কমলাকান্তের পত্র (১৯২৩)/প্রসন্ন গোয়ালিনীর আধ্যাত্মিকতা
২৭
প্রসন্ন গোয়ালিনীর আধ্যাত্মিকতা
প্রসন্ন দুধে জল দেয়, আর খাঁটি দুধ বলে' বিক্রী করে; জিজ্ঞাসা করলে গাল দিয়ে ভুত ছাড়িয়ে দেয়; আবার বার মাসে তের পার্ব্বণ করে, ষষ্ঠী থেকে ওলারিবি পর্য্যন্ত কেউ বাদ যায় না; বারব্রত করে, তা’র উপর দরিদ্র ব্রাহ্মণের সেবাও করে, মুষ্টিভিক্ষাও দেয়। এখন প্রসন্নকে materialism গ্রস্ত বলব, না spiritual বলব, এই হচ্চে প্রশ্ন। এই প্রশ্নের মীমাংসা করতে পারলে, একটা বড় রকম প্রশ্নের মীমাংসা হ'য়ে যাবে, সেটা হচ্চে এই—ইউরোপ বলতেই material, আর এসিয়া তথা ভারতবর্ষ বলতেই spiritual একথাটা সত্য কি না, বা কতখানি সত্য তা’র মীমাংসা হ'য়ে যাবে।
কেউ কেউ বলতে পারেন, প্রসন্ন কি একটা type, প্রসন্ন কি Asiatic তথা ভারতবর্ষীয় চরিত্রের epitome, যে প্রসন্ন-চরিত্র আলোচনা করে' কোন সিদ্ধান্তে উপনীত হ'লে, সমগ্র Asia বা ভারতবর্ষে খাটবে? প্রথমে ত সন্দেহ উঠতেই পারে যে প্রসন্ন মেয়েমানুষ, অতএব তা'র চরিত্র আধখানা Asia বা আধখানা ভারতবর্ষের সঙ্গে মিলতে পারে, আর আধখানার সঙ্গে মিলবে না, একথা ত ধরেই নেওয়া চলে।
তোমরা প্রসন্নকে চেননা, তাই এই অর্বাচীনের আপত্তি তুলচ। আমি প্রসন্নকে জানি, চিনি—আমি বলছি, প্রসন্ন পুরুষও বটে নারীও বটে। সে যখন তা’র পাওনা-গণ্ডা আদায় করে, তখন সে কাবুলীওয়ালারও কান কেটে দেয়; মঙ্গলা যখন গোঁজ উপড়ে চোঁচা দৌড় দেয়, তখন তা'র দড়ি গাছটা ধরে' যখন সে তাকে stand still করে, তখন রামমূর্ত্তির মোটর-গাড়ী ধরা মনে পড়ে; সে পঞ্চাশটা খদ্দেরের দুধের হিসাব, যখন মুখে মুখে করে' দিয়ে balance sheet মিলিয়ে দেয়, তখন তা'কে কৃষ্ণলাল দত্তের পাশে স্থান না দিয়ে থাকা যায় না; আর পাড়ায় শ্বাশুড়ী-বৌএর ঝগড়ার বিচার কর্ত্তে কর্ত্তে, যখন সে পরস্পরের কর্ত্তব্য-অকর্ত্তব্যের বিশ্লেষণ করে’, দোষগুণের ওজন করে’, কোন অদৃশ্য জুরীর সমক্ষে charge দিতে থাকে, তখন তা'কে দায়রার জজের আসনে বসাতে ইচ্ছে করে; তারপর, অন্দর-মহলে যখন মেয়েদের মিছিল বসে, সুনীতি দুর্নীতির বিচার হয়, মেয়ে-পুরুষের চরিত্রগত কত কূট তর্কের বিশ্লেষণ হয়, কতক কথায়, কতক ছড়ায়, কতক কবিতায়, কতক গানে, কতক ইঙ্গিতেইসারায়, বোসেদের ঘোষেদের কুণ্ডুদের পালেদের চাটুয্যে-বাঁড়ুয্যেদের,— সমস্ত গ্রামটারই, পুরাবৃত্তের আলোচনা হয়, অতীত বর্ত্তমান কীর্ত্তি-অকীর্ত্তীর গবেষণা হয়, তা’তে প্রসন্ন, গয়লা বৌ হ'লে কি হয়, সে democratic সভায়, তা’র কত জানা-অজানা তথ্যের সম্ভার নিয়ে যখন বসে, তখন সে যে তত্ত্বজিজ্ঞাসু পুরুষ মহলের বিচার-সভার মর্য্যাদা রক্ষা কর্ত্তেও সক্ষম, তা’র ভূরি ভূরি প্রমাণ দিয়ে থাকে। তারপর সে যখন গললগ্নীকৃতবাস হ'য়ে গ্রামের শিব মন্দিরের উঠানে ভূমিষ্ঠ হ'য়ে প্রণান করে, তা'র তিন কুলে কেউ নেই, তবুও সে যে কার জন্যে মাথা খোঁড়ে তা বুঝে উঠতে না পারলেও, তা'র দেবতার প্রতি অগাধ ভক্তি সম্বন্ধে কোন সন্দেহই করতে পারা যায় না।
অতএব প্রসন্নকে, মেয়েমানুষ হ'লেও, type ধরে' নিলে ন্যায়ের মর্য্যাদা ক্ষুণ্ণ হবে না, এটা আমি বলতে পারি। তবে আমি ইংরাজিশিক্ষিত লোকগুলোকে একেবারে বাদ দিচ্চি; তা'র প্রথম কারণ, তা’রা ইংরাজি জানে, প্রসন্ন ইংরাজি জানে না, সুতরাং প্রসন্ন তা'দের type বা প্রতীক হ’তে পারে না। দ্বিতীয় কথা, ইংরাজি শিক্ষিতগুলো, দুধে যেমন একটী ফোঁটা অম্ল বা গো-মূত্র পড়লে দুধ কেটে যায়, তা’রা তেমনি দু’পাতা ইংরাজি পড়ে’ কেটে গেছে, জমে গেছে, বা ছিঁড়ে গেছে—যাই বল; সেগুলো না এদিক না ওদিক, বৈদিক হ'য়ে গেছে। তৃতীয় কথা, এই ইংরাজি শিক্ষিতগুলো যে সব-কথা তলিয়ে বোঝবার আস্ফালন করে, সেই আস্ফালনই spiritualityর পরম অন্তরায়। অতএব ইংরাজির অম্লরস থেকে spiritualityর ক্ষীর সমুদ্রকে রক্ষা করতে হ'লে, ইংরাজি নবীশগুলোকে বাদই দেওয়া উচিত বিধায় তাদের আমি বাদ দিলুম! কেউ যেন মনে না করেন, আমি স্বয়ং ইংরাজিতে অষ্টরম্ভা বলে' এই কার্য্য করলুম। তা নয়, যেহেতু আমি যথেষ্ট কারণ না দেখিয়ে বাদ দিই নি।
আধ্যাত্মিকতার প্রতিমূর্ত্তি যদি পুরোহিত ঠাকুরকে ধরা যায় তা হ'লে কারও আপত্তি হবে কি? আমি সেই প্রতিমূর্ত্তির সঙ্গে প্রসন্নর তুলনা করে' দেখিয়ে দেব যে, দুইই হুবহু মেলে। আধ্যাত্মিকতা বা spiritualityর প্রথম লক্ষণই হচ্চে—তলিয়ে বোঝবার স্পর্দ্ধা না রাখা; তাঁর তা' আছে—তিনি মন্ত্র বলেন তা’র মানে বোঝেন না, ভাষার অর্থ হয়ত কিছুকিছু বোঝেন, অর্থের তাৎপর্য্য মোটেই বোঝেন না। যদি কেউ বোঝবার জন্য, তাঁকে পরীক্ষা করবার জন্য নয়, তাঁকে প্রশ্ন করে, তা’তে তিনি অগ্নি-শর্ম্মা হ'য়ে ওঠেন,—এ সবই spiritualityর লক্ষণ; আর এসবগুলিই প্রসন্নতে বর্ত্তমান—প্রসন্ন দুধে জল দেয়, খদ্দেরকে ঠকাবার মতলবে যে দেয় তা যেন কেউ মনে না করেন, গয়লা বংশের কৌলিকপ্রথা তাই দেয়। সে বলে, যে দুধে জল দেয় না সে গয়লা নয়, অতএব তা’র জাতের মান রাখতে হ'লে তা’কে জল দিতেই হবে। কিন্তু “কেন জল দিয়েছ” এই নিতান্ত অবান্তর প্রশ্ন যদি কেউ করে, তা’র মুখের ‘আব্বি' থাকে না। ‘কেন’র উত্তর কেউ দেবে না—পুরুতও না, প্রসন্নও না। পূজা, বার ব্রত, দান ধ্যান এ সব বিষয়েই তা'র মনের অবস্থা একই—বোঝে না কিন্তু করে’ যায়, অতএব সে spiritual! সমধর্ম্মী বলেই প্রসন্নর সঙ্গে এবং প্রসন্ন যাঁদের type তাঁদের সঙ্গে, পুরুত ঠাকুরের বনে ভাল; পুরুত ঠাকুরও পদ্মলোচন—প্রসন্নও পদ্মলোচন, দু'জনে জীবনের পথে হোঁচট খেতে খেতে চলেন ভাল। পুরুতঠাকুর এমন certificateও দেন যে, প্রসন্ন আছে বলে' ধর্ম্ম আছে; ধর্ম্মটা প্রসন্নরাই রেখেচে, না হ'লে, পুরুতঠাকুরের ব্যবসাও মাটি হ’ত, আর সেই সঙ্গে সমাজ, দেশ ইত্যাদি সব ছড়িয়ে পড়ত; এখনও যে ছড়িয়ে পড়ে নি সেটা Priest cum Prasanna এই entente cordiale বর্ত্তমান আছে বলে'।
আমাদের এই কৃষিপ্রধান দেশের প্রাণ যে চাষী, তা'র চরিত্র দেখে বিচার করলে, প্রসন্ন ঠিক তা’রই মত spiritual প্রমাণ হ'য়ে যাবে। প্রথম সে সাহেব দেখলে পালায়; লোকে বলে ভয়ে, আমি জানি ম্লেচ্ছসংস্পর্শে তা’র spirituality নষ্ট হ'য়ে যাবে এইজন্য। প্রসন্নও, যে পথ দিয়ে সাহেব চলে’ যায়, তিন দিন সে সে-পথে চলে না; লোকে বলে ভয়ে, আমি জানি তা'র ভয়ের বয়স গেছে, তথাপি পাছে ম্লেচ্ছসংস্পর্শে তা’র গয়লা-বংশ অপবিত্র হ'য়ে যায় এই আশঙ্কায় । চাষা ভায়া ধানচাল বেচেন pile করে,’— ডাল বেচেন ধুলা ও মাটি মিশিয়ে ভারি করে', পাট বেচেন জলে ভিজিয়ে; প্রসন্ন দুধ বেচে জল মিশিয়ে, অতএব দুই তুল্য মূল্য। এবং উভয়েই যথাক্রমে গঙ্গাজল ছিটিয়ে গৃহের পবিত্রতা সম্পাদন করেন, এবং লক্ষ্মীপূজা করে', ষষ্ঠীপূজা করে, পুরুত ঠাকুরকে দক্ষিণা দিয়ে আত্মাকে disinfect করেন; অতএব প্রসন্ন আধ্যাত্মিকই প্রমাণ হ'য়ে যাচ্ছে ।
দেশের ব্যবসাদার—মাড়োয়ারী থেকে আরম্ভ করে’ চুনোপুটি জেলে-মালা পর্য্যন্ত— সবাই “ধম্ম” করেন, পূজা করেন, পাঠ করেন, রামায়ণ শুনেন, কীর্ত্তন করেন, গোমাতার জন্য পিঁজরাপোল করে’ দেন, খট্ম্ল পিলান,—আর ঘিয়ে সাপের চব্বি মিশিয়ে মানুষ ভাইকে খেতে দেন, দরকার মত গণেশ উল্টান, ব্যবসা চলতি হ’য়ে গেলেই মালে খাট করেন, পরদ্রব্যেষু লোষ্ট্রবৎ, পরের টাকাকে খোলামকুচি জ্ঞান করে’ তা নিয়ে ছিনিমিনি খেলেন। কামার, কুমার, শেকরা, ময়রা ভাই সকল বিশ্বকর্ম্মার পূজা করেন, হাতুড়ি ছেনি নিক্তি ইত্যাদিকে গড় করেন, আর চোখের আড়াল হ'লেই কাজে ফাঁকি মারেন, ওজনে কম দেন, ভেল্সা-ভ্যাজাল চালাতে পাল্লে আর বিশ্বকর্ম্মাকে মনে থাকে না। প্রসন্ন এ সবই যথারীতি করে' থাকে— কে জানে ডোবার জল, আর কে জানে পতিকোর জল, দুধের সঙ্গে মিশিয়ে কচি ছেলের বিষ তৈরী করে' বেচেন, নূতন খদ্দেরকে দু'দিন একটু রং রেখে দুধ দিয়েই নিজমুর্ত্তি ধারণ করেন, দুধও নিজমূর্ত্তি ধরে', মাপে মারেন, পারলে হিসেবেও মারেন। আর এই সব ব্যবসাদারীর হজ্মিগুলি হিসাবে পূজাপাঠ, বারব্রত এ সবই চলতে থাকে। অতএব প্রমাণ হ'য়ে গেল, প্রসন্ন typeও বটে, spiritual typeও বটে।
তারপর প্রসন্ন যাদের, constructive নয়, literal type, অর্থাৎ আমাদের দেশের নারীকুল, তাঁদের আধ্যাত্মিকতা সম্বন্ধে পুরুত ঠাকুর যে certificate দিয়েছেন তা’র উপর ত আর কথা নেই—তাঁরা আছেন বলে' ধর্ম্ম আছে, আর তা'র আনুসঙ্গিক যা কিছু আছে। তাঁরা হাঁচি টিকটিকি মানেন, বিষ্যুৎবারের বারবেলা মানেন, অশ্লেষা-মঘা মানেন তাই এত বড় জ্যোতিষ-শাস্ত্রটা বেঁচে আছে, ষষ্টি-মাকাল মানেন তাই তেত্রিশ কোটী দেবতার খোরাক জুটচে, উপরন্তু “এঁটো” আর “ব্ল্যাড়া” নামে তেত্রিশ কোটির ওপর দুই জাগ্রত দেবতার প্রাদুর্ভাব হ'য়েচে। তাঁরা এখনও পুরাণপাঠ ছলে কথকতার ভাঁড়ামি শোনেন বলে’ পুরাণাদি শাস্ত্র জীবিত আছে, তাঁরা তীর্থ করেন বলে' এখনও মোহাত্ত ও পাণ্ডাদের পেট মোটা হচ্চে, আর “নবীন-এলোকেশীর” পালার শেষ অভিনয় রজনী এখনও আসে নি; উপরন্তু ঝাড়ফুঁক, মাদুলি, রক্ষাকবচ ইত্যাদি বেদের ছাঁট, অথর্ব্ব বেদের debris এখনও লোকে ভুলতে পারে নি, মোটের উপর সমগ্র হিন্দুধর্ম্মের কাঠামটা তাঁদের ঠেসেই দাঁড়িয়ে আছে, ঘুণ ধরলেও ভূমিসাৎ হয় নি। বিচার করবার একটু অক্ষমতা, অতিরঞ্জনের প্রতি একটু ঝোঁক, সত্যের প্রতি একটু কম টান, দুটো পরচর্চায় কথঞ্চিৎ পরিতৃপ্তি, স্বজাতীয়ার প্রতি একটু ঈর্ষ্যা অসূয়া— এ সব সামান্য কথার জন্য আধ্যাত্মিকতার ব্যত্যয় হ'তে পারে কি? কেউ বলতে পারেন, প্রসন্ন কি একাই এই সব লক্ষণে লক্ষণাক্রান্ত? আমি বলি না তা নয়, প্রায় সব দেশের নারী–কুলই এই রকম। কিন্তু প্রসন্নর বিশেষত্ব এই যে, সে আধ্যাত্মিক, অন্য দেশের নারীর সে বড়াই নেই—-এইটুকু তফাৎ।
এ পর্যন্ত ন্যায়শাস্ত্রের method of agreement দিয়ে প্রমাণ করলুম যে প্রসন্ন spiritual তন্ত্রের। এখন একবার method of difference দিয়ে differential diagnosis করে’ দেখা যাক, তা'তেও যদি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হ'তে পারা যায়, তা হ'লেই প্রমাণটা অকাট্য হ'য়ে গেল।
প্রথম কথা ইউরোপীয়গণ খাদ্যের কোন বিচার করে না,—তা'রা গরু খায়, যদিও সেই সঙ্গে গরুর এমন ব্যবস্থা করে যে গরু দুধের সাগর হ'য়ে যায়, দিনে আধমণ পর্য্যন্ত দুধ দেয়। এ mate-rialism আমাদের দেশে নেই,— আমরা গরু খাই না (ডাক্তার - রাজেন্দ্রলাল মিত্র নাকি বলেছেন আমরা গরু খেতুম, তিনি ইংরেজীনবীশ, তাঁর কথা আমি কানেই তুলতে প্রস্তুত নই), আমাদের গো-মাতাগণ আমাদের যত্নের চোটে “ছটাকে” হ'য়ে এসেচেন। কিন্তু তা'তে কি এসে যায়, আমরা গো-পার্ব্বণে তাঁদের গায়ে যথারীতি গেরীমাটির ছাপ দি; ইউরোপীয়গণ তা করে না। এই ত গেল গো-চর্য্যার কথা, এখানে মৌলিক পার্থক্য— খাওয়া ও খাওয়ান দুই দিকেই। গরুর পরেই ব্রাহ্মণের কথা, এখানেও সেই মৌলিক পার্থক্য। ইউরোপে যাজকতা কর্ত্তে গেলে পণ্ডিত হ'তে হয়, সাধন কর্ত্তে হয়, শিখতে হয়। এখানে হোমিওপ্যাথিক ডাক্তারের নীচেই পুরুৎঠাকুরের স্থান; “বিদ্যাস্থানে ভয়ে বচ” হ'লেই, পুরুত-ঠাকুর আর হোমিওপ্যাথিক ডাক্তার। গো-ব্রাহ্মণ সম্বন্ধে ত এই বিভিন্ন ব্যবহার বিভিন্ন মনেরই লক্ষণ।
তারপর আহার, আমরা সাত্ত্বিক আহার করে' থাকি; ইউরোপীরগণ যা পায় তাই খায়, কে জানে সাত্ত্বিক, কে জানে অ-সাত্ত্বিক। আমরা খাই উদ্ভিদ, তা'রা খায় প্রাণী, এই জন্য আমরা অচল, আর তা'রা সচল প্রাণবন্ত কি না তা আমি বল্তে পারচি না; তবে পশুপক্ষীর analogy থেকে এটা দেখতে পাই, যে নিছক সাত্ত্বিক আহার খেয়ে, হাতি থেকে আরম্ভ করে' রাম-ছাগল পর্য্যন্ত, পরের বোঝা বয়, আর প্রাণীবধ করে' তা'র রক্ত পান করে’ খেঁকশিয়ালটা পর্য্যন্ত কারও হুকুমবরদার নয়; আমরা হয়ত হাতিতে চড়ে’ ইন্দ্রের সভায় গিয়ে উপস্থিত হব, আর ইউরোপীয়েরা পশুরাজের সঙ্গে নরকের আগুনে পুড়ে মরতে যাবে, তা হ'তে পারে; তা হ'লে আমরা spiritual আর তা’রা material এইটেই ত প্রমাণ হ'চ্চে!
তারপর আমরা যার-তার হাতে খাই না, অন্ততঃ ব্রহ্মণ্যের নির্ব্বিষ খোলসখানাও কাঁধে পড়ে থাকা চাই, তবে তা’র হাতে খাব; আর ইউরোপীয়েরা যার-তার হাতে খাবে, সে “কিবা হাড়ি কিবা ডোম”। তাদের এমনি materialistic বুদ্ধি যে তা’রা মানুষে মানষে প্রভেদ দেখতে পায় না; মানুষ কি পশু না পাখী যে সব সমান হ’বে? অষ্ট্রেলিয়ার steppes এ না হয় সব ঘোড়া সমান, কিন্তু আড়গড়ার ভেতর পুরলে, ঘোড়ার শ্রেণীবিভাগ হ'য়ে, কোনটা ঘোড় দৌড়ের মাঠে যায়, আর কোনটা scavenger গাড়িতে জোড়া হয়; মানুষেরও কি তাই নয়? কিন্তু সে সূক্ষ্মদর্শন ওদের নেই, আমাদের আছে,— আমরা তা'র ব্যবস্থা করেছি, শ্রেণীবিভাগ করেছি, কারও হাতে খাই কারও হাতে খাই না। তবে মনের খাদ্য আহরণের বেলা তা'রা ব্রাহ্মণ ছাড়া আর কারো হাত থেকে বা মুখ থেকে গ্রহণ করে না; বিশিষ্ট জ্ঞান ও সাধনার পরিচয় যে না দিয়েছে, তা'র কাছ থেকে তা’রা জ্ঞানের কথা শুন্বে না; আর আমরা লম্পটের মুখেও বেদান্ত-ব্যখ্যা শুনব, ভূতের মুখেও রাম নাম শুনে ধন্য হ'ব। এটা আমাদের আধ্যাত্মিকতারই পরিচয়; কারণ আমরা চাই জ্ঞান, মানুষটা ত উপলক্ষ মাত্র, আমরা হংসের মত নীর পরিত্যাগ করে' ক্ষীর গ্রহণ করতে সক্ষম!
তাদের ধর্ম্মপুস্তক, ধর্ম্মালোচনা, ধর্ম্মযাজক, ধর্ম্মমন্দির থাকলে কি হয়, তারা পরলোক মান্লে কি হয়, তা'দের চরম বিচারকের বিচারে আস্থা থাকলে কি হয়, যেহেতু তা'রা ইহলোকটাকে উড়িয়ে দেয় নি, আর পরলোকটাকেই সর্ব্বস্ব করে’ তোলে নি, তাদের আধ্যাত্মিকতা ভাক্ত, আর আমাদেরটাই খাঁটি, তা'র কি কোন সন্দেহ থাকতে পারে?
ঠিক এই পর্যন্ত লিখিচি আর নদীরাম বাবু এসে উপস্থিত —
নসীবাবু। কি ঠাকুর আবার মাথা গরম করচ যে!
আমি। লোকে কথা কয়েই ত মাথা গরম করে, আর মাথা ঠাণ্ডা করে' লেখে।
নসীবাবু। তোমার যে সব সৃষ্টিছাড়া। তা যাই হ’ক, কি লেখা হ'ল?
আমি। আজ্ঞে, আপনারাই যে ভগবানের chosen seed তাই প্রমাণ করে’ দিলুম, আপনারাই the salt of the earth, আপনারাই leaven, that will leaven the whole তারই চূড়ান্ত মীমাংসা করে’ দিলুম; পশ্চিম বলতে মোটা, আর পূর্ব্ব বলতে সূক্ষ্মাদপি সূক্ষ্ম—এইটে আধ্যাত্মিক ভাবে দাঁড় করিয়ে দিলুম।
নসীবাবু। সব দেশেরই আপনাপন আধ্যাত্মিকতার ধারা আছে; আপনাপন সুখশান্তির অনুকূল পন্থা সব দেশেরই মনীষীরা আবিষ্কার করেছেন, আপনাপন দেশের পূর্ব্বাপর পরিকল্পনা করে' তাকে গড়ে' প্রয়োগ করেচেন।
আমি। তা ত করেচেন, কিন্তু আপনারাই যে স্বর্গের সিঁড়ি আবিষ্কার করেচেন এই আস্ফালনটা বড় বেশী রকমের শুনচি তাই ব্যাপারটা একটু চিরে দেখলুম।
নসীবাবু। কি মোটের মাথায় দেখলে?
আমি। আজ্ঞে, দেখলুম, আপনাদের দাবীটা একেবারে ভূয়ো।
নসীবাবু। নিরেট করতে হ'লে কি একটু আফিম্ চালা’লে হয় মনে কর?
আমি। মন্দ হয় না, কেননা সবটার ভিতর আফিমের মৌজ রয়েছে, আর ঐ সত্য বস্তুটাই নেই; আফিমের ভিত্তির উপর অবস্থিত হ'লে অন্ততঃ কার্য্য-কারণ বোঝা যেত; কারণ আফিম্ না খেয়ে এত খেয়াল দেখাটা ব্যাধি বলেই সন্দেহ হয়।