কমলাকান্তের পত্র (১৯২৩)/স্কুল-মাষ্টার না মোশন-মাষ্টার
২৮
স্কুল-মাষ্টার না মোশন-মাষ্টার
স্কুল-মাষ্টার আর মোশন-মাষ্টার একই পদার্থ; একজন রঙ্গমঞ্চে হস্তপদ সঞ্চালন কর্ত্তে, গর্জ্জন কর্ত্তে শেখান, আর-একজন জীবনরঙ্গমঞ্চে নানা ভঙ্গীতে নর্ত্তন কুর্দ্দন করতে শিখিয়ে দেন। জীবনটা যে অভিনয় মাত্র, আর অভিনয় ত অভিনয় বটেই, এইটা মাষ্টার-যুগলে যথাক্রমে ছাত্রগণকে শিখিয়ে থাকেন; তা’তে রঙ্গমঞ্চের অভিনয়ের কোন উন্নতি হ'ক আর নাই হ’ক, এই “সঙ্-সার” অভিনয়টা
বাতুলের গল্প এ জীবন
অর্থহীন মাত্রবহু-বাক্য-আড়ম্বর,
এই কথার সার্থকতা সম্পাদন করে।
একজন বিশিষ্ট ইংরাজ নট সম্বন্ধে স্তুতিগান করে' বলা হয়েছে — We loved Hawtrey (Sir Charles Hawtrey) so much because he was “such a lovely liar”. He lied with such perfect plausibility and success that- altho' one knew it quite well-one forgot that the whole of the lines had been written for him. He always appeared to be rolling his tarradiddles out from his inner consciousness. Which, of course, was where the art of the man came in.
রসঙ্গ দর্শক বলচেন—Hawtreyর অভিনয় দেখতে দেখতে ভুলে যেতে হয় যে অভিনয় দেখচি; বাক্য-স্রোতটা তা'র যেন অন্তরতম সত্তার ভিতর থেকে উথলে উঠচে; কিন্তু বস্তুতঃ সে আরএকজনের রচিত ছত্রগুলিই আবৃত্তি করচে মাত্র; এ থেকে বল্তেই হয় —Hawtrey একজন “lovely liar".
আমাদের স্কুলে (আমি কলেজ বা Post-graduate ও তা’র মধ্যে ধরে নিয়েচি) স্কুল-মাষ্টার এই “lovely-liars” সৃজন করে’ সংসার-রঙ্গমঞ্চে ছেড়ে দিচ্ছেন। অভিনেতৃগণের অভিনয় যতই স্বাভাবিক মনে হ’ক না, তাঁদের বক্তৃতা স্রোত যতই বেগে তাঁদের অন্তরতম সত্তার মধ্য থেকে উৎসারিত হ’ক না, এক মুহূর্ত্তের জন্যও ভোলবার দরকার নেই যে “the whole of the lines had been written for him."
এই অভিনয়ের rehearsal প্রতিদিন স্কুল কলেজে হ'য়ে থাকে। স্কুল কলেজগুলো সে অর্থে—আখড়া ঘর, আর স্কুল-মাষ্টার সুধু—মোশন-মাষ্টার। মেস্, ক্লাব ইত্যাদিতে যে “সাঁঝে সকালে” তর্ক বিতর্ক—সান্ইয়াট সান্ থেকে C. R. Das পর্য্যস্তকে নিয়ে রে তর্ক কচ্কচি,—ত্যাগ, স্বাধীনতা, policy, politics, স্বদেশী, Non-Co-operation এ সমস্ত কথার বিচারবিশ্লেষণ হয়—সে কেবল part মুখস্থ করা মাত্র। যেহেতু এ সমস্ত বীর্য্যবান বক্তৃতা ইত্যাদি জীবন-রঙ্গমঞ্চে অভিনয়েরই সহায়তা করে’ থাকে।
আমি সে দিন এক M. A. ছাত্রের সঙ্গে কথা কচ্ছিলুম, তিনি Economics নিয়েচেন; তাঁকে প্রশ্ন কল্লুম— বাপু এই যে Fiscal Commission বসল, তা'রা কি মীমাংসা কল্পে কিছু জান? বাছা আমার অনেক মাথা চুল্কে উত্তর দিলেন-আজ্ঞে আমাদের Professor এখনও Note দেন নি। অর্থাৎ মোশন-মাষ্টার এখনও মোশন দেন নি, অতএব বাছা এখনও অচল।
আর-একটি ছেলে Anthropology নিয়েচেন M.A.তে; একজন অধ্যাপকের সঙ্গে সেই বিষয়ে কথা কচ্ছিলেন; আমি ঝিমুচ্ছিলুম, তথাপি এই কথাগুলো কানে গেল—
অধ্যাপক। এত-দেশ থাক্তে Anthropology নিলে কেন হে?
ছাত্র। কি জানেন, বিষয়টা নতুন, পাস কর্ত্তে পারলে একটা Professorই লাগ্তে পারে।
সুতরাং তাঁর Anthropology পাঠটা পার্ট মুখস্থ ভিন্ন আর কি? এই নতুন বলে', দিনকতক Commerce, Commerce করে' ছেলেরা খেপল; উদ্দেশ্য ব্যবসা করা নয়, কারণ সে পথে ব্যবসা শিক্ষা হয় না, প্রফেসারি জুটতে পারে এই আশা। তবেই হ'ল, রঙ্গমঞ্চে ভীম সাজা, ভীম হব বলে' নয়, ভীমের জন্য লিখিত রক্তৃতা আবৃত্তি করে' বাহবা ন'ব বলে'; তেমনি Commerce পড়ব ব্যবসা করব বলে' নয়, Commerce সম্বন্ধে বুলি কেটে, অর্থাৎ lecture দিয়ে, পয়সা রোজকার করব বলে'।
একজন যাত্রায় হনুমান সেজেছিল; পাছে কেউ তা’কে সত্যি হনুমান মনে করে' ফেলে, সে জন্য হুপ্, হাপ্, করতে করতে সে বলে’ উঠল— “মহাশয়রা গো, আমি সেজিচি, আমি সত্যিকারের হনুমান নই; অধিকারী মহাশয় আর লোক পান নি তাই আমায় সাজিয়েচেন।” লোকটার বোধ হয় একটু মাথা খারাপ ছিল; নহিলে অভিনয়ের মধ্যস্থলে তা'র স্বরূপ জাহির করবার প্রবৃত্তি আসবে কেন? আমাদের এই সংসার-রঙ্গমঞ্চে যে অভিনয় হয়, রামেরই হ’ক বা রামানুচরেরই হ’ক, তা’কে চিনে নিতে কারও বেশী দেরী হয় না; কিন্তু তাদের মধ্যে এমন মাথা খারাপ কেউ নেই যে অভিনয় পণ্ড করে' নিজমূর্ত্তি জাহির করেন—সেটা অভিনয় শেষে সাজ-ঘরের জন্যই তোলা থাকে।
এই সাজ-ঘরটা কোথা? যেখানে অভিনেতা নিজ মূর্ত্তিতে সপ্রকাশ হ'ন, যেখানে সত্যিকারের আঁতের কালি ফুটে ওঠে, যেখানে শেখা-বুলি বা মুখস্থ partএর আবৃত্তি মোটেই চলে না— সে সাজঘর কোথা? আর কোথা - যেখানে চোগা চাপকান, হ্যাট কোট, তিলক টিকি, গান্ধী-টুপী পর্য্যন্ত খুলে ফেলে “ঘৃত-লবণ-তৈলতণ্ডুল-বস্ত্রেন্ধন-চিন্তয়া” সতত ব্যস্ত থাকতে হয়, যেখানে কথায় চিঁড়ে ভেজে না, চিঁড়ে জোটেও না,—যেখানে যা’র ভিতর যতটুকু শক্তি আছে, যতটুকু বুদ্ধি আছে, যতটুকু হৃদয় আছে, তা’রই মাপে সুখদুঃখ মিলে,— যেখানে ভিতরকার মানুষটা উলঙ্গ হ’য়ে আত্মপ্রকাশ কর্ত্তে বাধ্য হয়,—সেই গৃহস্থলীই হ'ল সাজঘর, সেখানে সাজ খুলে কথা কইতে হয়, সেখানে আর মেকি চলে না! স্ত্রী, পুত্র, জননী, দুহিতার কাছেও যে অভিনয় কর্ত্তে পারে সে জবর অভিনেতা বটে; কিন্তু তেমন অভিনেতা স্বর্গে মর্ত্যে নাই।
সেই সাজঘরের বাহিরে এই সংসার-রঙ্গমঞ্চে যা কর তা শোভা পাবে, রাজাই সাজ আর ঋষিই সাজ মানিয়ে যাবে, লোকে মেনেও নেবে; কেননা “কানা, মনে মনে জানা”, সকলেই সেজেচে, তুমিও সেজেচ; অভিনয়ের বাহাদুরী পাবে; যদি নিন্দাই জোটে, সেও অভিনয়ের গলদের জন্য। তাই কাউন্সিলে radical সেজে যে ঘরে এসে ultra conservative হও, সমাজ সংস্কার নিয়ে বক্তৃতা করবার সময়, “ঝাড়ে বংশে” (root and branch) উৎপাটনের উপদেশ দিয়ে, দুধের মেয়ের বিয়ে না দিতে পারলে যে অস্থিরতা প্রদর্শন কর,—কাগজে-কলমে বাল-বিধবার দুঃখে নয়নের জলে বুক ভাসিয়ে, বিধবা ভগ্নীর বা কন্যার দুঃখ যে চোকে ঠেকে না,—কথায় কথায় সাম্য মৈত্রীর ধুয়া তুলে, সামাজিক ব্যবহারে যে ব্রাহ্মণ বলে' ফুলে ওঠ, বা শূদ্র বলে' নাক সিটকাও - এ সব কেবল স্কুল-মাষ্টারের কাছে part মুখস্থ করেছ বলে'। কাউন্সিল বল, বক্তৃতামঞ্চ বল, সংবাদ পত্র বল, কোথাও তোমার ভিতরকার মানুষটা জোর করে' আত্মপ্রকাশ করে না, তুমি সুধু সর্ব্বত্র অভিনয়ই করে' যাও। সকলে তা বুঝতে পারে, তবু অভিনয়ের বাহাদুরী যদি কিছু থাকে তা’রই বাহবা তোমার প্রাপ্য, তাই তুমি পেয়েও থাক।
কিন্তু কথা হচ্চে এই—যাদের দেশের বিদ্যা নিয়ে তুমি নাড়াচাড়া কর, তাদের দেশের ছেলেরা ত সেই বিদ্যা নিয়েই সসাগরা পৃথিবীটাকে মুঠোর ভেতর করবার মত শক্তি লাভ করে; তুমিও সেই বিদ্যা জীবন-পণ করে' অর্জ্জন কর, কিন্তু কোন্ দেবযানীর অভিসম্পাতে সে বিদ্যার প্রয়োগ কর্ত্তে পার না? তা’রাও Science পড়ে, Economics পড়ে, Anthropology পড়ে, তাদের সে বিদ্যা অস্থি-মজ্জায় প্রবেশ করে' তাদের শক্তিশালী করে’ তোলে, আর তোমাকে সুধু নটের নিপুণতা ছাড়া আর কিছু দেয় না কেন?
একজন পণ্ডিত এই রকম প্রশ্নের উত্তরে বলেচেন The divorce of our actual life from the life of our ideas has made us a race of neurasthenics, অর্থাৎ আমাদের প্রকৃত জীবনগতি আমাদের ভাব সম্পদের সঙ্গে খাপ খাচ্চে না বলে' আমরা বায়ু রোগগ্রস্ত হ'য়ে পড়েচি। আমরা ভাবটা নিচ্চি পাশ্চাত্য পুঁথি থেকে, আর আমাদের জীবনটা গড়ে উঠেচে আমাদের অতীতের সংস্কার সমষ্টি নিয়ে,— এই দুটাতে মিল্চে না বলে’ আমাদের শরীরে বায়ুর প্রকোপ কিছু বেশী হ'য়ে উঠেচে । সকলেই জানেন নট-নটী মাত্রেই একটু বেশীমাত্রায় neurasthenic—একটু বায়ুগ্রস্ত। উক্ত পণ্ডিতের মতে আমাদের মধ্যে a real sense of independence in both thought and action আনতে হবে, তা হ'লেই বায়ুর সমতা হ'য়ে আমাদের actual life এর সঙ্গে আমাদের ideas মিলে যাবে।
পণ্ডিতজী রোগটা ধরেচেন ঠিক, আর দাওয়াইও ঠিক বাত্লেচেন; কিন্তু সম্পূর্ণ দাওয়াইটা বাত্লান নি। নূতন idea এসে আমাদের বহুবার আক্রমণ করেছে; সিকন্দর থেকে আরম্ভ করে’ বুদ্ধ চৈতন্য পর্য্যন্ত অনেকবার নূতন idea আমাদের ঘা দিয়েচে—কিন্তু সে সব ideaকে আমরা আপনার করে' নিয়েচি—আমাদের জীবনের মধ্যে খাপ খাইয়ে নিয়েচি —কিন্তু এখন আর পাচ্ছি না কেন? তা’র উত্তর, জীবন ছিল তাই আয়ত্ত করেছি—বিষ খেয়েও নীলকণ্ঠ হ'য়ে বেঁচেছিলুম—বেদ ছেড়ে বৌদ্ধ হ'য়েও সসাগরা পৃথিবী জয় করেছি—এখন জীবন নেই, তাই বাহিরের জিনিষ আর ভেতরে যায় না, রক্তের সঙ্গে মেশে না—এ যেন মড়ার গায়ে injection করা—যেখানকার injection সেইখানেই থাকে।
এখন বাঁচার উপায় কি? বাচার উপায়—independence in both thought and action; কিন্তু সে independence আসে কোথা থেকে? চিন্তার স্বাধীনতা কতক সম্ভব, কিন্তু কার্য্যের স্বাধীনতার ক্ষেত্র কোথায়? সত্যিকারের কার্য্যের ক্ষেত্র নেই, তাই অভিনয় করে' দুধের সাধ ঘোলে মেটাতে হচ্চে।