কমলাকান্তের পত্র (১৯২৩)/মহাত্মার ভুল

২৬

মহাত্মার ভুল

একজন ইংরাজ লেখিকা বলেচেন—Truth-telling does not pay in the long run. তবে আমি লাভের খাতিরে সত্য কথা বলচি না এই যা, নইলে বাস্তবিকই সত্য কথা বলে' লাভ নেই এ কথা সত্য! এই রকমই দুনিয়া, কি করা যাবে।

 ঘটনা সত্য, আমার মৌতাতের মুখের কথা নয়, আজগুবী কল্পনা নয়, সত্য ঘটনা।

 আমার দাওয়ায় বসে' আছি, একখানা কয়লা বোঝাই গরুর গাড়ি আমার কুঁড়ের সুমুখের রাস্তা দিয়ে মন্থর গমনে চলে’ যাচ্ছে— একজন গরুর ল্যাজ মল্‌চে, আর একজন কয়লার বস্তার উপর বসে’ চীৎকার করে’ বল্‌চে—“লে—কোইলা”; দুইজনেই বেহারী হিন্দুস্থানী। আমার কুঁড়ের সম্মুখের বাড়ী থেকে কে জিজ্ঞাসা করলে—“কত করে' কয়লা?” গাড়ির উপরকার লোকটা বল্লে—“ন' আনা মণ”।

 প্রশ্ন। কয়লা ওজন করে’ দিবি?

 উত্তর। তা হ'লে বার আনা—

 প্রশ্ন। তবে ন' আনা মণ বল্‌চিস্‌?

 উত্তর। তা' জানে না, লিবে ত লাও, হামি অত জানে না।

 প্রশ্নকারী। আচ্ছা, বার আনাই দেব, দিয়ে যা।

 গাড়োয়ানটা কয়লার বস্তা পিঠে করে’ খদ্দেরের বাড়ির ভেতর গেল; দ্বিতীয় ব্যক্তি আমার দাওয়ার সন্নিকটে এসে আমায় প্রশ্ন কল্লে—বাবু আখ্বার পড়চ; কি খবর লিখেসে?

 আমি একখানা ইংরাজি সংবাদপত্র পড়ছিলুম, বল্লুম—“খবর অনেক, বসে' শোন ত বলি, এক কথায় কি বল্‌ব?”

 সে। মহাত্মাজীর কিছু খবর লিখেেসে?

 আমি। না—

 সে। ইংরাজের আখ্বারে লিখবে না!

 আমি। লেখে, তবে আজকের কাগজে তাঁর সম্বন্ধে কিছু সংবাদ নেই।

 সে। বাবু, মহাত্মাজী তো স্বরাজ লে লেগা!

 ঠিক সেই সময়ে কয়লা ঢেলে দিয়ে গাড়োয়ানটা এসে যোগ দিয়ে বল্লে—“হাঁ বাবু, গান্ধীজী জরুর স্বরাজ লেগা।”

 আমি। কি করে' লেগা?

 দুইজনে। চার্‌খাসে, বাবু, চর্‌খাসে!

 আমি। চরকায় ত সুতা কাটা হয়, স্বরাজ কি করে’ হবে বল দেখি!

 গাড়োয়ান। বো চরথাকা চক্র যো হ্যায়, সো সুদর্শন চক্র হো যায় গা; ঔর, উস্‌কী ডোরী ঔর সুই যো হ্যায়, সো ধনুর্ব্বাণ হো যায় গা!

 আমি। তা' সে সুদর্শন কে ঘোরাবে? আর ধনুর্ব্বাণই বা ছুড়বে কে?

 গা। গান্ধীজী আপ্‌নে, ঔর কোন?

 আমি। আর তুমি ঠিক এই রকম আধ-মণ কয়লার বস্তাকে এক-মণ করে' বেচতে থাকবে ত?

 গা। ক্যা করেগা, বাবুজী; গরীব আদমী, খায়গা ক্যায়সে?

 “লে—কোইলা” বলে গাড়ীর উপর গিয়ে লোকটা বসল, আর গাড়োয়ানটা গরুর ল্যাজ নর্ম্মম ভাবে পীড়ন করায় গরু দু'টা দ্রুত পদক্ষেপে চলতে লাগল।

 বলিহারী ভারতবর্ষের মাটিকে! এখানে গুরু আর চেলা, অবতার আর তল্পীদার ছাড়া আর কিছু জন্মাল না। যিনিই সাধারণ মানুষের চেয়ে একধাপ উপরে উঠলেন, তিনিই হলেন অবতার, আর মুমুক্ষু মানুষগুলো সব-কাজ তাঁরই উপর ন্যস্ত করে’ নিশ্চিন্ত হ'ল। হায়রে অবতার, পরের বোঝা বহন করবার এমন মিনি-পয়সার মুটে আর কোন রাজ্যে জন্মায় না!

 আহা! জগৎটা যদি সেই রকমই হ’ত! মাষ্টার পড়া মুখস্থ কল্পে যদি ভক্তিমান ছেলে পাশ হ'ত; ডাক্তার নিজের prescribed ঔষধ সেবন কল্লে যদি ভিজিট দিয়েচে বলে’ রোগী আরাম হ’ত; জজ সাহেব বিচার শেষ করে’ জেলে প্রবেশ করলে তাঁর জয়গান করায়, যদি অপরাধীর প্রায়শ্চিত্ত হ’ত; আর-একজন আফিং খেলে দরিদ্র কমলাকাস্তের যদি, সুধু দোহাই দিয়েই, হাইতোলা নিবারণ হ’ত, তা হ'লে কি মজাই হ’ত! কি সুখের রাজত্বই হ’ত! কিন্তু দুঃখের বিষয়, ভগবান তা’র উল্টা ব্যবস্থাই করে’ রেখেচেন; “যার বিষপাত্র আনি' দেয় তা’র মুখে” এই নির্ম্মম নিয়মেই জগৎটা চলচে। যিনি যে ফলার মেখেচেন তাঁকেই সেটা তুলতে হবে, “বরাতি” কাজ মোটেই চলবে না। আর পরকালেই যদি সব হিসাবের নিকাশ হ’ত, তা হ'লেও কোন গোল হ'ত না; তা হ’লে

সঙ্কীর্ণ এ ভবকুলে দাঁড়ায়ে নির্ভয়ে
করিতাম অবহেলা পরলোকে!

কেন না কেই বা পরলোকের খোঁজ রাখচে। কিন্তু ব্যাপার তা নয়, এইখানেই সব কাজের বোঝাপড়া হ'য়ে থাকে; ব্যক্তির বল, জাতির বল, বোঝাপড়া এই এক পুরুষে, না হয়, দু' পুরুষে, না হয় তিন পুরুষে,—নয়ত পুরুষ-পরম্পরায় যুগ-যুগান্তর ধরে’ তা’র প্রায়শ্চিত্ত চল্তে থাকে। '৫৭ সালের বিশ্বাসঘাতকতার প্রায়শ্চিত্ত ত জগৎ শেঠ থেকে আরম্ভ করে’ চুনোপুঁটী সকলেই করে’ গেছে, আর বাংলার লোক—জনসাধারণ, ঠুঁটো জগন্নাথ হ'য়ে বসে' ছিল বলে', আজও সেই Criminal indifferenceএর প্রায়শ্চিত্ত করচে-যে বিষের পাত্র অপরিণামদর্শী যুবার মুখে ধরে’ ছিল, সেই বিষপাত্র আজও জনে জনে পান করচে।

 কিন্তু কোথা থেকে কোথায় এসে পড়েচি! কয়লাওয়ালার কথা থেকে একেবারে পলাশীতে গিয়ে পড়েচি।

 গান্ধীজীর ভুল হ'য়েচে বল্লে হয়ত দেশসুদ্ধ লোক আমার উপর খড়্গ হস্ত হ'য়ে উঠবে, আমার তা'তে বিশেষ এসে যাবে না। আমি বলতে বাধ্য—গান্ধীজীর ভুলই হয়েচে, এবং খুব বড় রকমেরই ভুল হয়েচে। তিনি মানুষ চিনতে পারেন নি; “পড়িলে ভেড়ার শৃঙ্গে ভাঙ্গে হীরার ধার”—তাঁর হীরার ধার এই মেষপালের শিংএর স্পর্শে ভেঙ্গে গেছে। তিনি নিশ্চয়ই এখন তা বুঝতে পাচ্চেন; তাঁর শিষ্যবর্গ সে কথা স্বীকার করায় গুরুর অমর্য্যাদা করা হবে ভাবলেও, আমি বলব তাঁর মত বিচক্ষণ পুরুষ নিশ্চয়ই নিজের ভুলটা বুঝতে পাচ্চেন; তিনি যে ভেড়ার পালকে পক্ষীরাজ ঘোড়া মনে করেছিলেন—এইটে তাঁর প্রথম ভুল।

 তাঁর দ্বিতীয় ভুল এই, ভারতবর্ষকে যিনি উদ্ধার করবেন, তাঁকে ভারতবাসীর হ'য়ে সব কাজ করে' দিতে হবে—একথা তাঁর স্মৃতিপথ থেকে চলে’ গিয়েছিল। তাঁকে যে দেশসুদ্ধ লোক, বিশেষ করে’ তাঁর যাদের উপর বেশী নির্ভর, অর্থাৎ শিক্ষিত বলতে যারা তা ছাড়া ভারতের আর সকলে, তা'রা যে তাঁকে দেবতা বানিয়ে দিয়েছে, তা'র কি কোন গূঢ় অভিপ্রায় নেই? এক জনকে দেবতা বানালে তা'র উপর সবটা ছেড়ে দিলে, কাজ কত সহজ হ'য়ে আসে মহাত্মাজীর চেলারা কি বোঝে নি? চেলাগণ নির্ব্বিবাদে আপনাপন ধান্দা নিয়ে থাকবে—যে ব্যবসাদার সে খদ্দেরকে পেঁচিয়ে কাটতে থাকবে, যে জমিদার সে প্রজাকে জবাই করতে থাকবে, যে সুদখোর সে চক্রবৃদ্ধির চক্রে ফেলে অধমর্ণকে চরকির পাকে ঘোরাতে থাকবে, আর মহাত্মাজী শ্রীকৃষ্ণরূপে সুদর্শনচক্র ঘুরিয়ে অরাতি-নিধন করবেন, শ্রীরামচন্দ্ররূপে ধনুর্ব্বাণ হাতে যজ্ঞবিঘ্নকারীদের জব্দ করবেন, এবম্বিধ division of labourএ কাজের কেমন সুবিধা মহাত্মাজীর চেলারা কি বোঝেনি? কারও গায়ে আঁচটি লাগবে না, অথচ কার্য্য ফতে হ’য়ে যাবে—এ ব্যবস্থা যে কত সুবিধাজনক তারা কি তা’ বোঝেনি?

 মহাত্মাজীর অভিপ্রায় নিশ্চয়ই তা' নয়; কিন্তু স্পষ্ট করে' তাঁর অভিপ্রায় যে তা নয়, তিনি স্বয়ং বুঝিয়ে দিলেও, আমার বিশ্বাস চেলারা তা’ বুঝবে না; তা'রা বল্‌বে — “প্রভু ছলনা করচেন, ভক্তদের পরীক্ষা করচেন, তিনিই করবেন সব, তবে হঠাৎ কি মহাপুরুষরা ধরা দিতে চান!” কিন্তু যে দিন বাধ্য হ'য়ে বুঝবে যে চরকার চাকা সুদর্শন-চক্র হবে না, সেদিন মহাত্মাজীর প্রতি যে-ভক্তি সুদর্শন-চক্রের সম্ভাবনাটা সৃজন করেচে সে-ভক্তির অবস্থা যে কি হ'বে, তা আমি ঠিক বল্তে পারচি না। সেটা একটা নিদারুণ tragedyই হবে বলে' আমার মনে হয়।

 ভারতবাসীর ভুতুড়ে ভাবটাকে যথেষ্ট রকম recognise না করাই মহাত্মাজীর একটা দারুণ ভুল হ'য়েচে; মানুষকে হঠাৎ দেবতা বানিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত হওয়ার ভাবটা যে মজ্জাগত ভারতীয় ভাব, সে বিষয়ে যথেষ্ট precaution না নেওয়াই হয়েচে ভুল। চেলাদের পক্ষে তাঁর ঋষিতুল্য মনুষ্য-চরিত্রে দেব-চরিত্রের আরোপ করে' তাঁকে খুব বড় করে' দেওয়া যত সহজে হ'য়েছে, তাঁর পক্ষে চরকার চাকা সুদর্শন-চক্রে পরিণত করা কিছুতেই তত সহজে হবে না। সুধু বিহারী কয়লাওয়ালা যে এই ভুলটা আঁকড়ে ধরে' আছে তা নয়, অজ্ঞ জনসাধারণ—যারা বাস্তবিকই ভারতের ভরসাস্থল— তাদের অধিকাংশেরই এই ধারণা। এ ধারণা পত্রপাঠ দূর করতে হ’বে—তাদের বুঝিয়ে দিতে হবে

When ye kneel to God in penitence
And cringe no more to men
Ye shall smite the stiff-necked infidel
And rule-but not till then!

 এই বাণী যিনি বলবার মত করে' বলতে পারবেন, এবং ভারতবাসীকে শোনবার মত করে' শুনতে বাধ্য করতে পারবেন, তিনিই সিন্ধুবাদের ঘাড়ের ভূতটাকে নামাতে পারবেন, তিনি গান্ধীজীর চেয়েও বড়!