কপালকুণ্ডলা (১৮৭০)/দ্বিতীয় খণ্ড/পঞ্চম পরিচ্ছেদ
পঞ্চম পরিচ্ছেদ।
স্বদেশে।
শব্দাখ্যেয়ং যদপি কিল তে যঃ সখীনাং পুরস্তাৎ
কর্ণে লোলঃ কথয়িতুমভূদাননস্পর্শলোভাৎ।
নবকুমার কপালকুণ্ডলাকে লইয়া স্বদেশে উপনীত হইলেন। নবকুমার পিতৃহীন; তাঁহার বিধবা মাতা গৃহে ছিলেন, আর দুই ভগিনী ছিল। জ্যেষ্ঠা বিধবা; তাঁহার সহিত পাঠক মহাশয়ের পরিচয় হইবে না। দ্বিতীয়া শ্যামাসুন্দরী সধবা হইয়াও বিধবা, কেন না তিনি কুলীনপত্নী। তিনি দুই এক বার আমাদিগের দেখা দিবেন।
অবস্থান্তরে নবকুমার অজ্ঞাতকুলশীলা তপস্বিনীকে বিবাহ করিয়া গৃহে আনায়, তাঁহার আত্মীয় স্বজন কত দূর সন্তুষ্টি প্রকাশ করিলেন তাহা আমরা বলিয়া উঠিতে পারিলাম না। প্রকৃত পক্ষে এ বিষয়ে তাঁহাকে কোন ক্লেশ পাইতে হয় নাই। সকলেই তাঁহার প্রত্যাগমন পক্ষে নিরাশ্বাস হইয়াছিল। সহযাত্রীরা প্রত্যাগমন করিয়া রটনা করিয়াছিলেন যে নবকুমারকে ব্যাঘ্রে হত্যা করিয়াছে। পাঠক মহাশয় মনে করিবেন যে, এই সত্যবাদিরা আত্মপ্রতীতি মতই কহিয়াছিলেন;—কিন্তু ইহা স্বীকার করিলে তাঁহাদিগের কল্পনা শক্তির অবমাননা করা হয়। প্রত্যাগত যাত্রীর মধ্যে অনেকে নিশ্চিত করিয়া কহিয়াছিলেন যে, নবকুমারকে ব্যাঘ্রমুখে পড়িতে তাঁহারা প্রত্যক্ষই দৃষ্টি করিয়াছিলেন।—কখন কখন ব্যাঘ্রটার পরিমাণ লইয়া তর্ক বিতর্ক হইল; কেহ কহিলেন ব্যাঘ্রটা আট হাত হইবেক—কেহ কহিলেন “না প্রায় চৌদ্দহাত।” পূর্ব্ব পরিচিত প্রাচীন যাত্রী কহিলেন, “যাহা হউক, আমি বড় রক্ষা পাইয়াছিলাম। ব্যাঘ্রটা আমাকেই অগ্রে তাড়া করিয়াছিল, আমি পলাইলাম; নবকুমার তত সাহসী পুৰুষ নহে; পলাইতে পারিল না।”
যখন এই সকল রটনা নবকুমারের মাতা প্রভৃতির কর্ণগোচর হইল, তখন পুরমধ্যে এমত ক্রন্দন ধ্বনি উঠিল, যে কয় দিন তাহার ক্ষান্তি হইল না। এক মাত্র পুত্রের মৃত্যুসম্বাদে নবকুমারের মাতা একেবারে মৃতপ্রায় হইলেন। এমত সময়ে যখন নবকুমার সস্ত্রীক হইয়া বাটী আগমন করিলেন, তখন তাঁহাকে কে জিজ্ঞাসা করে, যে তোমার বধূ কোন্ জাতীয়া বা কাহার কন্যা? সকলেই আহ্লাদে অন্ধ হইল। নবকুমারের মাতা মহাসমাদরে বধূ বরণ করিয়া গৃহে লইলেন।
যখন নবকুমার দেখিলেন যে কপালকুণ্ডলা তাঁহার গৃহমধ্যে সাদরে গৃহীতা হইলেন, তখন তাঁহার আনন্দ সাগর উছলিয়া উঠিল। অনাদরের ভয়ে তিনি কপালকুণ্ডলা লাভ করিয়াও কিছু মাত্র আহ্লাদ বা প্রণয় লক্ষণ প্রকাশ করেন নাই;—অথচ তাঁহার হৃদয়াকাশ কপালকুণ্ডলার মূর্ত্তিতেই ব্যাপ্ত হইয়া রহিয়াছিল। এই আশঙ্কাতেই তিনি কপালকুণ্ডলার পাণিগ্রহণ প্রস্তাবে অকস্মাৎ সম্মত হয়েন নাই; এই আশঙ্কাতেই পাণিগ্রহণ করিয়াও গৃহাগমন পর্য্যন্তও বারেক মাত্র কপালকুণ্ডলার সহিত প্রণয় সম্ভাষণ করেন নাই; পরিপ্লবোন্মুখ অনুরাগ সিন্ধুতে বীচিমাত্র বিক্ষিপ্ত হইতে দেন নাই। কিন্তু সে আশঙ্কা দূর হইল; জলরাশির গতিমুখ হইতে বেগনিরোধকারী উপল মোচনে যেরূপ দুর্দ্দম স্রোতোবেগ জন্মে, সেই রূপ বেগে নবকুমারের প্রণয় সিন্ধু উছলিয়া উঠিল।
এই প্রেমাবির্ভাব সর্ব্বদা কথায় ব্যক্ত হইত না, কিন্তু নবকুমার কপালকুণ্ডলাকে দেখিলেই যেরূপ স্বজললোচনে তাহার প্রতি অনিমিক্ চাহিয়া থাকিতেন, তাহাতেই প্রকাশ পাইত; যেরূপ নিষ্প্রয়োজনে, প্রয়োজন কল্পনা করিয়া কপালকুণ্ডলার কাছে আসিতেন তাহাতে প্রকাশ পাইত; যেরূপ বিনা প্রসঙ্গে কপালকুণ্ডলার প্রসঙ্গ উত্থাপনের চেষ্টা পাইতেন, তাহাতে প্রকাশ পাইত; যেরূপ দিবানিশি কপালকুণ্ডলার সুখসচ্ছন্দতার অন্বেষণ করিতেন, তাহাতে প্রকাশ পাইত; সর্ব্বদা অন্যমনস্কতা সূচক পদবিক্ষেপেও প্রকাশ পাইত। তাঁহার প্রকৃতি পর্য্যন্ত পরিবর্ত্তিত হইতে লাগিল। যে খানে চাপল্য ছিল সেখানে গাম্ভীর্য্য জন্মাইল; যে খানে অপ্রসাদ ছিল, সেখানে প্রসন্নতা জন্মাইল; নবকুমারের মুখ সর্ব্বদাই প্রফুল্ল। হৃদয় স্নেহের আধার হওয়াতে অপর সকলের প্রতি স্নেহের আধিক্য জন্মিল; বিরক্তিজনকের প্রতি বিরাগের লাঘব হইল, মনুষ্য মাত্র প্রেমের পাত্র হইল; পৃথিবী সৎকর্ম্মের জন্য মাত্র সৃষ্টা বোধ হইতে লাগিল; তাবৎ সংসার সুন্দর বোধ হইতে লাগিল। প্রণয় এইরূপ! প্রণয় কর্কশকে মধুর করে, অসৎকে সৎ করে, অপুণ্যকে পুণ্যবান্ করে, অন্ধকারকে আলোকময় করে!
আর কপালকুণ্ডলা? তাহার কি ভাব। চল পাঠক তাহাকে দর্শন করি।