কমলাকান্তের পত্র/স্বপ্নলব্ধ রক্ষাকবচ

স্বপ্নলব্ধ রক্ষাকবচ

তখন একটু মৌজেই ছিলাম বলিতে হইবে, প্রসন্ন আসিয়া আমার দাওয়ায় খুঁটি ঠেসান দিয়া বসিল বলিল,—গরুটা বড় ধ্যাড়াচ্ছে!

 বিশ্বব্রহ্মাণ্ডটা একনিমিষে ঘুরিয়া আসিয়া মনটা বেশ একটু তরতরে জলের স্রোতের মত স্নায়বিক হিল্লোলের উপর দিয়া ভাসিয়া চলিয়াছিল, প্রসন্নর গলার আওয়াজে একটু থামিয়া দাঁড়াইয়া পড়িল—কতক তাহার কথার সায় হিসাবে এবং কতকটা স্বগত বলিয়া উঠিল—“আজকাল অনেকেই তাই কচ্চে বটে!”

 তখনও প্রসন্নর মুখখানা আমি ভাল করিয়া দেখি নাই, যখন দেখিলাম, তখন আশঙ্কা হইল, বুঝিবা নেশার ঝোঁকে কিছু বেফাঁস বলিয়া ফেলিয়াছি, বলিলাম, “কি প্রসন্ন! অমন ভ্রূ দুটা কুঞ্চিত করিয়া আমাকে সন্দেহের চক্ষে দেখিতেছ কেন? আমি সজ্ঞানে আছি ত!”

 প্রসন্ন বলিল—“তা বুঝতে পাচ্চি। আমি অনেকের কথা বল্‌চি না—আমার মঙ্গলার কথা বলচি, গরুটা বড় ধ্যাড়াচ্চে—দুধ কমে গেছে—”

 আমি। হ্যাঁ সেটা ভাবনার কথা বটে—দুধ কমে যাওয়াটা ভাবনারই কথা—কিন্তু ও দুটা প্রক্রিয়া সঙ্গের সাথী—একটা হলেই আর একটা ‘কেন নিবার্য্যতে।’ মানুষই বল আর গরুই বল—ধ্যাড়ালেই অর্থাৎ দেহের রসের পরিপাক না হলেই—বুদ্ধি কম হবে, কাজ কম হবে, ফসল কম হবে, দুধ কম হবে—যার যেমন। কারণ শাস্ত্র বলেচেন—রসো বৈ সঃ, তিনিই রস, তিনিই গরুর বাঁটের দুধ—শিল্পীর রসোদ্গার, বিশ্বপ্রপঞ্চের সুসার, সৌন্দর্য্য।

 প্রসন্ন। নাও কথা—এখনও ঘোর কাটেনি দেখচি—বলি গরুটার একটা ওষুধবিশুধ বাৎলে দিতে পার—যাতে তোমার ঐ রস না মাথা পরিপাক হয়ে যায়?

 আমি। প্রসন্ন তুমি আমাকে এতদিনেও চিন্‌লে না ত, এইটেই সবচেয়ে নিদারুণ ছুরিকাঘাত—(cruellest cut of all). আমি কি গো-বদ্দি? মানুষের ওরোগ হলে বরং একটা ব্যবস্থার চেষ্টা করতে পারি, কিন্তু গরু—ছি প্রসন্ন, তোমায় আবার বলি আমি গো-বদ্দি নই।

 প্রসন্ন একটুও অপ্রতিভ না হয়ে, হাজারহোক নিছক গয়লার মেয়ে বইত নয়, বল্লে—“কেউটে ধরতে পার আর হেলে ধর্ত্তে পার না; মানুষের বদহজম নিবারণ কর্ত্তে পার আর গরুর পার না?”

 আমি। দেখ—আজ দেশসুদ্ধ সব বদহজমে ভুগছে, মন আর দেহ দুই শীর্ণ হয়ে যাচ্চে, রসের পরিপাক হচ্চে না, গায়েও গত্তি লাগ্‌চে না, মনেও নয়। বিরুদ্ধ ভোজন, অভোজন, স্বল্পভোজন—এ সবই বদহজমের কারণ।

 প্রসন্ন। আমি তোমায় বদহজমের নিদান আওড়াতে বলচি না গো, কবিরাজ মহাশয়, আমাকে একটা উপায় বলে’ দাও, গরুটা যাতে বাঁচে, দুধটা রক্ষা হয়—

 হাজার হোক মেয়ে মানুষ, তাতে গয়লার মেয়ে, আমি যত বিষয়টাকে বড় করে’ দেখতে চাই, সে তত গোঁজে-বাঁধা-গরুর মত ঘুরে ঘুরে গোঁজের গোড়ায় চলে’ আসে—অতএব গতিরন্যথা হয়ে, আমাকে গরুকেই কেন্দ্র করে’ ভাবতে হ’ল―আবার নেশাখোর বলে’ গাল দেবে—আমি ঐ গালটা বড় বরদাস্ত করিতে পারি না।

 আমি বলিলাম—প্রসন্ন, কতরকম টোটকা আছে, তুক আছে, মাদুলী আছে, তাই একটা শিঙে বেঁধে দাও না, কিছুই কর্ত্তে হবে না—সব সেরে যাবে।

 প্রসন্ন একেবারে আগুন হয়ে উঠল—তবে সে মেয়েমানুষ আগুন, খুব ভয়ের আগুন না হলেও যখন দপ্ করে’ জ্বলে উঠে তখন ভয় লাগিয়ে দেয় বটে, বল্লে—“আমি টোটকা ফোটকা বুঝিনে—ওসব বুজরুকিতে কিছু হবে না—শেষে একদিন দেখবে, গরুর হাড় জুড়িয়ে গেছে, আর তোমার দুধ খাওয়াও ঘুচেছে।”

 আমি একেবারে দমে গেলাম—গয়লার মেয়ে টোটকা মানে না, মাদুলী মানে না, হল কি? বলিলাম—“প্রসন্ন তুমিও কি হাল ফ্যাসান মত কেবল বিজ্ঞান আর বিজ্ঞান বই কিছু চাওনা নাকি?—কিন্তু তুমি কি বুঝ, ঐ ওদের বিজ্ঞানের ভিতর কতটা টোটকা আর কতখানি বিশিষ্ট জ্ঞান!”

 প্রসন্ন। আমি অত বুঝতে চাই না, আজকাল গরুর গা ফুঁড়ে ওষুধ দেয়, আর গরু সেরে যায়, তার একটা ব্যবস্থা করতে পার?

 আমি। সেটাও টোটকা তবে ভিতরের টোটকা, আর মাদুলী বাইরের টোটকা, এইমাত্র প্রভেদ। কিসে কি হয় তা যখন কোনটাতেই ঠিক জানা নেই, তখন ছুঁচের ডগায় শরীরের ভিতর চালাইয়া দাও, আর বাহিরে গলায় মাদুলী করিয়া ঝুলাইয়া রাখ একই কথা—শরীর-মনের দেবতা যদি ঔষধ গ্রহণ করিলেন ত ঔষধ ফলিল—আর না গ্রহণ করিলেন ত সব ঔষধ ভাসিয়া গেল। তাঁহাকে প্রসন্ন করিয়া ঔষধ গ্রহণ করান যখন মানুষের সাধ্য নহে—তখন মাদুলিও যা আর বিজ্ঞানসম্মত ঔষধও তাই। প্রসীদ প্রসীদ বলে’ জীবনদেবতাকে প্রসন্ন কর, আর মাদুলী পর—এই প্রকৃষ্ট উপায়।

 প্রসন্ন। তোমার সব কথা আমি বুঝতে পারি না—মিছে রাগ করিয়াই বা কি করি বল—প্রসন্ন হতাশ হইয়া বসিয়া রহিল।

 আমি প্রসন্নকে বলিলাম—প্রসন্ন, যাদের দেশে বিজ্ঞান রসায়ন ইত্যাদির বহু স্ফুরণের ফলস্বরূপ গতযুদ্ধে শত শত লোক মরিল—তাহাদের দেশে প্রতিদিনের কার্য্যে, গৃহস্থলীতে, সমাজে, রাষ্ট্রীয়ব্যাপারে, যুদ্ধক্ষেত্রে, ঘোড়দৌড়ের মাঠে, বেচাকেনার মধ্যে কত টোটকা, পদক, রক্ষাকবচ, Mascot ব্যবহার হয় তা তুমি জান? তুমি একেবারে বিজ্ঞানভক্ত বিদুষী হইয়া উঠিয়াছ, মানুষ যতদিন না সর্ব্বশক্তিমানের যুড়ী হইয়া উঠিতেছে, ততদিন এসব চলিবেই চলিবে, তা কি তুমি জান? রোগ হইলে ডাক্তার ডাক—আমি দিব্যচক্ষে দেখিতে পাই, ডাক্তারটা একটা চল্‌তি রক্ষাকবচ মাত্র, রোগমুক্ত হওয়া না হওয়া যে দেবতার অনুগ্রহ, তাঁহার সহিত পরিচয় ডাক্তার বাবুর নাই, তবে তিনি উপস্থিত হইলে তুমি বেশী একটু বল পাও, একটু ধৈর্য্য ধরিয়া থাকিতে পার এই মাত্র; সব টোটকার উদ্দেশ্যও তাই—তোমাকে বল দেওয়া, ধৈর্য্য দেওয়া, দেবতার অনুগ্রহ লাভের জন্য অপেক্ষা করিয়া বসিয়া থাকিবার অধ্যবসায় দেওয়া ইত্যাদি।

 প্রসন্ন এতক্ষণ হাবুডুবু খাইতেছিল, এখন একেবারে তলাইয়া গেল, কোন্ দিগন্তে দৃষ্টি নিবদ্ধ করিয়া একেবারে চুপ হইয়া গেল।

 আমি বলিলাম—“প্রসন্ন অমন চুপ করিয়া থাকা ত তোমাদের স্বধর্ম্ম নহে, যা-হয় একটা-কিছু বল, নহিলে দিক্‌বিদিক্‌ জ্ঞানশূন্য হইয়া যাই।” প্রসন্ন একেবারে মুখে ওলপ দিয়াছিল।

 আমি বলিলাম—প্রসন্ন, দেখ তোমার বিজ্ঞানসম্মত ঔষধ দেওয়ায় বিপত্তিও আছে—অনেক সময় চিকিৎসাবিভ্রাটও হয়, বিপরীত চিকিৎসাও হয়—মাদুলি টোটকার সে আশঙ্কা একেবারেই নাই। লাগিল যদি ত দৈবানুগ্রহে একেবারে রাতকে দিন করিয়া দিল—আর না লাগিল যদি ত কোন আশঙ্কা নাই। বিরুদ্ধ কিছু হইবার আশঙ্কা মোটেই নাই। একটা বিজ্ঞানের ঢেউ আসিয়াছে বটে, কিন্তু আমাদের দেশ সনাতন ধর্ম্মের দেশ, অনেক ঢেউ কাটাইয়া আমরা আজ তিন হাজার বৎসর বাঁচিয়া আছি—এ ঢেউটাও কাটাইয়া উঠিব। এই দেখনা সমগ্র দেশটায় যে অহজম রোগ ধরিয়াছে, ভালমন্দ কিছুই পরিপাক হইতেছে না—দিন দিন শীর্ণ হইয়া পড়িতেছে, তাহার বিজ্ঞানসম্মত ঔষধ প্রয়োগ করিতে গিয়া যখন বোমা ফাটিল তখন একে আর হইয়া দাঁড়াইল! এখন দেশের মাথা যাঁরা, তাঁরা সকলেই বুঝিলেন যে বিজ্ঞান সম্মত হইলে কি হয় ওটা আমাদের ধাতুসম্মত নহে, অতএব পরিত্যজ্য। সে পথ ত্যাগ করিয়া দেশের রাজাকে বৈজ্ঞানিক উপায়ে তৈলাক্ত করিয়া (constitutional agitation) কার্য্য হাসিল করিবার ধূম পড়িয়া গেল—তাহার ফলে নূতন কাউন্সিল গড়িয়া উঠিল, তাহাও আজ মাকাল ফল বলিয়া পরিত্যজ্য মনে হইতেছে, যে হেতু সেটাও আমাদের শরীর ধাতুর (constitution) অনুকূল নহে। কিন্তু এইবার যে পথ আবিষ্কৃত হইয়াছে, প্রসন্ন, আর ভাবনা নাই, এই পথ প্রকৃষ্ট পথ, আমাদের ধাতুর অনুকূল পথ, আমাদের সনাতন পথ,—দেবতার শরণাপন্ন হও, আর মাদুলি পর, এপথে কোন ভাবনা চিন্তা নাই, বিপরীত ফলোদ্গমের কোন আশঙ্কা নাই, শত সহস্র লোক এই পথ অনুসরণ করিয়াছে, আর ভাবনা নাই।

 প্রসন্ন হঠাৎ উঠিয়া তীরবেগে আমার উঠান পার হইয়া চলিয়া গেল—“গরুটা ভাগাড়ে যাক ভাল করে’ দুধ খেয়ো’খন”—এই বলিয়া আমার দিকে তীব্র কটাক্ষ করিয়া অদৃশ্য হইয়া গেল।

 আমি দেখিলাম—আমার উঠানটা ভারতবর্ষব্যাপি বিস্তৃত বিরাট হইয়াছে, কত নদনদী, কত পর্ব্বত, কত বন, কত নগরনগরী, কত গ্রাম, কত কুটীর, কত নরনারী কিলিকিলি করিতেছে, সব গান্ধীর টুপী পরিয়া, খদ্দর পরিয়া, নিশ্চিন্তমনে আপনাপন ছোটবড় কাজে ব্যাপৃত রহিয়াছে, আকাশ বাতাস ভরিয়া গান্ধীর নাম উচ্চারিত হইতেছে—সকলের গলায় এক এক গান্ধী-রক্ষাকবচ।