কমলাকান্তের পত্র (১৯২৩)/নিরুপদ্রবের শেষ

৩০

নিরুপদ্রবের শেষ

কি কল্লে কি হবে তা কেউ বলতে পারে না; অনেকে ভবিষ্যদ্বাণী করবার ধৃষ্টতা রাখে বটে, কিন্তু ফলাফল মিলিয়ে দেখলে কোন ভবিষ্যদ্বাণী হুবহু মিলেছে বলে’ আমার জানা নেই। সূর্য্য চন্দ্রের গ্রহণ বিষয়ে জ্যোতিষের formula আছে, সে formulaর কলে ফেলে সূর্য্যচন্দ্রের গ্রহণ পূর্ব্ব হ'তে গণনা করা যায় বটে, কিন্তু মনুষ্যজীবনে কি কল্লে কি হবে তা’র formula এ পর্য্যন্ত খুঁজে কেউ পায় নি ।

 আফিং খেলে মৌতাত হবেই এ পর্য্যন্ত কেউ ঠিক করে' বল্তে পারে না। আফিং খেলেও যে মৌতাত না হ'তে পারে তা’র প্রমাণ আমি কমলাকান্ত স্বয়ং— আমি একেবারেই ত এক ভরি ওজনে এসে পৌঁছাই নি, সর্ষপ পরিমাণ থেকে সুরু করে', ক্রমে মটর-ভর, তারপর “বদরী সম”, পরে “নবরঙ্গে” এসে দাঁড়িয়েছে; এই ক্রমোন্নতির কারণ হচ্চে পূর্ব্ব পূর্ব্ব অবস্থায় মৌতাত না হওয়া। অহিফেন সেবন রূপ অতি সহজ ও সরল ব্যাপারে যখন ভবিষ্যদ্বাণী চলে না, তখন এতদপেক্ষা জটিলতর ব্যাপারে যে কি কল্লে কি হবে কেউ বল্তে পারবে না তা’র আর আশ্চর্য্য কি? তবে, কি কল্লে কি হবে বলা শক্ত হ'লেও, কি করে' কি হয়েচে তা'র আলোচনায় ফল আছে; পূর্ব্বপক্ষ (antecedent) ঠিক জানা থাক্‌লে উত্তর পক্ষের (consequent) নির্ণয় হ'তে পারে। কিন্তু ইহ-সংসারে শত জটিলতার মধ্যে পূর্ব্ব পক্ষটাকে চৌচাপটে ধরা যায় না— এইজন্যই উত্তর পক্ষ সম্বন্ধে যা কিছু গোল হ'য়ে থাকে। History repeats itself এই যে কথা আছে, সেটা স্পষ্ট বুঝা যায় ঘটনার পর; তবে বুদ্ধিমানেরা বলেন, স্থির বুদ্ধিতে বিচার কল্লে ঘটনার পূর্ব্বেও কতকটা আভাষ পাওয়া যেতে পারে। আমি তাই জোর করে' কিছুই বলব না, আমার সিদ্ধান্তটা ভবিষ্যদ্বাণী বলেও যেন কেহ গ্রহণ না করেন।

 আমি কিছু দিন পূর্ব্বে সন্দেহ করেছিলুম—জার্ম্মাণি যে আমার অসহযোগনীতি গ্রহণ করে' আমাকে ও নীতিটাকে ধন্য করেচে সেটার শেষ পর্য্যস্ত মান রাখবে ত? আমি আরও বলেছিলুম, যে, গায়ের জোরের অভাব বলে' অর্থের খোঁটা ধরে' এখনও জার্ম্মাণ মেড়া লড়চে (এটা অবশ্য নিরুপদ্রব লড়াই), এ খোঁটা ভাঙ্গলে তা’র এ লড়াইও শেষ হয়ে যাবে। আমি তখন ভবিষ্যদ্বাণী করি নি, কিন্তু এখন দেখছি আমার কথাটা লেগেচে। জার্ম্মাণির প্রেসিডেণ্ট শেষ ঘোষণা কর্ত্তে বাধ্য হয়েচেন - In order to maintain the life of the people and the State we are to-day confronted with the bitter necessity of breaking off the fight (26 Sept. 1923).

 দোর্দ্দণ্ড–প্রতাপ জাতটাকে শত্রুর সঙ্গে নিরুপদ্রব অসহযোগ করে' শেষে রণে ভঙ্গ দিতে হ'ল, এর মধ্যে যে অদৃষ্টের পরিহাস রয়েচে সেটা বড়ই ক্রুর ও মর্ম্মভেদী। দেশাত্মবোধ, বুদ্ধি, উদ্যম, অর্থসম্পত্তি এসকলের সমবায়েও নিরুপদ্রব অসহযোগ কোন কাজেরই হ'ল না। রুরের শ্রমিকদের অর্থ দিয়ে বাঁচিয়ে রাখবার খরচ আর জার্ম্মাণি যোগাতে পাল্লে না; soul–force এর অভাব হয় নি, শেষে অর্থের অভাবেই সব চেষ্টা ব্যর্থ হ'য়ে গেল। প্রতি সপ্তাহে ৩৫,০০০ “trillion marks” হিসাবে অর্থ আর জার্ম্মাণি যোগাতে পাল্লে না, অসহযোগের অবসান হ'য়ে গেল। যাঁরা জার্ম্মাণ যুদ্ধের ইতিহাস পর পর দেখে এসেচেন, তাঁরাই বলবেন জার্ম্মাণি যে দিন হটে গিয়ে Hindenberg lineএর পশ্চাতে আশ্রম গ্রহণ করে' নিশ্চল হ'য়ে বসল, সেই দিনই তা'র পরাভব হ'য়ে গেছে—তারপর যতদিন যুদ্ধ চলেচে ততদিন সে ভেঙ্গেই পড়তে চলেচে; Versailles সন্ধিতে তা’কে একবারে নখদন্তহীন করে' বেঁধে ফেলা হ'ল; ফ্রান্সের দাবী মেটাতে সে পারলে না, বা চাইলে না — যাই বলুন, তারপরই রুর দখল হ’ল ও সেই সঙ্গে নিরুপদ্রব অসহযোগ আরম্ভ হ'ল। ফ্রান্সের টাকা দিতে বাধ্য হ’লে জার্ম্মাণির যে দুর্দ্দশা হবে, তা'র চেয়ে মৃত্যু ভাল, এই ভেবে জার্ম্মাণ-জাতি নিরুপদ্রব অসহযোগকে বরণ করে’ নিয়েছিল; কিন্তু নিরস্ত্রের সে অস্ত্রও নিষ্ফল হ'ল। জার্মাণিতে আজ সে নিস্ফলতার ফল হয়েচে— অরাজকতা, আর খণ্ড খণ্ড হ'য়ে ভেঙ্গে পড়া।

 যুদ্ধ-শাস্ত্রের একটা আইন আছে — Victory can only be won as the result of offensive action; এ সত্য সকল যুদ্ধেই প্রমাণিত হ'য়ে গেছে, এ কথার যাথার্থ্য সকল তর্কের অতীত হ'য়ে রয়েছে। অসহযোগ একটা প্রতিশেধক defensive action মাত্র। এ defensive action থেকে জয়শ্রী লাভ করা যেতে পারে না। অসহযোগ একটা মাঝামাঝি পথ—সাময়িক ব্যবস্থা মাত্র—তা' থেকে জয়শ্রীলাভ কেউ কখন করতে পারে নি।

 আমি একথা বল্তে চাই না যে অসহযোগ-নীতি অবলম্বিত হয়েচে বলে' আমাদের দেশেও আমি “নাশংসে বিজয়ায়”—তা'র দুটী কারণ, প্রথম, আমি ভবিষ্যদ্বক্তার আসন গ্রহণ করতে মোটেই রাজি নই, দ্বিতীয়, East is East and West is West—প্রতীচ্যে আগুনে হাত দিলে হাত পোড়ে বলে' প্রাচ্যেও তাই হবে কে বলতে পারে?


ইতি