম্মত হইলেন। তিনি উড়িষ্যায় আসিয়া যখন প্রত্যাগমন করিতেছিলেন, তখন তাঁহার সহিত পাঠক মহাশয়ের সাক্ষাৎ হইয়াছে।