কমলাকান্তের পত্র/নিরুপদ্রবী
১২
“নিরুপদ্রবী”
অহিফেন প্রসাদাৎ আমি বহুদিন যাবৎ প্রায় সকল বস্তু, ব্যক্তি ও ব্যাপারের সঙ্গে অসহযোগ এবং খুব নিরুপদ্রব অসহযোগ করে’ বসে আছি; কেবল একটি জিনিষের সঙ্গে করি নাই; কেন-না করিতে পারি নাই; সেটি প্রসন্নের মঙ্গলা গাইয়ের দুধ। এবং আমার বিশ্বাস যতক্ষণ দুধে হাত না পড়ে, ততক্ষণ নির্ব্বিবাদে অসহযোগ নীতি খুব নিরুপদ্রব ভাবেই অনুসরণ করা চলে। পেটে খেলে পিটে সয়; কিন্তু যে-মুহূর্ত্তে সেই প্রাণধারণের উপায়ীভূত দুধ বা ভাত বা দুধ-ভাতের উপর কেহ উপদ্রব আরম্ভ করে’ তখন আর উপদ্রুত ব্যক্তি বা সম্প্রদায়ের নিরুপদ্রব থাকা চলে না। যদি সে নিদারুণ অবস্থাতেও সে বা তা’রা নিরুপদ্রব থাকে, তবে বুঝতে হ’বে যে সে বা তা’রা সব উপদ্রবের বাহিরে গিয়ে পড়েছে অর্থাৎ গতাসু হয়েেেছ।
বার্ণহার্ডির War is a biological necessity মন্ত্রের উপাসক জার্ম্মাণ জাতি ফরাসির ঠেলার চোটে মন্ত্রটাকে পাল্টে নিয়ে Non-violent non-co-operation is a logical necessity এই নূতন রূপ প্রদান করার আমার বড় আনন্দ হয়েছিল; আমার নিরুপদ্রব অসহযোগ নীতি যে কতখানি প্রসার লাভ করল তা ভেবে আমার মনে গর্ব্ব অনুভব করেছিলাম; কিন্তু তখন একবার ভেবে দেখবারও প্রবৃত্তি হয়েছিল, এমন দুর্দ্দান্ত জাতটা একমুহূর্ত্তে এতটা নিরীহ হ’য়ে গেল কেন? দেখলাম আমারও যে দশা জার্ম্মাণিরও সেই দশা। প্রথম, আমার মত জার্ম্মাণি অহিফেন ধরিয়াছে, অর্থাৎ আমার মত জীবন সংগ্রামে হারিয়া যুদ্ধ করার প্রতি বীতশ্রদ্ধ হইয়াছে। দ্বিতীয়, আমার মত তাহার সুবুদ্ধি হইয়াছে, অর্থাৎ ঘটনাস্রোত যেদিকে বহিয়া চলিয়াছে তাহার উজানে গিয়া হাত পা ক্লান্ত করা নিষ্প্রয়োজন—টানে যেখানে লইয়া চলে চলুক—চেষ্টা করিয়া লাভ নাই—এই রকমের একটি খুব গভীর তত্ত্বজ্ঞানের বন্যা দেশটার একপ্রান্ত হইতে আর-এক প্রান্ত পর্য্যন্ত বহিয়া চলিয়াছে। তৃতীয়, আমার মত তা’র এখনও দুধে হাত পড়ে নাই, অর্থাৎ ঘরে ভাত যথেষ্ট আছে তাই “কে যায় সাগর পার”, এই নীতি অবলম্বিত হইয়াছে। চতুর্থ, আমার মত সে নখ-দন্তহীন হইয়া পড়িয়াছে; কালীপূজার পাঁঠাবলিতে তার কোন ইষ্ট নাই, সে বৈষ্ণবধর্ম্ম গ্রহণ করিয়াছে। নখদন্তহীনের ধর্ম্ম নিরুপদ্রব অসহযোগ, তাই সে আজ নিরুপদ্রব অসহযোগী। অবশেষে, আমার মত পৃথিবীতে স্বর্গটা নামিয়া আসিবে এই বিশ্বাস জার্ম্মাণির হৃদয় অধিকার করিয়াছে। আফিম সেবনের যেটা পরম পরিণতি তাহাই ঘটিয়াছে।—
A day must come, asserted the Chancellor (Cuno), when honest agreement between equal nations would replace military dictation. He saw, as the other side must see, that unarmed Germany could not be conquered by arms. Till then the Germans must endure.
এ কথা এক কমলাকান্ত ও কমলাকান্তধর্ম্মী পুরুষের মুখেই শোভা পায়। কেবল এক মন্ত্র কমলাকান্ত বিশ্বাস করে যে, সেদিন আসিবে যেদিন মানুষে মানুষে তফাৎ থাকিবে না,—সকলেই মৌতাতী হইবে। আর হাতিয়ার থাকিলেই মানুষকে বশ করা যায় না; নিরস্ত্রকে কাটিয়া ফেলা চলে কিন্তু conquer করা চলে না। তবে ভূতলে স্বর্গরাজ্য স্থাপিত না হওয়া পর্য্যন্ত কমলাকান্তকে তথা তার মত নিরুপদ্রবীকে endure করিতে হইবে—অর্থাৎ সহ্য করিতে হইবে, এবং ধৈর্য্য ধরিয়া বাঁচিয়া থাকিতে হইবে, কেন না, না বাঁচিয়া থাকিলে স্বর্গ নামিয়া আসিবে না, তাহাকেই স্বর্গে আরোহণ করিতে হইবে।
কিন্তু আমার মৌতাত যখন পাতলা হইয়া আসে, তখন আমার নিরেট অর্থাৎ জমাট বুদ্ধিটাও একটু তরল হইয়া পড়ে এবং সন্দেহ সুবুদ্ধির মুর্ত্তি ধরিয়া আমাকে জ্বালাতন করে; তাহার কোন প্রতিকার না করিতে পারিয়া আমি একমাত্রা আফিম চড়াইয়া সে সন্দেহকে ঘুম পাড়াইয়া দি। সন্দেহটা এই—জার্ম্মাণি যে আমার অসহযোগনীতি গ্রহণ করিয়া আমাকে এবং নীতিটাকে ধন্য করিয়াছে সেটার শেষ পর্য্যন্ত মান রাখিবে ত? তার মান রাখিতে হইলে দুইটা কার্য্য করিতে হইবে; এক ফ্রান্সের দাবী শেষ পর্যন্ত অগ্রাহ্য করা এবং শেষ পর্য্যন্ত অস্ত্রধারণ না করা। কারণ ফ্রান্সের দাবী গ্রাহ্য করিয়া একটা মিটমাট করিতে রাজি হইলে, অথবা অস্ত্রের মুখে ফ্রান্সের ধৃষ্টতার প্রত্যুত্তর দিলে, অসহযোগ পণ্ড হইয়া গেল। মনে কর ঘরে চোর ঢুকিয়াছে, ঘটিই লউক, আর বাটিই লউক, আমাকে নিশ্চেষ্ট হইয়া চোরের সুপ্ত বিবেক যতক্ষণ না জাগে ততক্ষণ চুপ করিয়া নিদ্রার ভান করিয়া শুইয়া শুইয়া চোরকে আশীর্ব্বাদ করিতে হইবে, তবে আমি নিরুপদ্রব অসহযোগী। চোর চোর করিয়া চীৎকার করিয়া পাড়ার লোক ডাকিয়াছি কি (চোরের গলাটেপা ত দূরের কথা) আমার ধর্ম্মও গেল, জিনিষও গেল, চোরকে সাধু করাও হইল না! জার্ম্মাণি শেষটা সেই প্রকার ছেলেমানুষী করিয়া সব পণ্ড করিয়া ফেলিবে না ত? মাঝে মাঝে Guerilla warfareএর ধুয়া তুলিতেছে, শেষে শত্রুর গায়ে সত্য সত্যই হাত তুলিয়া বসিবে না ত?
আর যদিই বসে, নিরুপদ্রতার মাহাত্ম্য ঘোষণা করিবার আমার অনেক পন্থা আছে, সেজন্য আমি ভাবি না। প্রথমেই আমি বলিব East is East and West is West, the twain shall never meet—সুবুদ্ধি হইয়াছিল তাই জার্ম্মাণি আমার আধ্যাত্মিকতা গ্রহণ করিয়াছিল, কিন্তু রাখিতে পারিবে কেন? জার্ম্মাণি গরু খায়, শূয়র খায়, আমি চতুষ্পদের মধ্যে আর সব খাই বটে (অন্তত যতদিন দাঁত ছিল খাইতাম) কিন্তু ও দুটো বাদ; আর দ্বিপদের মধ্যে যেটা সব চেয়ে জঘন্য, অর্থাৎ মুরগী, তাহা আমি স্পর্শ করি না, মুরগীর ডিমও খাই না, যদিও হাঁসের ডিমে আমার আপত্তি নাই। এ সব মৌলিক পার্থক্য বর্ত্তমান থাকিতে যে কার্য্যের পার্থক্য হইবেই তাহাতে আর আশ্চর্য্য কি?