কমলাকান্তের পত্র (১৯২৩)/“বাবা মেয়ে”

“বাবা মেয়ে”

“সখি! নাহি জাননু সোহি পুরুষ কি নারী!” একথা কবিতায় বেশ শুনায়; কিন্তু পুরুষকেই বল আর রমণীকেই বল, বাস্তবজীবনে, এ সন্দেহাভাষ অলঙ্কারের মধ্যে যে ইঙ্গিত প্রচ্ছন্ন থাকে, পুরুষ বা নারী তা বরদাস্ত করতে পারে না। পুরুষকে রমণী আর রমণীকে পুরুষ বল্লে, উভয়ের পক্ষেই ব্যাজস্তুতির বিপরীতই বুঝিয়ে থাকে। সোজা কথায়—মেয়েমুখো পুরুষ আর মদ্দা মেয়েমানুষ এ দুটা কথাই গালাগাল।

 মানুষ অর্থাৎ পুরুষ মানুষ নারীকে, অবলা, দুর্ব্বলা, weaker vessel, ইত্যাদি উপাধি দিয়ে তুষ্ট করতে চেষ্টা করেছে; কিন্তু নারী, নারী হিসাবে, কোনদিনই অবলাও নয়, দুর্ব্বলাও নয়, weaker vesselও নয়। আমি প্রবলা, হরবোলা, হিড়িম্বা বহুত দেখেছি। তবে ও-সকল খেতাব যে নারীকে দেওয়া হয়েছে তা’র ভিতর একটা গূঢ় অভিসন্ধি আছে। পুরুষ নারীকে যা করতে চায় বা যেরূপ’ দেখতে চায় তদনুরূপ উপাধিই দিয়ে থাকে। ‘নাই’ বল্লে শুনেছি সাপের বিষও থাকে না। তোমার বল নাই, বুদ্ধি নাই, তেজ নাই ইত্যাদি শুনতে শুনতে নারী বাস্তবিকই অবলা, দুর্ব্বলা হ’য়ে যাবে এই দুষ্ট অভিপ্রায়েই পুরুষ নারীকে ঐ সকল সুশোভন অভিধান দিয়ে থাকে। নারী প্রকৃতপক্ষে কোনদিনই অবলা নয় ।

 তা বলে' নারী পুরুষও নয়, পুরুষের অসম্পূর্ণ সংস্করণও নয়। কবি বলেছেন—Woman is not undeveloped man, but other; ইহার বৈজ্ঞানিক হেতুবাদ যাহাই থাকুক, ব্যবহারিক জীবনে, খেয়ালের বশে খানিকটা এ সাংঘাতিক সত্যকে ভুললেও, কার্য্যতঃ এক মুহূর্ত্তও ভোলা চলে না। আর কবির উক্তির প্রতিপ্রসবটা, এ পর্য্যন্ত কোন কবি লিপিবদ্ধ না করলেও, আমি কমলাকান্ত চক্রবর্ত্তী বলে’ রাখলাম—Man is not developed woman, but other. ইহাই সহজ, অবিকৃত নৈসর্গিক অবস্থা ।

 মনু যাজ্ঞবল্ক্য হ'তে আরম্ভ করে' মেকলে পর্য্যন্ত সকল সংহিতাকার অপরাধ সম্বন্ধে স্ত্রী পুরুষ বিভাগ করেন নি; চুরি, জুয়াচুরি, খুন, জখম ইত্যাদির শাস্তিবিধানের সময়, জুরীর মন সুন্দর মুখ দেখে টলবার সম্ভাবনা থাকলেও, সংহিতাকারের মনে স্ত্রী পুরুষ প্রভেদজ্ঞান ছিল না। স্ত্রী-চোর ও পুরুষ-চোরের একই শাসনের ব্যবস্থা করা হয়েচে। অবলা বলে' কোনই ইতরবিশেষ করা হয় নি। মানবচরিত্র জ্ঞানের এমন পরিচয় কোন নিপুণ নাটককারের নাটকেও দেখতে পাই না। তবে স্ত্রী ও পুরুষের এমন একটা বয়স আসেই 'যখন উভয়েই অজহল্লিঙ্গ হ'য়ে যায়; যেমন আমি, আর প্রসন্ন। বৃদ্ধ কমলাকান্ত ঠিক শীতোষ্ণাদি দ্বৈতবিরহিত সাংখ্যোক্ত পুরুষ না হ'লেও তা'র প্রকৃতির একটা দিক একেবারে মুছে গেছে বল্লে মিথ্যা বলা হয় না; প্রসন্নরও তাই; প্রসন্নও এক প্রকার নিরুপাধি নিরবচ্ছিন্ন মানুষমাত্র, স্ত্রীও নয় পুরুষও নয়। এ অবস্থাটা নির্ব্বাণের পূর্ব্ব—সূচনামাত্র; মানুষ যে জন্মাবধি তিল তিল করে' মরে, এটা সেই মৃত্যুরই পূর্ব্বাভাষ মাত্র; তথাপি এটা স্বাভাবিক; বিকার হ'লেও অনৈসর্গিক নয়।

 কিন্তু জীবন্ত পুরুষ আর জীবন্ত নারী দুইটা স্বতন্ত্র জীব; দুইটার স্বতন্ত্র ধর্ম্ম; সে ধর্ম্ম যিনি স্ত্রীকে স্ত্রী করেচেন, পুরুষকে পুরুষ করেচেন তিনিই নির্ণয় করে' দিয়েচেন; তাদের শরীর মন সেই ভিন্ন ভিন্ন ধর্ম্মের অনুযায়ী করে’ গড়েছেন। নারী যদি পুরুষসুলভ গুণের বা কার্য্যের অধিকার চায়, সেটা নারীস্বভাবের বিকার বা অস্বাভাবিক পরিণতি বল্তেই হবে।

 এদেশে পুরুষ চিরদিন রমণীকে মাতৃ-আখ্যা দিয়ে এসেছে, সেটা ঠিক নিছক courtesy নয়; কেননা স্ত্রীর স্ত্রীত্ব আর মাতৃত্ব একই কথা, আমাদের দেশের এই সনাতন ধারণা। ইউরোপের অন্য কথা। বিলাতী Blue-stocking থেকে আরম্ভ করে' Golf, Cricket, Football, Tennis, Racing Championshipএ যে মা সকল প্রতিযোগিতা কচ্চেন তাঁদের আর ঠিক মা বলা চলে না। সিগারেট মুখে দিয়ে বা বাঁধা হুঁকা হাতে করে’ বসলে (পরমহংসদেব যাই বলুন) মা না বলে' বাবা বলাই ঠিক মনে হয় না কি?

 সুধু ফুটবল, ক্রিকেট ইত্যাদিতেই যে মাতৃত্ব অর্থাৎ স্ত্রীত্ব ক্ষুণ্ণ হ’য়ে যাচ্চে তা নয়; অতিরিক্ত মস্তিষ্ক চালনায় মাতৃহৃদয় শুষ্ক হ'য়ে গিয়ে, সন্তান-ধারণ-ক্ষমতা লোপ পেয়ে, গৃহস্থালী পরিচালনোপযোগী বৃত্তি সকল শুকিয়ে গিয়ে, ইউরোপে একটা তৃতীয় Sex সৃজন হচ্চে।

কমলাকান্তের বঁধু মিল্‌ল না বটে, আমার হৃদয় শুষ্ক বটে, কিন্তু আমার কথার কোন মূল্য নাই মনে করো' না। আমি বেশ দেখচি, যে নারীর মাতৃত্বের বিকাশ না হ'লে বা তা'র অবকাশ না পেলেই, সে পুরুষের কোটে এসে জুড়ে বসতে চায়,—Suffragette হয়, Politician হয়, সমাজ-সংস্কারক হয়, ঘর ও বাহিরের মধ্যে যে প্রাচীর, তা ভেঙ্গে ফেলবার জন্য হাতিয়ার সংগ্রহ করতে থাকে। কিন্তু যে-মুহূর্ত্তে তা'র বক্ষে শিশু মা বলে' তা’র মাতৃত্বকে জাগিয়ে তোলে, তখন তা’র পুরুষত্বের দাবী (যাকে সে মনুষ্যত্বের দাবী বলে’ মনে করে) কোথায় ভেসে যায়। লণ্ডনের পথে পথে যখন Suffragetteরা হৈ হৈ করে’ অতি অশোভনভাবে তাদের মানুষত্বের দাবী ঘোষণা করে' গগন ফাটাচ্ছিল, আমি বলেছিলাম— হে ইংরাজ, মা সকলকে ঘরবাসী কর, স্বামীর সোহাগ আর সস্তানের মুখচুম্বনের ব্যবস্থা করে’ দাও, মা সকলের মাতৃত্বের অমিয় উৎস খুলে দাও, মা সকল আপনার পথ খুঁজে পাচ্ছে না, পথ দেখিয়ে দাও। কিন্তু ইংরাজ সমাজ সে দিকে গেল না; তার উপর লোকবিধ্বংসী সমরবহ্নি তাদের যৌন-সংহতি লেহন করে' নিয়ে গেল; সে ব্যবস্থা আরও সুদূরপরাহত হ'য়ে গেল। তাই আজ নারীর নারীত্বের নামে পুরুষের স্বাধিকার মধ্যে হানা পড়ে গেছে। তা’র ঢেউ এখানেও এসে পৌঁছেচে।

 আমি দেখেচি বিলাতে যেমন স্বামী মিলে না বলে' স্ত্রীগণ পুংধর্মী হ'য়ে উঠে; আমাদের দেশে স্বামী মিললেও যেখানে স্বামী-সুখ মিল্‌ল না, বা সস্তানের কাকলিতে গৃহদ্বার মুখরিত হ'য়ে উঠল না, প্রায় সেইখানেই মনটা হঠাৎ বহির্মূখ হ'য়ে উঠে, হাল ফ্যাসানমত কথায় দেশসেবা, সমাজ-সংস্কার ইত্যাদির দিকে মনটা ছুটে বেরিয়ে পড়ে। প্রসন্নর একটি বিড়াল আছে, সে কখন কখন আমার দুধে ভাগ বসায়, সেটাকে প্রসন্ন বড় ভালবাসে; প্রসন্নর সে মার্জ্জারপ্রীতি, আমি বুঝতে পারি, তা’র বুভুক্ষিত মাতৃহৃদয়ের সন্তানপ্রীতিরই রূপান্তর আর কিছু নয়। অনেক স্ত্রীসুলভ বাতিক (Hobby) তাঁদের হৃদয়ের কোন-না-কোন জ্ঞাত বা অজ্ঞাত শূন্য কন্দর পূর্ণ করার ব্যর্থ চেষ্টা মাত্র।

 রমণীর এই মাতৃত্ব অর্থাৎ স্ত্রীত্ব বজায় রাখবার জন্য, সূক্ষ্মদর্শী হিন্দুশাস্ত্রকার কন্যামাত্রেরই বিবাহ অর্থাৎ স্বামিসম্পর্কের ব্যবস্থা করেছিলেন। Courtship বা flirtationএর অনিশ্চিৎ জুয়াখেলার উপর যৌন-সম্মিলনের ইমারৎ তোলবার ব্যবস্থা করেন নি। ইউরোপীয় কুমারীগণ অনেক সময় সেই flirtation অর্থাৎ বন্ধু সম্মিলন বা বঁধু সম্মিলনের ‘বিষম ঘুরণ পাকে’ হাবুডুবু খেয়ে হাঁপিয়ে উঠে, মাতৃত্বে তথা মনুষ্যত্ব জলাঞ্জলি দিয়ে, বিদ্রোহী হ'য়ে উঠচেন।

 আমি তাই বলচি—মা সকল, মা হও। কাউন্‌সিল বল, কোর্ট বল, সভা বল, সমিতি বল, বক্তৃতা বল, বৈচিত্র্য হিসাবে খুব অভিনব হ'লেও, ও-সব পন্থা, মা হওয়ার আগে নয়। “বাবা মেয়ের” দল পুষ্টি করে' সংসারের সর্ব্বনাশ ক'রো না, দেশের সর্ব্বনাশ ক’রো না। আমি বলে’ রাখলুম - পুরুষ পুরুষ, স্ত্রী স্ত্রী, the twain shall never meet.