কমলাকান্তের পত্র/খোদার উপর খোদকারী
১০
খোদার উপর খোদকারী
কেউ বলতে পার, অমি কমলাকান্ত বলে’ আফিম খাই, না আফিম খাই বলে’ আমি কমলাকান্ত? প্রসন্ন দুধে জল দেয় বলে’ সে প্রসন্ন, না প্রসন্ন বলে’ দুধে জল দেয়? কেউ বলতে পার না তা আমি জানি, যেহেতু সৃষ্টিকর্ত্তার কারখানার ভিতরকার খপর কা’রও জানা নেই। কিন্তু তবু তোমরা খোদার উপর খোদকারী করতে ত ছাড়বে না—তোমরা নাক সিঁটকে বলবে—কমলাকান্ত লোকটা এদিকে বেশ বটে, তবে মানুষটা কিছু নয়, যেহেতু সে আফিমখোর। কিন্তু এটা ভেবে দেখনা কেন যে, আফিম খায় না এমন কমলাকান্ত হ’তে পারত কিনা, দুধে জল দেয় না এমন প্রসন্ন হ’তে পারত কিনা? খোদা স্বয়ং এ দুই বস্তুকে এক করেচে—যথা কমলাকান্ত ও অহিফেন, তখন ওদুটা পদার্থের একটা নিত্য সম্বন্ধ আছে বলেই ত। আর ঐ “খোর” বলে’ যে গাল দাও, সেটা বাড়ার ভাগ; যেহেতু কমলাকান্ত ভাত খায়, তা’র বেলা ত কথার সামঞ্জস্য রেখে তা’কে “ভাতখোর” বল না। বলবে “কলৌ অন্নগতাঃ প্রাণাঃ”, ওটা মনুষ্যসুলভ লক্ষণ, অতএব দোষ কিসের? কিন্তু জানবে কমলাকান্তও অহিফেন-গত-প্রাণ, সেটাও তা’র লক্ষণ, অতএব তা’কে আর আফিংখোর বলিও না।
যদি বল, কেন, খোদা ইচ্ছাময়, তিনি কি মৌতাতী নয় এমন কমলাকান্ত, বা দুধে জল দেয় না এমন প্রসন্ন, ইচ্ছা করলে সৃজন করতে পারতেন না? নিশ্চয়ই পার্ত্তেন না তাই করেন নি; তা’হলে ত তিনি আরও কত অঘটন সংঘটন করতে পারতেন,—মেয়ে মানুষের হিংসা করে না এমন মেয়েমানুষ সৃজন করতে পারতেন; বিষহীন গোখুরা সৃজন করতে পারতেন, শষ্পাহারী সিংহ, মাংসাশী ঘোটক সৃজন করতে পারতেন; অমর মানুষ সৃজন করতে পারতেন; সাদা কাফ্রী ও কাল সাহেব এ সবই পরিতেন! পারতেন অথচ করেন নি, একথা আমি মানি না; করেন নি পারেন নি বলে, কারণ তাঁরও কাজের একটা বাঁধন আছে; তিনি খোদা বলে’ ত নবাব সিরাজুদ্দৌলা নন।
থিয়েটারের অভিনেত্রীবর্গকে শ্রেণীবিশেষ থেকে আমদানী করা হয় বলে’, এক শ্রেণীর ছুঁচিবাইগ্রস্ত লোক আছেন, তাঁরা থিয়েটার দেখতে যান না। ছুঁচিবাইয়ের পশ্চাতে কি আছে আবিষ্কার করবার দরকার নেই; কিন্তু তাঁরা যে চোরের উপর রাগ করে’ ভুঁয়ে ভাত খান, তা’তে চোরের বড় বয়েই গেল। তাঁরা একবার ভেরে দেখেন না, সমস্ত জীবনটা যাদের সুধু অভিনয় করেই কাটে, তা’রা অভিনেত্রী হবে না ত হ’বে কে? মল্ল কেন মল্ল হবে, উকীল কেন উকীল হবে, তাঁরা একথা কেন বলেন না বুঝতে পারি না। কেউ কি দেখাতে পারেন, কোন দেশে, কখনও যুধিষ্ঠির আর সাবিত্রীকে নিয়ে অভিনয় কার্য্য সম্পন্ন করে’ নাট্যকলার পরিণতি হ’য়েছে? তা হ’তে পারে না, আর হ’তে পারে না বলেই, হয় নি। Sarah Bernhardt—যাকে Divine Sarah বলে, বা Ellen Terry, বা সুকুমারী দত্তকে যদি সাবিত্রী হ’তে হ’ত, তা হ’লে আর অভিনেত্রী হওয়া হ’ত না—হয় সাবিত্রী নয় অভিনেত্রী—দুইই এক সঙ্গে, হ’তে পারে না, হয় নি, হবে না। অভিনেতা সম্বন্ধেও সেই কথা। তবে যদি কেউ বলেন—তবে চুলোয় যাক অভিনয়! যায় যাক! কিন্তু সাবিত্রীকে অভিনেত্রী করলেও তাই হ’বে, অভিনয় চুলোয় যাবে। থিয়েটারকে ঠাকুর ঘরের আইন দিয়ে বাঁধলে চলবে না। কারও কারও ধারণা থাকতে পারে যে, বিলেতে এমনটা হয় না; তাঁরা ভুলে যান যে, “বিলেত দেশটাও মাটির, সেটা সোনার রূপোর নয়”। সেখানে Stage একটা profession বটে এবং honorable professions বটে; কিন্তু honorable কেন? নাট্যশালাটা কলাভবন বলে’, ঠাকুর ঘর বলে’ নয়; নট ও নটীরা যথাক্রমে যুধিষ্ঠির ও সাবিত্রী বলে’ নয়। সেখানে গীর্জ্জার আইন Stageএ চালাবার ধৃষ্টতা কেউ রাখে না। সে দেশে নটীরা stage থেকে বাজারে আসে, এখানে বাজার থেকে stage এ যায়, আগু আর পিছু, এইমাত্র প্রভেদ। ফলে দাঁড়িয়েছে যে সে দেশের নাট্যকলা স্ফূর্ত্ত হ’য়ে সুন্দর হয়েচে, আর আমাদের দেশে যে ভ্যাংচান সেই ভ্যাংচানই র’য়ে গেছে।
আনি একবার মস্তবড় জায়গায়, মস্তবড় শোক সভায়, উপস্থিত ছিলাম; মস্তবড় এক মহারাজা সে সভার সভাপতি; মস্তবড় পণ্ডিত, মস্তবড় ধর্ম্মাধিকরণের ধর্ম্মাধিকার বক্তা। যে পুরুষসিংহের মৃত্যুতে এই শোক সভার অধিবেশন হয়েছিল, তাঁকে ত আমরা “তিরস্কার পুরস্কার, কলঙ্ক কণ্ঠের হার” পরিয়ে ভবনদী পার করে’ দিয়েছিলুম। সেইখানেই যবনিকা পতন হ’য়ে, সব শেষ হ’য়ে গেলে আমার কিছু বলবার থাকত না; কিন্তু শোক করতে গিয়ে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’র সঙ্গে সঙ্গে, খোদার উপর খোদকারী করতে দেখে, আমার পিত্ত পর্য্যন্ত দগ্ধ হ’য়ে গেল। বক্তার পর বক্তা উঠে বলতে লাগলেন—নাটককারের নাটকগুলি চমৎকার, বঙ্গসাহিত্যের রত্নভাণ্ডারের উজ্জ্বলতম রত্ন স্বরূপ; তাঁর অভিনয় নৈপুণ্যও অদ্ভুত—কিন্তু, নাটক ছেড়ে নাটককারের কথা ভাবলে, হৃদয়ে অনুশোচনা আসে, দুঃখ হয়;—নাট্যকার হিসাবে এতবড় হ’লেও মানুষটা এত হীন মনে হ’লে লজ্জা হয়।
আরে আমার লজ্জাবতী লতা! প্রভুদের এই sanctionious scruples এই ছুঁচিবাই দেখে, আমি হাড়ে হাড়ে জ্বলছিলুম—কেন আমি বক্তৃতা করিতে শিখি নাই, তা হ’লে বাক্যের বন্যায় এই খড়কুটা আবর্জ্জনাগুলোকে ভাসিয়ে নিয়ে গিয়ে কালাপানিতে পৌঁছে দিতুম; অথবা যদি বাহুতে বল থাক্ত, ত টাউনহলের থামগুলোকে আলিঙ্গনে চূর্ণ করে’, Samsonএর মত নিজেও চাপা পড়ে মরতুম—এ অমানুষগুলোকেও চাপা দিয়ে মারতুম। তা হ’ল না; যেহেতু আমি সুধুই কমলাকান্ত মাত্র। নিন্দাস্তুতির অতীত হ’লেও, মুক্ত আত্মার তর্পণের জন্য একটা কথাও বলতে পারলুম না বলে’ আমার চোখে জল এল।
কিন্তু এত বড় সভায় কি একটা মানুষ নেই—সবাই কি নিরিমিষ্যি আতপ তণ্ডুল ও অপক্ব কদলী ভোজীর দল—এমন কেউ নেই যে বলে—হে পণ্ডিতম্মন্যগণ, এ অবিভাজ্য বিভাগ কি হিসাবে কর? এ যে অদ্বৈত, লেখার অন্তরালে লেখক, সৃষ্টির অন্তরালে স্রষ্টা, প্রকৃতির অন্তরালে পুরুষ! একটা দূর করে’ দিলে কি আর একটা টিকে? রাখ তোমার ছুঁচিবাই, তোমার শবব্যবচ্ছেদ। এমন সময় এক দিব্যজ্যোতি যুবাপুরুষ দণ্ডায়মান হ’য়ে, সেই বিশাল কক্ষতল কম্পিত করে’ গর্জ্জে উঠল, গিরিশ বাবুকে ভগবান একটা অখণ্ড মানুষ করে’ পৃথিবীতে পাঠিয়েছিলেন, তাঁর দেহ মন নিয়ে তিনি একটা গোটা মানুষ; কোন্ অধিকারে আপনারা সেই গোটা মানুষ্টাকে খণ্ড খণ্ড করে’, তার হাতটা ন’ব, পাটা ন’ব না, মাথাটা ন’ব, ধড়টা ন’ব না, এই ব্যবস্থা করচেন? নিতে হয় সমস্তটা নিন, তাঁর নাটক নিন, মদের বোতলও নিন—আর সাহস থাকে ত সমগ্র মানুষটাকে পরিত্যাগ করুন—তাঁর নাটকগুলোকে বগলদাবায় করে’ মানুষটাকে স্বারস্বত কুঞ্জ থেকে অর্দ্ধচন্দ্র দিয়ে বহিষ্কৃত করে দেবার আপনাদের অধিকার নেই, সাধ্য নেই।’ আমি বল্লাম—বহুত আচ্ছা, জীতা রও।
যিনি যুগের মানুষ, যুগাবতার, তিনি গিরীশ বাবুর ‘চৈতন্য লীলা’ নাটকের অভিনয় দেখে ভাবাবিষ্ট হয়েছিলেন; সংজ্ঞা হ’লে নাটককারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন এই ইচ্ছা ব্যক্ত করেন। গিরিশ বাবু তখন জগাইএর ভূমিকা গ্রহণ করে’ জীবন্ত জগাইরূপে গ্রীনরুনে অধিষ্ঠান কচ্চেন। যুগাবতার সেইখানেই গিয়ে উপস্থিত; একদিকে মাতাল গিরিশ, আর-একদিকে সত্ত্বগুণের আধার পরমহংস দেব; তিনি সমগ্র মানুষটাকে দেখে পরিতৃপ্ত হয়েছিলেন; মদের গন্ধে ভির্ম্মি যান নি।
আমি তাই বলি, দু’শ’ মানুষ খুন কর, আর রামায়ণের বিগলিত করুণার প্রস্রবণ বহিয়ে দাও; দু’শ বোতল মদ খাও, আর বিশ্বমঙ্গল, চৈতন্যলীলা, প্রফুল্ল, সিরাজদ্দৌলা লেখ; দু’শ রজকিনী রামীর প্রেমে মজে’ মজগুল হ’য়ে পদাবলীর লহরী ছড়িয়ে দাও, আমি তোমায় মাথায় করে’ নাচব। “কে কাকে মারে, তিনিই মেরে রেখেছেন” বলে’ খুনকে খুন নয় প্রমাণ কর্ত্তে চেষ্টা করব না; মদকে “কারণ” বলে’ মনকে আঁখি ঠারব না, আর রজকিনী রামীকে শ্রীরাধিকা প্রতিপন্ন না করে’ তা’কে রামী ধোপানিই বলব, এবং তা’র সম্পর্ককে দেহের সম্পর্কই বলব। আধ্যাত্মিক, অহেতুকী, আত্মিক ইত্যাদির কুঞ্ঝটিকা সৃজন করে’ বুজরুকি করব না। কিন্তু খবরদার প্রথমটা করেই শেষ করে’ দ্বিতীয়টা পাওনা রেখে দিও না, রাসলীলা করে’ শেষে গোবর্দ্ধন ধারণের বেলায় পেছিও না; লাঠ্যৌষধির ব্যবস্থা করব!