কমলাকান্তের পত্র (১৯২৩)/পাগলের সভা
৯
পাগলের সভা
নসীরাম বাবুর একটা অভ্যাস ছিল — তিনি প্রতি রবিবারে তাঁর সদর বাড়ীর উঠানে ভিক্ষার চালের ধামা নিয়ে বস্তেন, আর ভিখারীদের নিজে হাতে মুষ্টিভিক্ষা দিতেন। কেহ কেহ বলিত তাঁর এটা একটা বাই; কেহ বা বলিত বাই নয়, চাল; কেহ বলিত অন্যদিন দানের পুণ্যটা চাকরবাকরেই নেয়, কর্ত্তা সপ্তাহের একদিন নিজেই সে-পুণ্য অর্জ্জন করেন। নসীরাম বাবুকে জিজ্ঞাসা করেচি, তিনি আমাকে বলেচেন—সপ্তাহে একদিন গ্রামের গরীবদুঃখীদের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ হয়, মন্দ কি? তাদের বাড়ী বাড়ী গিয়ে ত আর হয় না। তা’দের সুখদুঃখের সংবাদ নিলে মনটা থাকে ভাল, অযথা গরম হ'য়ে উপর দিকেও যায় না, আর ম্রিয়মাণ হ'য়ে নিচের দিকেও নেমে পড়ে না; মন্দ কি?
নসীরাম বাবুর এই সাপ্তাহিক মুষ্টিভিক্ষা নিয়ে কত জনের কতমত; তাঁকে বায়ুগ্রস্ত পর্য্যন্ত বলতেও লোকের বাধে নি। নসীরাম বাবুকে কেউ কখনও জিজ্ঞাসা করবার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে নি; আপনার মনে এক একটা অনুমান খাড়া করে' নিশ্চিন্ত হ'য়ে আছে। বিশেষজ্ঞেরা বলেন পাগলামির বিজ্ঞান সম্মত সংজ্ঞা দেওয়া যায় না, যেহেতু সহজ মানুষের বিজ্ঞান সম্মত সংজ্ঞা দেওয়া অসম্ভব। পাগল আর সহজের মধ্যে ব্যবধান, কৈশোর আর যৌবনের মধ্যে ব্যবধানের মত—সূক্ষ্ম ও অপরিজ্ঞেয়; কখন্ কৈশোর গিয়ে যৌবন এলো যেমন ধরা যায় না, সহজ মানুষ কখন্ পাগল হ'ল, ঠিক সে সন্ধিক্ষণ অন্তর্য্যামী ভিন্ন কেহ বুঝতে বা জানতে পারে না। কে পাগল আর কে সহজ তা’ও ঠিক ধরা কঠিন। যুক্তি, ন্যায় বা তর্ক শাস্ত্রের আইন, চোখ চেয়ে অমান্য করলে যদি মানুষকে পাগল বলতে হয়, তা হ'লে নসীরাম বাবুর কার্য্যের সকল সমালোচকই পাগল; যেহেতু তাঁরা সকলেই, কার্য্যমাত্রের কারণানুসন্ধানরূপ মনুষ্য হৃদয়ের প্রবলতম স্পৃহার বশবর্ত্তী হ'য়ে, ন্যায়ের মাথায় পদাঘাত করে’, এক একটা মনগড়া অনুমান খাড়া করে' নিশ্চিন্ত হয়েছিলেন : সে অনুমানের পশ্চাতে না ছিল যুক্তি, না ছিল প্রমাণ। পাগলামী জিনিবটাই এত জটিল বা স্থিতিস্থাপক যে কাহাকেও পাগল বা সহজ বল্লে, সর্পে রজ্জু— ভ্রম হ'ল কি না বলা কঠিন।
নসীরাম বাবুর রবিবারের অতিথিদের মধ্যে কতকগুলি, যা’কে লোকে সচরাচর পাগল বলে, সেই পাগল ছিল; কেহ কেহ আমাকে ও সে দলভূক্ত করত। তথাকথিত সহজ ভিখারী বা ভিখারিণীগণ চলে' গেলে নসীরাম বাবু তবে পাগলগুলিকে ভিক্ষা দিতেন, এবং তাদের নিয়ে একটু রঙ্গরস করতেন; ভিক্ষার শেষে নসীরাম বাবুর উঠানে একটি পাগলের সভা বসত বল্লে ভুল হয় না। সে সভার সভাপতি স্বয়ং নসীরাম বাবু, আমি দর্শক বা reporter মাত্র। আমি এক রবিবারের সভার proceedings report করছি।
নসীরাম বাবু। কি হে মাখন, কেমন আছ?
মাখন অন্যমনস্ক ভাবে একটু হাসিল মাত্র। মাখন কোমরে কাপড় না পরে' গলায় কাপড় পরে; সে বলে কোমরে কাপড় জড়ালে অনেকখানি কাপড় বাজে নষ্ট হয়; গলায় কাপড় পরলে, অল্প লম্বা কাপড়েই চলে, মিছে বাজে খরচ কেন?
নসীরাম বাবু। মাখন, সে দিন বাজারে মেছুনী মাগী তোমার গায়ে জল দিয়েছিল কেন হে?
মাখন। আজ্ঞে, মেছুনী বেটী বলে আমি উলঙ্গ, আমার কোমরে কাপড় নেই বলে'। আমি বল্লাম বেটি কোমরে কাপড় নেই ত কি হয়েছে, আমার দেহটা ত ঢাকা আছে? বেটি তবুও বলে,—পাগলা, তোর গায়ে কাপড় থাকলে কি হয়, তুইও কাপড়ের ভিতর নেংটা। আমি বল্লাম—বেটি, তোর কোমরে কাপড় থাকলে কি হয়, তুইও কাপড়ের ভিতর নেংটা! বেটি আমার গায়ে আঁস জল দিলে—বেটি পাগলী!
রতনা পাগ্লা ততক্ষণ একটুকরা ইট্ নিয়ে নসীরাম বাবুর সানবাঁধান উঠানের খানিকটা লিখে লিখে ভরিয়ে দিয়েছে।
নসীবাবু। রতন, কি লিখছ?
রতন। আজ্ঞে বেটা জমীদার জমীদারই আছে; রানা কেওরার উপর কি অত্যাচারটা করেচে বলুন দেখি! বেটাকে হাজতের হুকুম দিলুম, আর ৩০৪ ধারা মতে তা'র উপর মামলা চালিয়ে দিলুম।
নসীবাবু। গ্রামের জমীদার হাজার হ’ক, তা’র অত করে’ নিগ্রহ করলে—ভাল করলে কি?
রতন। ভালমন্দ কিছু নেই; তা বলে’ আপনি যেন তা’র হ'য়ে সাক্ষী দেবেন না; বিপদে পড়বেন বলে দিচ্চি।
নসীবাবু। আরে তা কি আমি করি! তুমি যখন দাঁড়িয়েছ তখন কি আর জমীদার বাবুর রক্ষা আছে? তা বাবু তোমার টাকাগুলোর কি ব্যবস্থা করলে?
রতন। তা’রও পয়ার করেচি; সিভিল জেল ঠেলে দিচ্চি।
নসীবাবু। কতদিক করবে? ফাঁসীও দেবে, জেলও দেবে?
রতন। যেটা লাগে।
নসীবাবু। মাথাটা আজ একটু বেশী গোলমাল দেখছি না রতন?
রতন। মাথাটা আমার ঠিকই আছে, জানেন। আমি পাগল যা মনে আসে তাই বলি, আর আপনি যাকে যা মনে আসে তা বলেন না—এই মাত্র প্রভেদ। মনে মনে সবাই পাগল, রতনা কিছু ফাঁস।
শেষের কথাগুলো আবৃত্তি করতে করতে রতনমণি চট্টোপাধ্যায় আপনার গোঁ ভরে' উঠে চলে’ গেল, তা’কে ফেরান গেল না।
গোপাল দে ছিল স্কুলমাষ্টার। ক্লাসে Goldsmith এর Village Preacher পড়াতে পড়াতে তা’র মাথা গোলমাল হ'য়ে যায়।
Those who came to scoff remained to pray এই ছত্রটা গুরুগম্ভীর ওজনে পাঠ করে' গোপাল একদিন ছেলেগুলোকে জিজ্ঞাসা করলে—'বাহাদুরী কার?' ছেলেরা হাঁ করে' রইল। গোপাল বার বার উক্ত পদটী আপন মনে পাঠ করলে, যত পড়ে তত গরম হ'য়ে উঠে। শেষে আপন মনে বলে’ উঠল—মূর্খ কবি! কেন remained to pray? — আরে বেটা, সে কি তোর পাদ্রীর বাহাদুরী না those who came to scoff তা’দের বাহাদুরী? তা'দের ভিতর যে ছাইচাপা আগুন ছিল, তোমার পাদ্রীর বক্তৃতার ফুৎকারে সেই ছাইগুলো মাত্র উড়ে গেল—আর প্রচ্ছন্ন অগ্নির রক্তবিভা প্রকটিত হ'য়ে পড়ল; পাদ্রীর ফুঁ আর তাদের আগুন। আগুন যদি না থাকত বা আগুন যদি নিবে গিয়ে থাকত, তুমি বেটা পাদ্রী ফুঁ পেড়ে পেড়ে চক্ষু রক্তবর্ণ করলেও আগুন জ্বলত না। ছাতারের বাসায় কোকিলের ডিম্, সে ডিমের ভিতর কোকিলের কুহুতান সুষুপ্ত থাকে—ছাতারে তা দিয়ে ফোটায় বলে' কি বাহাদুরী তার? ক্ষুদ্র বীজের ভেতর শেফালির সৌরভ নিদ্রিত, উড়ে বেটা গাছের গোড়ায় জল দেয় বলে' কি সৌরভের স্রষ্টা সে? জগাই মাধাই যদি খাঁটি সোনা না হ'য়ে প্রকৃতই খাঁটি লোহা হ'ত, তাদের লৌহহৃদয়কে গিল্টি করা চলত, সোনা করা সম্ভব হ'ত না। রত্নাকরের মুখে ‘মা নিষাদ—' ইত্যাদি শ্লোক বহির্গত হ'ত না, “মরা মরা” মন্ত্র আওড়ান সত্ত্বেও, যদি বাল্মিকীর করুণা-বিগলিত-হৃদয় রত্নাকরের বুকে প্রচ্ছন্ন না থাকত; রামায়ণের মর্ম্মস্পর্শী সঙ্গীত রত্নাকরের খুনে হৃদয়ের অন্তরতম স্তরে, অন্তঃশীলা ফল্গুর মত, গুমরিয়া গুমরিয়া ঝঙ্কৃত হ’তই হ’ত। নাবস্তনা বস্তসিদ্ধি:— nothing comes out of nothing.—ছেলেরা বেগতিক দেখে হেড্মাষ্টারকে খবর দিলে। হেডমাষ্টার গোপালকে ছুটি দিয়ে বাড়ী যেতে বল্লেন। গোপালের সেই ছুটীতেই ছুটি। সে অবধি “বাহাদুরী কার?” গোপালকে এই প্রশ্ন করলে গোপাল বলত—“তাই ত, কার বাহাদুরী? কে জানে কার? যার তারই হবে।”—ইত্যাকার অসংলগ্ন প্রশ্ন করতে করতে আপনার অন্তরের মধ্যে ডুবে তলিয়ে যেত।
নসীবাবু বল্লেন—‘গোপাল, বাহাদুরী কা'র বুঝতে পেরেছ?'
গোপাল নিরুত্তর থেকে একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললে; তার মুখে একটা নিদারুণ বিহ্বলতার ভঙ্গী ফুটে উঠল । তা’কে আর কোন প্রশ্ন করা চলল না।
নসীবাবু। মধু, আজ গঙ্গাস্নানে যাবে না?
মধুসূদন দাস, জাতিতে মুচি, বললে — “বাবু, আমাকে রাগাবেন না”; সে কিন্তু তা’র আগেই রাগে গর গর করতে সুরু করেছে।
নসীবাবু। চট কেন, মধুসুদন? এত লোক গঙ্গাস্নান করে, পতিতপাবনী গঙ্গা, গঙ্গায় নাইবে না ত কোথায় নাইবে?
মধু। এজ্ঞে, তা জাননা? বাবু, ছাস্তর জাননা? শোন, হদে লাইবে, লদে লাইবে, পকুরে লাইবে, ডোবায় লাইবে, পাতকোয় লাইবে, দামোদরে লাইবে, রূপলারাণে লাইবে,—গঙ্গায় লাইবে না, ছরস্বতীতে লাইবে না, পদ্মায় লাইবে না,— মেয়ে মানুষকে মাথার করবে? ছ্যা:
নসীবাবু। মধু, গঙ্গা যে মহাদেবের জটায় ছিলেন তা জান ত? মহাদেব কেমন করে' মাথায় কল্লেন?
মধু। পিরীতে, পিরীতে —
মাখন মধুসূদনের মুখের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিল; মধুর কথা শেষ হ’লে “পাগল রে” বলে' হেসে উঠল।
আমি কিন্তু এই ব্যক্তি চতুষ্টয়ের মানসিক ক্রিয়া— প্রতিক্রিয়ার মধ্যে পাগল ও সহজের সীমানির্দেশ করতে পারলুম না । লোকে এই লোকগুলোকে কেন পাগল বলে, আর তাঁরা নিজেই বা কিসে সহজ, তা'র বিচার আমি করতে অক্ষম। প্রচলিত চিন্তাস্রোতের যারা উজানে যায় তারাই পাগল, আর সেই স্রোতে গা ভাসান দিয়ে যারা আরামে ভেসে চলে তারাই সহজ, একথা কেহ স্বীকার করবে না। গড্ডলিকাবৃত্তি পরিত্যাগ করে' নূতন পথ আবিষ্কার করতে গেলে বা নূতন চীন্তার ধারা বহাতে গেলে, কখন্ মৌলিকতা ছাড়িয়ে পাগলামি এসে পড়ে, তা’ও আমি ঠিক বলতে পারলুম না। তবে আমি এই বুঝলুম যে হঠাৎ লোককে খ্যাপা বলা চলে না।
অবশেষে, যাঁরা নারীর মঙ্গল করবার জন্য, এবং সেই সঙ্গে পুরুষজাতির তথা মানবজাতির কল্যাণ সাধনের জন্য ব্যস্ত, তাঁদের এই মধু পাগলার কথাগুলি তলাইয়া বুঝিতে অনুরোধ করি। রমণীমাত্রেই দেবী বলিয়া তাঁহাদিগকে মাথায় করিবার প্রয়োজন নাই, তাহাতে প্রত্যবায়ই আছে। রমণীমাত্রেই যদি প্রচ্ছন্না দেবী হন, ত পুরুষ মাত্রেই প্রচ্ছন্ন দেবতা। বলা বাহুল্য, দুইটার একটাও সত্য নহে। তাই রমণীকেও বলি, আর পুরুষকেও বলি, মাথায় কাহাকেও বসাইও না; তবে “পিরীতে” যে খেলা খেলিতেই হইবে, তা’র চারা নাই ।