বনবিহঙ্গ।

ছেড়ে দেরে ছেড়ে দেরে
কেন রে রাখিস ধরে,
বনের বিহঙ্গ আমি
বনে বনে যাই উড়ে!
আমায় রাখিলে   কি ফল ফলিবে
কেবল যাতনা ভার!
আমি বনপাখী    তরু-শাখে থাকি
প্রকৃতি ভূষণ সার;
আকাশের গায়   উড়িয়া বেড়াই
মনোমত সঙ্গী লয়ে,
প্রশান্ত প্রান্তরে   পল্লীগ্রামময়
গাইয়ে সমীর বয়ে

ছেড়ে দেরে ছেড়ে দেরে
কেন রে রাখিস ধরে,
বনের বিহঙ্গ আমি
বনে বনে যাই উড়ে!
নদ নদী কুল   পাহাড় নিঝরে
সৌরভ ফুলের বনে,
আমোদে মাতিয়া   উড়িয়া উড়িয়া
গাইব আপন মনে।

ছেড়ে দেরে ছেড়ে দেরে
কেন রে রাখিস ধরে,
বনের বিহঙ্গ আমি
বনে বনে যাই উড়ে
আবদ্ধ থাকিব   আর কত কাল?
এ যে ভীম কারাগার;
আমি ক্ষীণ প্রাণী   সহিতে নারি রে
নিঠুরতা অত্যাচার;
না দাও দেখিতে   তরুলতা-দল,
বসনে পিঞ্জরবন্ধ,

নিশা কি বাসর   ঘোর নিরন্তর
নয়ন রহিতে অন্ধ!
পৃথিবী আকাশ   মলয় বাতাস
কভু লাগে না অঙ্গে,
প্রেম ভরে চঞ্চু   তুলিয়া না পাই
খেলিতে সঙ্গিনী সঙ্গে।

ছেড়ে দেরে ছেড়ে দেরে
কেন রে রাখিস ধরে,
বনের বিহঙ্গ আমি
বনে বনে যাই উড়ে!
যখন অবনী   নিস্তব্ধে আপনি
রৌদ্র বাস হাসি’ পরে
যখন প্রকৃতি   রবিখর তাপে
অধীরা হইয়া পড়ে!
বিটপি-পল্লবে   ফুল্ল ফুলদলে
লুকাইয়ে ক্ষুদ্র দেহ,
আপনার গানে   আপনি মাতিয়ে
লভি রে সুখের মোহ।

আবার যখন   অনন্ত গগন
স্থাবর জঙ্গম লয়ে
নিঝুমে প্রকৃতি   রজনীর কোলে
ঘুমায় বিভোর হয়ে,
চাঁদের কিরণে   উড়িয়া উড়িয়া
চাহিয়া চাঁদের পানে
বউ কথা কও   বউ কথা কও
বলি রে উধাও প্রাণে!

কেন রে রাখিস ধরে
ছেড়ে দেরে ছেড়ে দেরে
বনের বিহঙ্গ আমি
বনে বনে যাই উড়ে!
যুবতী যুবকে   যখন পুলকে
দোঁহার বদন হেরে,
গভীর ভাবেতে   নয়ন ভাষায়
উড়িয়া গরব ভরে;
অদূর তরুতে   বউ কথা কও
সোহাগ-সঙ্গীতে গাই;

নূতন সোহাগে   প্রেমের বিহ্বলে
আমি উভয়ে মাতাই!

কেন রে রাখিস ধরে
ছেড়ে দেরে ছেড়ে দেরে,
বনের বিহঙ্গ আমি
বনে বনে যাই উড়ে!
যখন স্বাধীন   ছিনুরে বিপিনে
গুছাইয়ে গেহস্থলী
দম্পতী মিলিয়ে   শুনিতাম নীড়ে
শাবক অস্ফুট বুলি
বন-ফুল কত   দিতাম তাদের
যখন উদিত রবি,
সে সুখ গিয়াছে,   এখন কেবল
একাকী বসিয়া ভাবি!