কপালকুণ্ডলা (১৮৭০)/দ্বিতীয় খণ্ড/ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ।

অবরোধে।

কিমিত্যপাদ্যাভরণানি যৌবনে
ধৃতংত্বয়া রার্দ্ধকশোভি বল্কলম্।
বদপ্রদোষে স্ফুটচন্দ্র তারকা
বিভাবরী যদ্যরূনার কল্পতে॥

কুমারসম্ভব।

সকলেই অবগত আছেন, যে পূর্ব্বকালে সপ্তগ্রাম মহাসমৃদ্ধিশালিনী নগরী ছিল। এককালে যবদ্বীপ হইতে রোমকপর্য্যন্ত সর্ব্বদেশের বণিকেরা বাণিজ্যার্থ এই মহানগরীতে মিলিত হইত। কিন্তু বঙ্গীয় দশম একদাশ শতাব্দীতে সপ্তগ্রামের প্রাচীন সমৃদ্ধির লাঘব জন্মিয়াছিল। ইহার প্রধান কারণ এই যে, তন্নগরীর প্রান্তভাগ প্রক্ষালিত করিয়া যে স্রোতস্বতী বাহিত হইত, এক্ষণে তাহা শঙ্কীর্ণশরীরা হইয়া আসিতে ছিল; সুতরাং বৃহদাকার জলযান সকল আর নগরী পর্য্যন্ত আসিতে পারিত না। একারণ বাণিজ্য বাহুল্য ক্রমে লুপ্ত হইতে লাগিল। বাণিজ্যগৌরবা নগরীর বাণিজ্য নাশ হইলে সকলই যায়। সপ্তগ্রামের সকলই গেল। একাদশ শতাব্দীতে হুগলী নূতন সৌষ্ঠবে তাহার প্রতিযোগী হইয়া উঠিতেছিল। তথায় পর্ত্তুগীসেরা বাণিজ্য আরম্ভ করিয়া সপ্তগ্রামের ধনলক্ষ্মীকে আকর্ষিতা করিতেছিলেন। কিন্তু তখনও সপ্তগ্রাম একেবারে হতশ্রী হয় নাই। তথায় এপর্য্যন্ত ফৌজদার প্রভৃতি প্রধান রাজপুৰুষদিগের বাস ছিল; কিন্তু নগরীর অনেকাংশ শ্রীভ্রষ্ট এবং বসতিহীন হইয়া পল্লীগ্রামের আকার ধারণ করিয়াছিল।

 সপ্তগ্রামের, এক নির্জ্জন ঔপনগরিক ভাগে নবকুমারের বাস। এক্ষণে সপ্ত গ্রামের ভগ্নদশায় তথায় প্রায় মনুষ্য সমাগম ছিল না; রাজপথ সকল লতাগুল্মাদিতে পরিপূরিত হইয়াছিল। নবকুমারের বাটীর পশ্চাদ্ভাগেই এক বিস্তৃত নিবিড় বন। বাটীর সম্মুখে প্রায় ক্রোশার্দ্ধ দূরে একটী ক্ষুদ্র খাল বহিত; সেই খাল একটা ক্ষুদ্র প্রান্তর বেষ্টন করিয়া গৃহের পশ্চাদ্ভাগস্থ বনমধ্যে প্রবেশ করিয়াছিল। গৃহটী ইষ্টক রচিত; দেশকাল বিবেচনা করিলে তাহাকে নিতান্ত সামান্য গৃহ বলা যাইতে পারিত না। দোতালা বটে, কিন্তু ভয়ানক উচ্চ নহে; এখন একতালায় সেরূপ উচ্চতা অনেক দেখা যায়।

 এই গৃহের সৌধোপরি দুইটী নবীনবয়সী স্ত্রীলোক দাঁড়াইয়া চতুর্দ্দিক্ অবলোকন করিতে ছিলেন। সন্ধ্যাকাল উপস্থিত। চতুর্দ্দিকে যাহা দেখা যাইতেছিল, তাহা লোচনরঞ্জন বটে। নিকটে একদিকে, নিবিড়বন; তন্মধ্যে অসংখ্য পক্ষীগণ কলরব করিতেছে। অন্যদিকে ক্ষুদ্র খাল, রূপার সূতার ন্যায় পড়িয়া রহিয়াছে। দূরে, মহানগরীর অসংখ্য সৌধমালা, নববসন্তপবনস্পর্শলোলুপ নাগরিকগণে পরিপূরিত হইয়া শোভা করিতেছে। অন্যদিকে, অনেকদূরে নৌকাভরণা ভাগীরথীর বিশালবক্ষে সন্ধ্যাতিমির ক্ষণে ক্ষণে গাঢ়তর হইতেছে।


 যে নবীনাদ্বয় প্রাসাদোপরি দাঁড়াইয়াছিলেন, তন্মধ্যে এক জন চন্দ্ররশ্মিবর্ণাভা, অবিন্যস্ত কেশভার মধ্যে প্রায় অর্দ্ধলুক্কায়িত। অপরা কৃষ্ণাঙ্গিনী; তিনি সুমুখী, ষোড়শী; তাঁহার ক্ষুদ্র দেহ, মুখখানি ক্ষুদ্র; তাহার উপরার্দ্ধে চারিদিক্ দিয়া ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কুঞ্চিত কুন্তলদাম বেড়িয়া পড়িয়াছে; যেন নীলোৎপল-দল রাজি উৎপলমধ্যকে ঘেরিয়া রহিয়াছে। নয়নযুগল বিস্ফারিত, কোমল-শ্বেতবর্ণ, সফরী সদৃশ; অঙ্গুলি গুলিন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র, সঙ্গিনীর কেশতরঙ্গ মধ্যে ন্যস্ত হইয়াছে। পাঠক মহাশয় বুঝিয়াছেন, যে চন্দ্ররশ্মিবর্ণশোভিনী কপালকুণ্ডলা; তাঁহাকে বলিয়া দিই, কৃষ্ণাঙ্গিনী তাঁহার ননন্দা শ্যামা সুন্দরী।

 শ্যামাসুন্দরী ভ্রাতৃজায়াকে কখন “বউ” কখন আদর করিয়া, “বন্’ কখন “মৃণো” সম্বোধন করিতেছিলেন। কপালকুণ্ডলা নামটী বিকট বলিয়া, গৃহস্থেরা তাঁহার নাম মৃণ্ময়ী রাখিয়াছিলেন; এইজন্য “মৃণো” সম্বোধন। আমরাও এখন কখন কখন ইহাকে মৃণ্ময়ী বলিব।

 শ্যামাসুন্দরী একটী শৈশবাভ্যস্ত কবিতা বলিতেছিলেন, যথা—

বলে——পদ্মরাণী, বদন্ খানি, রেতে রাখে ড়েকে।
 ফুটায় কলি, জুটায় অলি, প্রাণপতিকে দেখে।
আবার——বনের লতা, ফেলে পাতা, গাছের দিকে ধায়।
 নদীর জল, নাম্‌লে ঢল, সাগরেতে যায়॥
ছি ছি———শরমটুটে, কুমুদফুটে, চাঁদের আলো পেলে।
 বিয়ের কনে রাখ্‌তে নারি ফুলশয্যা গেলে।
মরি————একি জ্বালা, বিধির খেলা, হরিষে বিষাদ।
 পর পরশে, সবাই রসে, ভাঙ্গে লাজের বাঁধ॥

 তুই কিলো একা তপস্বিনী থাকিবি?”

 মৃণ্ময়ী উত্তর করিল, “কেন কি তপস্যা করিতেছি?”

 শ্যামাসুন্দরী দুই করে মৃণ্ময়ীর কেশ-তরঙ্গমালা তুলিয়া কহিল, “তোমার এ চুলের রাশি কি বাঁধিবে না?”

 মৃণ্ময়ী কেবল ঈষৎ হাসিয়া শ্যামাসুন্দরীর হাত হইতে কেশগুলিন টানিয়া লইলেন।

 শ্যামাসুন্দরী আবার কহিলেন, “ভাল আমার সাধটী পুরাও। একবার আমাদের গৃহস্থের মেয়ের মত সাজ। কত দিন যোগিনী থাকিবে?”

 মৃ। “যখন এই ব্রাহ্মণ সন্তানের সহিত সাক্ষাৎ তখন ত আমি যোগিনীই ছিলাম।”

 শ্যা। “এখন আর থাকিতে পারিবে না”

 মৃ। “কেন থাকিব না।”

 শ্যা। “কেন? দেখিবি? তোর যোগ ভাঙ্গিব। পরশপাতর কাহাকে বলে জান?”

 মৃণ্ময়ী কহিলেন “না।”

 শ্যা। “পরশ পাতরের স্পর্শে রাঙ্গও সোনা হয়।”

 মৃ। “তাতে কি?”

 শ্যা। “মেয়েমানুষেরও পরশপাতর আছে।”

 মৃ। “সে কি।”

 শ্যা। “পুৰুষ। পুৰুষের বাতাসে যোগিনীও গৃহিনী হইয়া যায়। তুই সেই পাতর ছুয়েছিস্। দেখিবি,

বাঁধাব চুলেররাশ, পরাব চিকণ বাস,
 খোপায় দোলাব তোর ফুল।
কপালে সিঁথির ধার, কাঁকালেতে চন্দ্রহার,
 কানে তোর দিব যোড়াদুল॥
কুঙ্কুম চন্দন চূয়া, বাটা ভোরে পান গুয়!,
 রাঙ্গামুখ রাঙ্গা হবে রাগে।
সোণার পূতলি ছেলে, কোলে তোর দিব ফেলে,
 দেখি ভাল লাগে কি না লাগে॥”

 মৃণ্ময়ী কহিলেন, “ভাল, বুঝিলাম। পরশপাতর যেন ছুয়েছি, সোণা হলেম। চুল বাঁধিলাম; ভাল কাপড় পরিলাম; খোপায় ফুল দিলাম; সিঁথিতে চন্দ্রহার পরিলাম; কানে দূল দুলিল; চন্দন, কুঙ্কুম, চূয়া, পান, গুয়া, সোণার পুতলি পর্য্যন্ত হইল। মনে কর সকলই হইল। তাহা হইলেই বা কি সুখ?”

 শ্যা। “বল দেখি ফুলটী ফুটিলে কি সুখ?”

 মৃ।“লোকের দেখে সুখ; ফুলের কি?”

 শ্যামাসুন্দরীর মুখকান্তি গম্ভীর হইল; প্রভাতবাতাহত নীলোৎপলবৎ বিস্ফারিত চক্ষু ঈষৎ দুলিল; বলিলেন “ফুলের কি? তাহা ত বলিতে পারি না। কখন ফুল হইয়া ফুটি নাই। কিন্তু বুঝি যদি তোমার মত কলি হইতাম তবে ফুটিয়া সুখ হইত।” সীমান্ত

 শ্যামা কুলীনপত্নী।

 আমরাও এই অবকাশে পাঠক মহাশয়কে বলিয়া রাখি যে ফুলের ফুটিয়াই সুখ। পুষ্পরস, পুষ্প গন্ধ, বিতরণই তার সুখ। আদান প্রদানই পৃথিবীর সুখের মূল, তৃতীয় মূল নাই। মৃণ্ময়ী বন মধ্যে থাকিয়া এ কথা কখন হৃদয়ঙ্গম করিতে পারেন নাই—অতএব কথার কোন উত্তর না দিলেন।

 শ্যামাসুন্দরী তাঁহাকে নীরব দেখিয়া কহিলেন “আচ্ছা—তাই যদি না হইল;—তবে শুনি দেখি তোমার সুখ কি?”

 মৃণ্ময়ী কিয়ৎক্ষণ ভাবিয়া বলিলেন “বলিতে পারি না। বোধ করি সমুদ্র তীরে সেই বনে বনে বেড়াইতে পারিলে আমার সুখ জন্মে।”

 শ্যামাসুন্দরী কিছু বিস্মিতা হইলেন। তাঁহাদিগের যত্নে যে মৃণ্ময়ী উপক্বতা হয়েন নাই, ইহাতে কিঞ্চিৎ ক্ষুব্ধা হইলেন; কিছু, ৰুষ্টা হইলেন। কহিলেন, “এখন ফিরিয়া যাইবার উপায়?”

 মৃ। “উপায় নাই”  শ্যামা। “তবে করিবে কি?”  মৃ। “অধিকারী কহিতেন, “যথা নিযুক্তোস্মি তথা করোমি।” শ্যামা সুন্দরী মুখে কাপড় দিয়া হাসিয়া কহি লেন “যে আজ্ঞা ভট্টাচার্য্য মহাশয়! কি হইল?”

 মৃণ্ময়ী নিশ্বাস ত্যাগ করিয়া কহিলেন, “যাহা বিধাতা করাইবেন তাহাই করিব। যাহা কপালে আছে তাহাই ঘটিবে?”

 শ্যা। “কেন, কপালে আর কি আছে? কপালে সুখ আছে। তুমি দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেল কেন?”

 মৃণ্ময়ী কহিলেন, “শুন। যে দিন স্বামির সহিত যাত্রা করি, যাত্রাকালে আমি ভবানীর পায়ে ত্রিপত্র দিতে গেলাম। আমি মার পাদপদ্মে ত্রিপত্র না দিয়া কোন কর্ম্ম করিতাম না। যদি কর্ম্মে শুভ হইবার হইত, তবে মা ত্রিপত্র ধারণ করিতেন; যদি অমঙ্গল ঘটিবার সম্ভাবনা থাকিত, তবে ত্রিপত্র পড়িয়া যাইত। অপরিচিত ব্যক্তির সহিত অজ্ঞাত দেশে আসিতে শঙ্কা হইতে লাগিল। ভালমন্দ জানিতে মার কাছে গেলাম। ত্রিপত্র মা ধারণ করিলেন না—অতএব কপালে কি আছে জানি না।”

 মৃণ্ময়ী নীরব হইলেন। শ্যামাসুন্দরী শিহরিয়া উঠিলেন।

দ্বিতীয়ঃ খণ্ডঃ সমাপ্ত