কমলাকান্তের পত্র (১৯২৩)/অহিফেন ব্রত

অহিফেন ব্ৰত

মগধ বা মালবের মাঠে আফিমের ক্ষেত যে দেখে নাই সে বৃথাই জন্মেছে বলব না ত কি? লাল, নীল, সাদা— রেশমের ফুলের মত ফুল মাঠ আলো করে’ আছে; ফুলে ফুলে পালে পালে মৌনাছি সর্ব্বগায়ে পরাগ মেখে ফুলের বুকে লুটোপুটি খাচ্ছে; ক্ষণেক পরে ফুলের পাপড়ীগুলি ঝরে পড়ল; আর অমৃতের আধার আফিমের ফলগুলি মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে উঠ্ল; তারপর, বলিহারি মানুষের বুদ্ধি! সূচের ডগায় বিদ্ধ হ'য়ে সে অমৃতের উৎস খুলে গেল, আফিমের জন্ম হল।

স্বর্গে ছিল অহিফেন
মর্ত্যে আনিল কে?

 সে প্রাতঃস্মরণীয় দেবদূতের নাম পুরাণে পাওয়া যায় না; কিন্তু আমার দৃঢ় বিশ্বাস—অহিংসা আর আফিম একই সময়ে একই মহাপুরুষের দ্বারা স্বর্গরাজ্য থেকে মর্ত্যে আনীত হয়েছিল। কারণ আফিমের সঙ্গে অহিংসার নিত্য সম্বন্ধ; যেখানে সত্যিকারের অহিংসা আছে, খোঁজ করলে জানবে, সেখানে অল্পবিস্তর আফিমের আমেজ আছেই আছে; আর যেখানে আফিম আছে—সেখানে অহিংসা থাকতে বাধ্য।

 আফিমের যে কি শক্তি তা আমাদের প্রাতঃস্মরণীয় গভর্ণমেণ্ট বেশ জানেন; আসাম তরাইএর দুর্দান্ত নাগা কুকী প্রভৃতি জংলাগুলোকে, বৎসর বৎসর আফিম সওগাৎ দিয়ে, বেশ শান্ত শিষ্ট করে’ রেখেছেন; তাদের পশুবুদ্ধি গিয়ে তা'রা লক্ষ্মী হ'য়ে আফিম খাচ্ছে আর ঝিমুচ্ছে। পঞ্জাব সীমান্তে পাঠানগুলোকে এখনও আফিম ধরাতে পারেন নি বলে’, তা’রা সেই ইতিহাসের অরুণোদয়ের সময় যে পশুবৎ ছিল এখনও তাই আছে; ছোট্ট ছোট্ট আফিমের গুলিতে যে শুভ কার্য্য সম্পন্ন হ'ত, বড় বড় কামানের গোলাতে তা হচ্চে না; তা’রা যে-জংলী সেই-জংলীই র'য়ে গেছে। ক্ষুধিত শার্দ্দূলের মত ভারতবর্ষীয় মেষের পালের উপর পড়ে' তা'রা নিয়তই হাঙ্গামা বাধাচ্চে। চীনেরা যতদিন বেশ নির্বিবাদে আফিম সেবন কচ্ছিল ততদিন কেমন নির্ব্বিবাদে সুড় সুড় করে' সব ইউরোপীয় পাদরী, ও তাঁদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে' ইউরোপীয় বণিকসঙ্ঘ চীনের সমুদ্রতীরে, চীনের main artery ইয়াংসি নদীর উভয় পার্শ্বে, ভাল ভাল জায়গাগুলি দখল করে’ বসবার অবসর পেয়েছিলেন; কেন না তখন চীন ছিল অহিংস ও অহিফেনসেবী। এখন চীন আফিং কিছু “কম খাচ্চে ও সেই সঙ্গে কিছু কম অহিংস হ'য়ে উঠেছে; Boxer rebellion থেকে শুরু করে’ হিংসা বেড়েই চলেছে—foreign devilগুলোকে আমল দিতে বড় রাজী হচ্চে না।

 কিন্তু গোড়ায় গলদ হ’য়ে গেছে! এমন নির্ব্বিরোধী মোলায়েম জিনিষটার কিনা নাম রাখা হ’ল— অহিফেন। নামে কি এসে যায় যে বলে, সে নাম-রূপের গূঢ় মাহাত্ম্য ছাইও বোঝে না। What is in a name; a rose under another name will smell as sweet—এটা আর্ব্বাচিনের কথা, অরসিকের কথা। তা যদি হ’ত তা হ'লে—চাটুয্যে বাঁড়ুয্যে মুখুয্যে সব এক কথা হ'ত, বামুন শূদ্র এক হ'ত, কুলীন মৌলিক এক হ’ত—“বস্তুগত্যা” ত সব সেই মাতৃজঠরে দশমাস দশদিন যাপন, তারপর সুখদুঃখের দোলায় কিছুদিন দোল খাওয়া, অবশেষে বোড়াইচণ্ডীর ঘাটে একমুষ্টি ছাই। না, নামের মাহাত্ম্য মানতেই হবে; প্রসন্নকে আর কোন নামে অভিহিত করলে প্রসন্ন ত সাড়া দেবেই না, প্রসন্নকে যে জানে তা'র মনও সাড়া দেবে না, অন্য নাম প্রসন্নকে মানাবেই না। তা না হ'লে হিন্দুশাস্ত্রে নাম করণের এত পাকাপাকি ব্যবস্থা কেন? সে যাহোক, এমন মোলায়েম জিনিষটাকে যদি একটু মোলায়েম করে' বলা গেল, আফিম—তা’তে কি বৈয়াকরণের হাত এড়াবার যো আছে? সে ব্যক্তি যষ্ঠীতৎপুরুষ প্রকরণ বার করে' বলবেনই—অহিঃ কিনা বিষধরঃ তথ্য ফেনঃ। কি উগ্র, কি প্রচণ্ড, তীব্র নাম! এই নামের দোষেই এমন পরম পদার্থের এত অনাদর, তাই লোকে এমন শান্ত শিষ্ট জিনিষটাকে আজ বিষনয়নে দেখে।

 আমি কিন্তু সকলকে একবার ধীরচিত্তে আফিমের বিচার করতে অনুরোধ করি, কারণ ন্যায়বিচার সকলেরই প্রাপ্য। সে প্রাপ্য অধিকার থেকে, পশু, পক্ষী, কীট, পতঙ্গ, স্থাবর জঙ্গম কেহই বঞ্চিত নয়, আফিমই বা বঞ্চিত হবে কেন? তবে হ্যায়বিচার করা সকলের অধিকার নয়; এইখানেই যা গোল; কেন না যার আফিমে অধিকার নেই, সে তার ভালমন্দ বিচার করবে কোন অধিকারে? তারপর বিচারই বা হবে কি উপায়ে? চিনি যে মিষ্টি তা কি ন্যায়ের কচকচি দিয়ে বোঝা যায়, না বোঝান যায়। একথাবা চিনি গালে ফেলে দিলেই সব গোলমাল মিটে যায়? আফিম সম্বন্ধেই বা অন্য পন্থা হবে কেন?

 অতএব বৈয়াকরণ মাথায় থাকুন, আপনারা একবার ন্যায়ের খাতিরে একটু একটু আফিম বদনে দিয়ে দেখুন। এই human test tubeএর ভিতর আফিমকে ফেলে একবার পরীক্ষা করুন; অহিফেন মাহাত্ম্য চূড়ান্তরূপে অবধারিত হ'য়ে যাবে। বিশেষতঃ বর্ত্তমানযুগে আমরা non-violent non-co-operation আমাদের জীবনের, অন্ততঃ রাজনীতিক জীবনের, মূলমন্ত্র করেচি। এ মন্ত্রকে সার্থক করার প্রতি অহিফেনের যে কতখানি শক্তি তা একবার প্রত্যক্ষ করুন, এক কাজে দুই কাজ হ'য়ে যাবে।

 বর্ত্তমান movementএ আফিম কতটা কাজে লাগতে পারে তা কেউ ভাল করে' ভেবে দেখে নি, আমি দেখিচি। আফিংএর সঙ্গে non-violence বা অহিংসার যে নিত্য-সম্বন্ধ তা পূর্ব্বে বলিচি; তারপর আফিমের সেবায় non-co-operationএরও খুব সুবিধা হ'তে পারে। একটু বেশীদিন এ দিব্যবস্তুর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ পরিচয় হ’লে, আফিম ছাড়া দুনিয়ার যাবতীয় বস্তুর সঙ্গে non-co-operation করতেই হবে, bureaucracy ত কোন্ ছার! এবং দেশের লোক শ্রদ্ধাবান হ'য়ে যদি এই নিরুপদ্রব অহিফেন সেবায় মন দেয়, তা হ’লে আগামী ৩১শে ডিসেম্বর তারিখের মধ্যে স্বরাজলাভ অবধারিত। ছেলেবুড়ো, বিশেষ করে বাবাজীবনেরা, যদি এক মনে এক প্রাণে অহিফেন ব্রত গ্রহণ করে, তবে আমি কমলকান্ত চক্রবর্ত্তী বলে’ দিচ্ছি—৩১এ ডিসেম্বরের মধ্যে স্বরাজলাভ ঘটবেই ঘটবে, অন্যথা দিন পিছিয়ে দিতে হবে, আমি তজ্জন্য দায়ী থাকব না।

 আর জাতিবিচার বা ছুৎমার্গ—এসব যে কোথায় তলিয়ে যাবে ডুবুরি নাবিয়ে তা’র খোঁজ পাওয়া যাবে না। তা’র আমি প্রত্যক্ষ প্রমাণ দিচ্চি। আমি একবার রেলে চড়ে’ নসিরামবাবুর দেশে পূজার নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে যাচ্ছিলাম। আমার পূজার নিমন্ত্রণ অর্থে অহিফেনের ভূরি সেবনের নিমন্ত্রণ; কেননা মৌতাতী লোকের শক্তিপুজার সঙ্গে কোন সম্বন্ধই থাকতে পারে না। আমার সঙ্গে আমার দপ্তর, আর দপ্তরের ভিতর আমার আফিমের কৌটাটা; ষ্টেশনে যখন গাড়িখানা দাঁড়াল, আমার ঠিক খেয়াল ছিল না; যখন গাড়িটা ছাড় ছাড়, আমার সংজ্ঞা হ'ল, আমি তাড়াতাড়ি নেমে পড়লাম। গাড়িখানা চলে গেলে, আমার হাতটা খালি খালি বোধ হ’তে লাগল; তখন মনে করে' দেখি, আমার আফিমের কৌটাসমেত দপ্তরখানা গাড়িতে রয়ে গেছে! বলা বাহুল্য আমার দপ্তরের জন্য মোটেই দুঃখ হ’ল না, যেহেতু যে-মাথা থেকে দপ্তরের লেখা বাহির হ'য়ে ছিল তা আমার স্কন্ধেই ছিল। কিন্তু আফিমের কৌটার জন্য আমার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ল! আমার তখন খোঁয়ারির সময় নয়, কিন্তু কৌটাটা হাতছাড়া হওয়ায়, আমার তখনই হাই উঠতে লাগল। সে যে কি হাই উঠা, আর কত বড় হাই উঠা, তা যে অহিফেন সেবী নয়, সে বুঝতে পারবে না; রাবণের রথ গেলবার জন্য জটায়ূও ততবড় হাঁ করে নি। আমি বড়ই বিপন্ন হ'য়ে পড়লাম। সে অজ পাড়াগাঁ, সেখানে কি দয়াময় সরকার বাহাদুর পাড়াগেঁয়ে ভূতেদের জন্য আফিমের দোকান খুলেচেন? কোথায় যাই, কি করি! এমন সময় এক নধর দাড়িযুক্ত মুসলমান ভদ্রলোক (যাঁর পূর্ব্বপুরুষ হয়ত, যে চতুর্দ্দশ অশ্বারোহী বক্‌তিয়ার খিলিজির সঙ্গে বাঙ্গালা জয় করে' ছিল, তাঁদেরই অন্যতম) আমার সম্মুখে এসে দাঁড়ালেন। নব্য ঐতিহাসিক হয়ত চম্কে উঠে বলবেন— চোদ্দয় পদ্য মিলতে পারে, কিন্তু ১৪জন অশ্বারোহীতে বাঙ্গালা জয় হয় না; আর বাঙ্গালার মুসলমান শতকরা ৯৯জন......। সে প্রশ্ন এখন তোলা থাক। কিন্তু মানুষটা কি মোলায়েম, কি নরম, ঠিক আফিমের মতনই নরম আর মোলায়েম। আমার পাশে দাঁড়িয়ে, আমার ‘আকর্ণ হাঁ’ দেখে, যেন বড়ই ব্যথিত হ’য়ে জিজ্ঞাসা কল্লেন—মহাশয় (তাঁর পূর্বপুরুষ চতুর্দ্দশ অশ্বারোহীর অন্যতম, লক্ষণাবতীর রাজপথে ব্রাহ্মণ পথিককে ঠিক সে সুরে সম্বোধন করেন নি) আপনাকে কিছু বিপন্ন দেখচি, আপনার শরীর কি অসুস্থ?

 আমি। অসুস্থ বলে'! একেবারে গত, মৃত!

 মুসলমান। কেন বলুন দেখি?

 আমি। ঐ দেখুন গাড়ি; (তখনও রুপি বাঁদরের পশ্চাদ্দেশের মত গাড়ির রক্তবর্ণ পশ্চাদ্ভাগ দূরে লি-লি কচ্ছিল) ঐ ‘অদয় অক্রুরের’ রথে আমার কালাচাদ, আমায় ফেলে কোন্ অজানা মথুরাপুরীর দিকে চলে’ যাচ্ছেন; তাঁর বিরহদুঃখে আমি কৃষ্ণবিরহিনী রাধিকার মত মৃতপ্রায় হ’য়ে খাবি খাচ্চি!

 মুসলমান। আমি তা বুঝেচি; উঠুন, আমার সঙ্গে আসুন।

 আমি। আজ্ঞে, আপনার কি আফিমের দোকান আছে?

 মুসলমান। আজ্ঞে না; তবে আমিও মৌতাতী লোক, আপনাকে দেখেই চিনেছি— বলেই তিনি হাই তুলে, দু'টা তুড়ি দিয়ে মুখবিবর বন্ধ কল্লেন। আমিও চিনলুম!

 এই হারুণ-অল-রসিদের সঙ্গে তাঁর দৌলতখানায় উপস্থিত হ'লে তিনি অতি যত্ন করে’ রূপার কৌটায় আফিম, রূপার গোলাপপাশে তোফা গোলাপজল, আর এক রূপার পাত্র আনলেন। আমাকে বল্লেন—মহাশয় সেবা করুন। আমি গোলাপজলে আফিম গুলে (বলা বাহুল্য একটু বেশী মাত্রায়ই) পান করলুম। ধড়ে প্রাণ এল। খাঁ সাহেবও একমাত্রা সেবন করলেন।

 এখন বল ত—গোলাপজলও যে জল আমার সে জ্ঞান হরণ করলে কে? খাঁ সাহেবের সঙ্গে কমলাকান্ত চক্রবর্ত্তীর কোন কৌলিক সম্পর্ক থাকতে পারে না, তবে এত আত্মীয়তাই বা থেকে এল; খাঁটি বৈদিক আহার খেয়ে, খাঁ সাহেবের বক্‌তিয়ারি মেজাজে এত কমনীয়তা কোথা থেকে এল; সে এত ব্যথার ব্যথীই বা হ'ল কি করে? বলতেই হবে সব অহিফেন প্রসাদাৎ—এই অহিফেন প্রসাদাৎ—বাঘেগরুতে জল খাবে, তেলেজলে মিশবে, সাপেনেউলে সৌহার্দ্য হবে, হিন্দুমুসলমান ভাই ভাই হবে! অতএব অহিফেন সেবা গ্রহণ কর।

 মৌতাত বেশ জমে এলে খাঁ সাহেবকে অভিবাদন করে এবং একদিনের মত অহিফেন চাদরের খুঁটে “বন্ধনং কৃত্বা”, আমি নসিরামবাবুর বাড়ী যাত্রা করলুম; খাঁ সাহেব সদর দরজা পর্য্যন্ত আমার সঙ্গে এলেন; অতি মোলায়েম ভাবে বল্লেন “গুণা নেবেন না, সেলাম”। আমি নমস্কার করে’ মনে মনে বল্লাম, “অহিফেনো জয়তি।”