কমলাকান্তের পত্র/প্রসন্ন গোয়ালিনীর বাড়ী পূজা
কমলাকান্তের পত্র
১
প্রসন্ন গোয়ালিনীর বাড়ী পূজা
সকাল বেলাই আফিমখোরের ঘুমের সময়, বেশ চিনি-ঘুম্টি এসেছে কি আসে-নি এমন সময় দরজায় ধাক্কা, আর তার সঙ্গে সঙ্গে প্রসন্নর মধুর গলায় কোন অনির্দ্দিষ্ট লোকের উপর গালি বর্ষণের সঙ্গীতে আমার ঘুমটা চটে গেল, মেজাজটাও চটে গেল—প্রসন্ন তখন বল্লে, “ওগো উঠেছ, এত বেলা হল—এখনও উঠ নাই কি গো, আমার যে সর্ব্বনাশ হয়েছে—”
সর্ব্বনাশের কথা শুনে চম্কে উঠলাম—এমন অকালে ঘুম ভাঙ্গানটা সর্ব্বনাশের সূচনাই শাস্ত্রমতে বলে’ থাকে; যা’ হক দরজা খুলে দিলাম প্রসন্ন ঘরের মেঝেয় মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল—বল্লাম, “হয়েছে কি, সর্ব্বনাশ কি, সর্ব্বনাশ কিসের—গরু মরেছে, না দুধ বেরালে খেয়ে গেছে?” প্রসন্ন তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে একটা অযথা দুর্ব্বাক্য বলে’ বল্লে—“তোমার কোন কালে আক্কেল হ’ল না, লোকে আমার অনেক পয়সা দেখেছে, কাল রাত্রিতে আমার বাড়ী ঠাকুর ফেলে দিয়ে গেছে—আমি এখন কোথায় যাই, কি করি!” আমি বল্লাম, “তা হ’লে আমার যে আক্কেল হয়নি সেটা রাগের মাথায়ই বলেচ, আমার কাছে না-হ’লে বুদ্ধি নিতে এসেছ কেন? দেখ প্রসন্ন, পরের ধন আর নিজের বুদ্ধি সকলেই বেশী দেখে; আর দুধে অনেক জল ঢেলেচ বা অনেক জলে দুধ ঢেলেচ, তাতে পয়সা করেছ কি না তা জানি না—তবু না হয় একবার মা’র পূজা কল্লে—তাতে ক্ষতি কি, পূজার পুণ্যি আছে ত?” প্রসন্ন রাগিয়া বলিল—“তুমিও আমার পয়সা দেখচ, হা কপাল!” তখন আমি বল্লাম—“তবে এক কাজ কর, ঠাকুরখানার ত এখনও মুণ্ড বসেনি, ওটা একটা কাঠামই ধরিয়া লও—ওটাকে উনানজাত করিয়া ফেল, আপদ মিটে যাক্!”—প্রসন্ন বল্লে, “তা কি হয়?” —আমি বল্লাম—“এও না ও-ও না—পূজো কর্ত্তেও ইচ্ছে আবার না কর্ত্তেও ইচ্ছে, এতে আর আমি কি বলি বল।” প্রসন্ন বল্লে—“আমার যখন ইচ্ছে হয় তখন করবো, লোকে আমার ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে জোর করে’ পূজা করাবে এ কি কথা?”—তখন আমি বল্লাম, “দেখ প্রসন্ন তুমি গয়লার মেয়ে সে তত্ত্বকথা তুমি বুঝবে কিনা জানিনা—তবে আজকালকার সব পূজাই একরকম ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া পূজা বা ফেলা পুজা; তোমার পাড়াপড়শি তোমার বাড়ী ঠাকুর ফেলে দিয়ে গেছে, আর সব না হয় তাদের পূর্ব্ব পুরুষরা তাদের ঘাড়ে ফেলে দিয়ে গেছে এইমাত্র প্রভেদ,—মা’র রূপ,মা’র শক্তি, মা‘র ঐশ্বর্য্য সম্যক হৃদয়ে ধারণ করে’ মা’র আরাধনার কাল বহুদিন বাঙ্গালা দেশ থেকে চলে গেছে, তা তুমি আর দুঃখ কর না—ভক্তিভরে পূজা করগে, তোমার গয়লা-বংশ উদ্ধার হয়ে যাবে। তবে একটা কাজ কর্ত্তে হবে, একবার উকিল বাড়ী যেতে হবে—”
প্রসন্ন আশ্চর্য্য হয়ে বল্লে—“পূজা করব ত উকিল বাড়ী যাব কেন?—পুরুত বাড়ি বল্ছ বুঝি।”
আমি বল্লাম—“না না, আমি নেশার ঝোঁকে কথা কইচি না, উকিল বাড়ীই যেতে বলছি।” প্রসন্ন হাঁ করে’ রইল—আমি বল্লাম,—“হাঁ করে’ থেক না, মুখটি বুজে আমি যা বলি তা কর—এরাজ্যে পূজার প্রথম ব্যবস্থা উকিল মোক্তারেই করে’ থাকে, তারপর পূজারীর কাজ সম্ভব হয়।” তখনও হাবা গয়লার মেয়ে ঝোঝে না, বল্লে, “উকিল বাড়ী পূজার ব্যবস্থা ত এই আমি নূতন শুনলাম।” আমি বল্লাম—“কালোহ্যরং নিরবধিঃ বিপুলা চ পৃথ্বী—প্রসন্ন, যে রাজ্যের যে ব্যবস্থা, আর যে কালের যে রীতি, দশপ্রহরণধারিণী মা আমার সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে তোমার বাড়ী বিদেশ বিভুঁই থেকে আসবেন—তার একটা পয়ার করে’ না রাখলে শেষে বিপদে পড়বে।”
“তোমার কথাবার্ত্তা আমি ত কিছুই বুঝতে পারচি না” বলে’ সে গালে হাত দিয়ে বসে রইল। আমি বল্লাম—“প্রসন্ন, তুমি যদি এত সহজে আইনের কথা বুঝতে পারতে তা’হলে আইন করাই যে বৃথা হ’ত—তা বুঝচ না। বুঝিয়ে বলি শোন—এই যে দেশটী দেখচ, যার একদিকে পুণ্যতোয়া জাহ্নবী আর তিনদিকে পগার তোলা—এইটা দেশ, আর এর বাইরে যে বিশাল বাংলা দেশটা পড়ে আছে সেটা বিদেশ, সুদূর হিমালয়ের ত কথাই নাই;—সেই দূর হিমালয়-গৃহ থেকে যে মা নেমে তোমার বাড়ীতে আসবেন, তিনি ত বিদেশিনী বলেই পরিগৃহীতা হবেন—এই দেশে প্রবেশাধিকার লাভ কর্ত্তে হলে তাঁর একটা ছাড়-পত্র চাই; তারপর তিনি সাঙ্গোপাঙ্গ সঙ্গে করে’ আসবেন, ২০ জনের অধিক হলেই ত আইনের খেলাপ হয়ে যাবে। তার উপর আবার তিনি দশপ্রহরণ দশহাতে ধারণ করে’ আসবেন, অস্ত্র আইনের মধ্যেও পড়তে পারেন, এ সকল জটিল কথার মীমাংসা করবার জন্য একবার উকিলের বাড়ী যেতেই হবে।
প্রসন্ন। তুমি আফিঙের দর সস্তা দেখে এ দেশে এসে বাস কল্লে, আমি ত তোমায় বৃদ্ধ বয়সে ছেড়ে কোথায় গেলাম না, শেষে এমন দেশে এলে যে পূজা করতে গেলে উকিল বাড়ী যেতে হ’বে!
আমি। তা প্রসন্ন সব সুবিধা কি এক সঙ্গে পাওয়া যায়, তবে মন্দের ভাল এই, এখানকার আইনগুলা প্রায়ই ঘুমিয়ে থাকে, মাঝে মাঝে এক-একটা প্রবল হয়ে জেগে ওঠে, কোন্টা কোন্দিন জেগে উঠবে তা বলা যায় না, তাই আগে থেকেই সাবধান হওয়া ভাল।
প্রসন্ন। এই সব অদ্ভুত আইনের দরকার কি?
আমি। দেখ প্রসন্ন অনধিকার চর্চ্চা কর না, তুমি আদার ব্যাপারী জাহাজের কি খবর রাখ? তার উপর তুমি গয়লার মেয়ে, দুধের ব্যবসাই বোঝ, রাজ্য পরিচালনার কথা কি জান?— এ যে-রাজার দেশ সে-রাজার রাজ্যে নাকি জনতা থেকেই ঘোর বিপ্লব হয়েছিল, সে আজ প্রায় দু’শ বছরের উপর, কিন্তু তা’তে কি এল গেল—এদের সেই দু’শ বছর আগে যে ঘর পুড়েছিল—এরা এখনও তাই সিঁদুরে মেঘ দেখলে ডরায়। কোন রকম জটলা হলেই এঁরা আঁৎকে উঠেন—তা সেটা বন্ধু-ভোজনের জন্যই হউক, পূজা-পাঠের জন্যই হউক আর নৃত্যগীতের জন্যই হউক।”
প্রসন্ন তখন হতাশ হয়ে বল্লে—তা আমি মেয়ে মানুষ, আমি কি করে’ উকিল বাড়ী যাই, কাজটা ভাগাভাগি করে’নাও—তুমি উকিল বাড়ী নেও, আমি পুরুত বাড়ী যাব এখন। কিন্তু এমন দেশে কি মানুষ বাস করে?—এই বলিয়া প্রসন্ন বিষণ্ণ বদনে উঠিয়া গেল।