২৯

ভদ্রলোক

ভদ্রলোক, ভদ্দরলোক, bhadralog, gentleman - এ সব কি একই পদার্থের ভিন্ন নাম? আমার যেন খটকা লাগে!

 শেষের দিক থেকে আরম্ভ করা যাক্ বিচার কর্ত্তে।

 Gentleman বোধ হয় সেই শ্রেণীর লোককেই বলে; যারা গতর খাটিয়ে খায় না, একটু জমী-জমা আছে বা ব্যাঙ্কে টাকা আছে, বা মস্তিষ্কে বুদ্ধি আছে বা বিদ্যা আছে—তাই থেকে চলে; অর্থাৎ দোকানদারী করে' বা মাটি খুঁড়ে শস্য উৎপন্ন করে’ যাদের পেট ভরাতে হয়, তা’রা এই gentleman পর্য্যায়ের একটু নীচে। তবে দোকানটা কিছু বড় রকমের হ’লে, এবং চাষের জমী একটু বিস্তৃত হ’লে, যখন সেটা যথাক্রমে হৌস্ বা জমীদারীর বিশালতা প্রাপ্ত হয়, তখন হৌসওয়ালা বা জমীদারকে gentleman পর্য্যায়ে স্থান দিতেই হয়, বা তা’র উপরেও দেওয়া চলে। কিন্তু সে বিশালতার পরিমাণ কি, তা'র কোন নির্দ্দিষ্ট মাপকাটি না থাকায়, মাঝে মাঝে একটু গোল হয়।

When Adam delved and Eve span
Who was then a gentleman?

 এই বহু পুরাতন প্রবচনের মধ্যে gentlemanত্বের সূক্ষ্মতত্ত্ব বর্ত্তমান রয়েছে। মাটি খুঁড়ে যখন পুরুষমাত্রেই শস্য উৎপন্ন করত আর স্ত্রীমাত্রেই চরকায় সূতা কাটত, তখন সমাজে gentlemanএর কোটায় কেউ ছিল না; তখন gentlemanএর সৃষ্টিই হয় নি। Gentlemanটা একেবারেই খুব হালি জিনিষ। কেউ কেউ বলেন ওটা খুব বাজে জিনিষ—সভ্য সমাজ-যন্ত্রের একটা অনাবশ্যক bye-product মাত্র।

 কেউ কেউ বলেন gentleman এর জাত নেই; অর্থাৎ সমাজের যে-কোন শ্রেণীর ভিতরে gentleman পাওয়া যেতে পারে। এ কথা আর যে কোন দেশে সত্য হ’ক, আমাদের দেশে হ'তে পারে না। যাদের বামুন-শূদ্র জ্ঞান আছে, অর্থাৎ হ্রস্ব-দীর্ঘ বোধ আছে, তা'রা একথা কোনক্রমেই মানতে পারে না। যারা ছাতু খায়, বা পকাল ভাত, বা পরিষ্টি ভাত খায়, মালকোছা মেরে কাপড় পরে, বা পাঁচি ধুতি পরে’, সুধু পায়ে, সুধু গায়ে থাকে, তা’রা কি gentleman হ'তে পারে?

 আমি কলকাতায় এক মেসে দিন কতক বাস করে' এসেছি— মেসের পাশে একটা মস্ত তেতলা বাড়ীতে এক মস্ত ধনী পরিবার বাস করতেন, তেতলা ঘরের জানলায় অনেক সময় মা-লক্ষ্মীরা একটু বে-আবরু ভাবে দাঁড়াতেন বসতেন,—২০।২৫টা ওরম্বা যুবাকে ভ্রূক্ষেপ না করে'। একদিন শুনা গেল এক বৃদ্ধা ঝি, বাতায়নে দণ্ডায়মানা এক যুবতীকে বলচে,— সরে এস, মেসের ছেলেগুলোর সুমুখ থেকে— যুবতী। ওদেরকে আবার লজ্জা কিসের? ওরা যে বাসাড়ে,— শুরা ঝি না এলে বাসন মাজে, ঠাকুর না এলে রাঁধে। ওদের দেখে বুঝি আবার লজ্জা করতে হবে?

 মা লক্ষ্মী বোধ হয় gentlemanকে লজ্জা করতে প্রস্তুত, কিন্তু যারা ঝি-চাকরের মত বাসন মাজে বা রাঁধে তা’রা কি gentleman হ'তে পারে? ঠিক বলচেন মা আমার!

 কিন্তু কথা হচ্চে এই যে—লাঙ্গল ঠেল্‌লে, আর চরকা কাটলেই, এবং উপরোক্ত মাতাঠাকুরাণীর হিসাব—মত বাসন মাজলে বা রাঁধলেই যদি gentleman সম্প্রদায়ের নীচে যেতে হয়, তা হ'লে সে সব কাজ না করে' যদি দিনগুজরাণ হয়, তা হ'লেই কি gentleman হওয়া চলে?

 এই ধরুন,—চোর ডাকাতের কথা বাদ দিয়ে—আমি কমলাকান্ত চক্রবর্ত্তী, আমার জমী নেই, জমা নেই, ব্যাঙ্কে টাকা নেই, মাথায় যে খুব বুদ্ধির প্রাচুর্য্য আছে তা’ও নয়, আমি আকাশের পাখী, বনের পশু ও জলের মাছের মত do not sow, nor do I reap -আমি মাটি কাটি না, চরকা ত কাটিই না (গান্ধীজীর হুকুমেও নয়, কিম্বা স্বতঃপ্রবৃত্ত হ'য়েও নয়), চুরি-চামারীও করি না -অথচ আমার পেট চলে, নির্ভাবনায় দিন কেটে যায়, আমি gentleman কি না? ইংরাজিতে mendicant বলে' একটা কথা আছে, আমাকে হয়ত সেই শ্রেণীরই ভেতর ফেলা হবে; তা হ'লেই বিচারটা একটু জটিল হ'য়ে আসচে—

 আমি কিন্তু প্রমাণ করে’ দেব যে, ঐ mendicant আর gentleman এই দুইই এক শ্রেণীর জীব। উভয়েই চাষ করে না, মুদিখানার দোকান করে না, চুরি করে না, অথচ পায়ের উপর পা দিয়ে বসে' খায়। উভয়েই নির্ভাবনা, কিন্তু উভয়েই ভিক্ষুক। জমীদার ভিক্ষা করে খাজনা, আর ভিক্ষুক ভিক্ষা করে অনুগ্রহ; একজন জোর করে' চাইতে পারে, আর-একজন আস্তে চায়, ভয়ে ভয়ে চায়—এই তফাৎ। কিন্তু পাওয়াটা সম্পূর্ণরূপে দাতার অনুগ্রহের উপর নির্ভর। প্রজা যদি না দেয়— Civil disobedience করে’ বসে—আর দাতা যদি মুটো না খোলে, তা হ'লে gentlemanও পায় না, mendicantও পায় না। অতএব দুইই এক। তবে লোকে gentlemanকে অর্থাৎ জমীদারকে, ধনীকে একটা জাঁকাল নাম দিয়েচে এবং খাতিরও করে — সেটা একটা কালক্রমাগত কু-অভ্যাস ভিন্ন আর কিছুই নয়।

 “খদ্দর পরে’ ভদ্দর’ হবার যে একটা ধুয়া উঠেছে, সেটার ভিতর একটা তত্ত্ব আছে। ব্যবহারিক জীবনে বাহিরটা দেখে খানিকটা ভিতরটার অবস্থা আন্দাজ করে’ নিতে হয়।তা’তে অনেক সময় ভুল হবার সম্ভাবনা থাকে; আর এই সম্ভাবনার advantage লোকে নিতে চায়; টিকি রেখে, শামুকের খোলকে নস্যির ডিপে করে' পণ্ডিত, লপেটা পরে' বাবু, আর খদ্দর পরে' ভদ্দর —এ সবই একই শ্রেণীর প্রক্রিয়া। “ভদ্রলোক” বলতে এই “কাপুড়ে” ভদ্রলোকই বুঝতে হবে অধিকাংশ স্থলে।

 বাঙ্গালা অভিধান খুলে দেখলুম যে, ভদ্র মানে “সুবর্ণ”, আর ভদ্র মানে “ষাঁড়”। এই দুই অর্থের সঙ্গে আমাদের অধুনা প্রচলিত ভদ্রের কি সম্বন্ধ, বিচার করা দরকার হয়েচে।

 ভদ্র মানে সোণা, অর্থাৎ যাঁদের সোণা আছে তাঁরা ভদ্র; পয়সা থাকলেই ভদ্র, এ ত একটা প্রচলিত acceptation, পয়সা থাকলেই বাহিরটাকে চূণকান করে’ ভিতরের কালি ঢাকা দেওয়া যায়, সুতরাং যে কোন উপায়ে সুবর্ণের সংস্থান কর্ত্তে পারলেই, ভদ্দর হওয়ার পথ পরিষ্কার হ'য়ে যায়। যাঁরা বলেন পয়সা থাকলেই ভদ্দর হয় না, তাঁরা নিজে সে রসে বঞ্চিত বলেই বলেন।

 আর ভদ্র মানে ষাঁড়—উক্ষা ভদ্রো বলীবর্দ্দঃ ঋষভো বৃষভো বৃষঃ ইত্যমরঃ—অর্থাৎ সেই ভদ্র যে ঘাঁড়। এ অর্থ কোথা থেকে এলো তা'র তত্ত্ব আবিষ্কার করতে হয়। মনুষ্য-গোষ্ঠীর একটা অবস্থা ছিল, যখন শরীরের বলই ছিল মুলাধার; যা'র ষাঁড়ের মত গোঁ ছিল, গুঁতোবার শক্তি ছিল, সেই ছিল মানুষ, আর সব অ–মানুষ; আর তা'র শিংএর প্রতি সেলাম দিয়ে লোকে বল্ত-ভদ্র, ভাল মানুষ, শ্রেষ্ঠ মানুষ, মনুষ্য-শ্রেষ্ঠ। বল ছিল ভদ্রতার অর্থাৎ শ্রেষ্ঠত্বের লক্ষণ,— তাই ভরতর্ষভ, বলভদ্র, বীরভদ্র এই সব নাম হ'য়েচে। এই অর্থে ভদ্র কথাটা ব্যবহার হ’তে আরম্ভ হ'লে, কমলাকান্তর বড় সুবিধা হবে না- তা না হ’ক, আমি অভদ্রই হব, যদি আর সকলে এই অর্থে ভদ্র হয়।