কমলাকান্তের পত্র (১৯২৩)/প্রজাপতির নির্ব্বন্ধ

কথায় বলে প্রেমে পড়া, falling in love; পড়াই বটে, উঠা নয়। কিন্তু আশ্চর্য্য দুটা বিভিন্ন জাতির কথার ভঙ্গীতে একই সত্য ফুটে উঠেচে, যতক্ষণ বা যতদিন, প্রেমটা স্ত্রী ও পুরুষকে ছাপিয়ে, উপ্চে গিয়ে, সংসার, পরে সমাজ, শেষে জাতিটাকে অভিসিঞ্চিত করতে না পারচে, ততদিন সেটা পড়াই বলতে হবে, উঠা কিছুতেই বলা যাবে না।

 একবার এক পুরুত ঠাকুর একটা বিয়ে দিতে গিয়েছিলেন। বিয়ের মন্ত্রগুলা তাঁর মোটেই জানা ছিল না (এমন ত হ'য়ে থাকে!); তিনি ফুল বিল্বপত্র ঘণ্টা শাঁক ইত্যাদি নাড়ানাড়ির সঙ্গে সঙ্গে বিড় বিড় করে' অনুস্বার-বিসর্গ-ঘটিত কতকগুলা শব্দ উচ্চারণ করার পর, বর-ক’নের হাত দুটা এক করে’ মালাগাছটা তা’তে জড়িয়ে বেঁধে দিয়ে বল্লেন—

যেমন বর তার তেমনি কন্যে,
এই আবাগী ছিল এই আবাগের জন্যে।

—বিয়ে হ'য়ে গেল।

 পুরুত ঠাকুরের মন্ত্রটা খাঁটি সংস্কৃত ভাষায় না হ’লেও, বর্ণে বর্ণে সত্য। মোটের মাথায় সকল বিয়েতেই যেমন বর তা'র তেমনি কন্যে, যেমন ‘দেবা' তেমনি 'দেবী'ই হ'য়ে থাকে; বিশেষ বিশেষ স্থলে যেখানে হয় না, বা হয় নি বলে' উভয় পক্ষের কা’রও সন্দেহ হয়, সেইখানেই গোল বাধে। কিন্তু যতদিন উভয়ে নিরবচ্ছিন্ন ভাবে সুধু উভয়ের জন্যই জীবন ধারণ করে’ থাকে, ততদিন তাদের মিলনটা ‘আবাগে’ আর ‘আবাগী’র মিলন ছাড়া আর কিছুই হয় না; জন্তু জানোয়ারের মিলন তা’র চেয়ে কিছুতেই অন্যবিধ নয়।

 বিয়েটাকে যে হিন্দু-শাস্ত্রে জন্ম-জন্মান্তরের বাঁধন বলেচে, তা’র নিগূঢ় অর্থ থেকে, সুধু বিধবা বিবাহের বিরুদ্ধে গোঁড়ামির একটা খুব কায়মি যুক্তি ছাড়া, আর কিছু পাওয়া যায় না তা‍’ নয়। আমি বুঝি—আমার পূর্ব্বজন্ম আমার পিতৃপুরুষগণ, আর আমার পরজন্ম আমার ঔরসজাত সন্তান থেকে আরম্ভ করে' আমার ভবিষ্যৎ বংশীয়গণ । এছাড়া পূর্ব্বজন্ম আর পরজন্মের আমি কোন মানেই খুঁজে পাই না। আমার পূর্ব্বজন্মের অর্থাৎ পূর্ব্বপুরুষগণের চেহারা ও চরিত্র নিয়ে আমি জন্মেচি, তাঁদের শক্তি এবং দুর্বলতার সমষ্টি potentialরূপে, সম্ভাবনা-রূপে আমার ভিতর রয়েছে; সে সম্ভাবনাকে ফুটিয়ে, এবং আমি যে নব নব পারিপার্শ্বিক অবস্থার ভিতর দিয়ে চলেছি, তা'র সাহায্যে বা তা'র ধাক্কায়, আমার চেহারা আর চরিত্রের যথাযথ পরিবর্ত্তন হ'য়ে, আমারই পূর্ব্বজন্মের চেহারা আর চরিত্রের বনিয়াদের উপর, দৃশ্যত এবং বস্তুত একটা নূতন জীব তৈরী হ'য়ে, এই জীবন-নাট্যমঞ্চে অভিনয় করে' চলে যাব। আমি যদি সত্তানোৎপত্তি না করে' জীবনটা শেষ করে' যাই, তা হ'লে আমার আর পরজন্ম বলে’ কিছু হ'ল না, আর সেইখানেই আমার পূর্ব্ব পুরুষগণের অথবা পূর্ব্বজন্মের সংস্কার ও সাধনার শেষ হ'য়ে গেল। প্রকৃতি স্বয়ং অনেক সময় undesirable বংশের বিলোপ সাধন করেন; অপদার্থ লম্বোদর ঘি-দুধের যমগুলার যে বংশলোপ হয়, বা দুরারোগ্য ব্যাধিগ্রস্থ লোকের যে বংশ থাকে না, সেটা এইরকম একটা racial sanitation বজায় রাখবার জন্যই হ'য়ে থাকে। আমার মতন আফিংখোরের যে বংশ থাকবে না, এবং থাকা উচিৎ নয়, তা' জেনেই আমি প্রকৃতির কাজ এগিয়ে রাখবার জন্যই দারপরিগ্রহ করি নি, না হ’লে এ কন্যাদায়গ্রস্ত দেশে আমারও 'দেবী' মিলত না কি?

 মহীরুহের সম্ভাবনা নিয়েই ক্ষুদ্র বীজের জন্ম; সেই বীজের অভ্যন্তরে কত বসন্তের মলয়হিল্লোল, কত প্রভঞ্জনের প্রলয়-হুঙ্কার, কত বর্ষার সরসতা, কত নিদাঘের প্রচণ্ড উত্তাপ, কত রবির কিরণ, চাঁদের জ্যোৎস্না, আকাশভরা অন্ধকার, আর অগণিত নক্ষত্রের দীপালোক—এ সবের নিদর্শন রুদ্ধ হ'য়ে রয়েচে, তা কেউ জানতে পারে? সেই ক্ষুদ্র বীজ থেকে যে মহীরুহের উদ্ভব হবে, তা'রই সম্ভাবনা নিয়ে তা'র জন্ম—মলয়ানিলের সঙ্গে লাস্যবিলাস, প্রলয়ঙ্করী ঝটিকার সঙ্গে মল্লযুদ্ধ, নিদাঘের অগ্নিমধ্যে নিদিধ্যাসন, বর্ষার বারিধারায় ঝারা স্নান, দিনের আলো ও রাত্রির অন্ধকারের সঙ্গে নিগূঢ় প্রেমালাপের সম্ভাবনা নিয়ে তা'র জন্ম, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের অজ্ঞাতে তিলে তিলে তা'র বৃদ্ধি পুষ্টি ও পরিণতি—অথবা মধ্যপথে কুঠারের ক্রুর আঘাতে কিম্বা কুলিষপাতে তা’র অকাল মৃত্যু ও বৃক্ষজন্মের শেষ। এই রকম মানুষও সম্ভাবনা নিয়ে জন্মায়, সে সম্ভাবনা বাস্তবে পরিণত হবে কি না তা'র স্থিরতা না থাক্‌লেও একটা নির্দ্দিষ্ট পথেই সে যাবে, আর সে নির্দিষ্ট পথটা তা'র অতীত ও বর্ত্তমান, তা'র পূর্ব্বজন্ম আর ইহুজন্ম দুইয়ে মিলে, ঠিক করে’ দেবে।

 এ কথা যদি মান্‌তে হয়, তা হ'লে কখন্ কোন্ ভ্রমর এল কোন্ অজানা ফুলের পরাগ নিয়ে, কোন্ ফুলে ফল-সম্ভাবনা করে’ গেল, সেই সংযোগটাকে সর্ব্বস্ব বলে’ না মেনে, ফুলের পশ্চাতে বৃক্ষ, তা’র পশ্চাতে সহস্র বর্ষের দেওয়া-নেওয়া ভাঙ্গা-গড়াকে মানতে হয়, স্কুলের পূর্ব্বজন্ম মান্‌তে হয়, আর ফুলের ভিতর ফলের, তার পর বৃক্ষের সম্ভাবনা অর্থাৎ পরজন্ম, সেটাকেও মানতে হয়; এবং সংযোগটাকে সুধু সংযোগ মাত্রই ধরে' নিলে, কোন ক্ষতিই হয় না। মনুষ্য জীবনে অতীতের সঞ্চিত পুঞ্জীকৃত প্রচেষ্টার মর্য্যাদা যাতে অক্ষুণ্ণ থাকে, ইহজন্মে তা'র সংস্কার, তা'র বিস্তার হয়, আর ভবিষ্য বংশীয়দের শোণিত-স্রোতে সঞ্চারিত হ'য়ে, চিরবহমান হ'য়ে, চলে যেতে পারে, তা’র জন্য যত্ন, তা'র জন্য এই জীবনে সমস্ত আয়োজন, একাগ্রতা, নিষ্ঠা, ভোগ এবং যোগ সমস্তই করে' যেতে পারলে, তবে ত মনুষ্য জন্ম সার্থক হ'ল; নয়ত অভাগা আর অভাগীর মিলনকে অগ্নিসাক্ষী করে', নারায়ণকে ডেকে, সংস্কৃত-মন্ত্রপুত করে' কি লাভ? সেটা শুধু mummery and gibberish ছাড়া আর কিছু নয়!

 অর্বাচীনগুলো বিয়েটাকে একটা mummeryই করে’ তুলেচে, একটা অভিনয়ে এনে দাঁড় করিয়েচে। ক’নে যাচাই করা থেকে সুরু করে’, ক’নেকে ঘরে পোরা পর্যন্ত (দেনাপাওনার পালাটা বাদ দিয়ে) একটা অভিনয় বই আর কি? ছোট দিদিমণির স্নেহাশীষ আর ছোঠ্ঠাক্‌মা–মণির কাষ্ঠরসিকতা আর বন্ধুমণিদের জ্যাঠামিপূর্ণ বিয়ের Hand-billগুলো থেকে অভিনয় ছাড়া আর কি মনে হয়?

 তবে কি মনোনয়নের কোন মানে নেই? প্রেমের মিলন বলে যাকে, সেটা কি আকাশ-কুসুম বা অশ্বডিম্ব? মনোনয়নের এক-একটা ধারা সব দেশেই আছে; তার রহস্য আর একদিন ভেদ করবার চেষ্টা করা যাবে; তবে মোটের উপর এই কথাটা আজই বলে রাখি যে, চিনিতে ছানাতে মিশিয়ে খোলায় চড়িয়ে তাড়ু দিয়ে নাড়লে দুইএ মিশে ভীমনাগের মণ্ডা হয়; আর চিনি চড়িয়ে রস পেকে এলে, তা'তে ছানা ছেড়ে দিয়ে তা’কে সেই তাড়ু দিয়ে নাড়লেও ভীম নাগের মণ্ডা হয়। উভয়ত্র তাড়ু-নাড়াটাই Common factor আর সেটা খুব Essential factor. এই জীবনে স্ত্রীপুরুষের মিলনের মধ্যেও—এই জীবন-মরণের অগ্নিকুণ্ডের উপর অবস্থিত সংসার কটাহে, সুখ-দুঃখের আলোড়ন-বিলোড়নের মধ্যে, দু’টী হৃদয় যে গলে’ গিয়ে, মিশে গিয়ে, এক হ'য়ে যায় তা'র নাম—প্রেম। যুবক-যুবতীর হৃদয় যে টগ্‌ বগ্ করে' ফুটতে ফুটতে, একটা আর-একটার দিকে ছুটে গিয়ে শান্ত হ’তে চায়, সেটার নাম দেহের, স্নায়ুর উত্তেজনা, তা'র নাম কাম,—সেটা “বরষিল মেঘ” ত “ধরণী ভেল শীতল” সেটার কথা না বলাই ভাল। মোটের মাথায় সেটা স্বার্থপরতা, Egotismএর চূড়ান্ত Egotism; এই Egotism, এই টগ্‌বগে প্রেমকে বাদ দেওয়াও যায় না, তবে তাকেই বিবাহের চূড়ান্ত সার্থকতা করেচ কি অমনি সহস্র জীবনের গতিটা, Idealটা পাল্‌টে গেছে; তা'হলেই নিক্তির ওজনে দাম্পত্যের দাবী-দাওয়ার বিভাগ করবার আবদার আসবে, কে বড় কে ছোট, “বর বড় কি ক’নে বড়” তা’র মাপকাটী খুঁজতে ছুটে বেরিয়ে পড়তে হবে, স্বামীর কাছে আত্মোৎসর্গের নাম হবে দাসীত্ব, ছেলে মানুষকরার নাম হবে নারীত্বের অপচয়, আর যার জোরে এত লম্ফঝম্ফ অর্থাৎ “যৌবন জলতরঙ্গ”—ততক্ষণে তা’তে ভাটা পড়ে আসবে।

 আমাদের দেশে আমাদের সমাজে এই টগ্‌বগানিকে প্রশ্রয় দেবার ব্যবস্থা নেই,—হয় ভালই, না হয় কুছ পরোয়া নেই । কারণ এই সংসার কটাহে সুখদুঃখের তাড়নার মধ্যে দুইএ মিশে এক হবেই হবে, তবে একেবারে ভীমনাগের মণ্ডা যদি না হয় ত কুছ পরোয়া নেই। কারণ এই মিশে যাওয়াটাই চূড়ান্ত ব্যাপার নয়; এই মিলনের যে ফল, সন্তানসন্ততি, সেই সন্তানের পালন, তার শিক্ষা, তা’র গঠন, এক কথায় সমস্ত বংশগত উৎকর্ষের উত্তরাধিকারী করে' তা’কে সমাজে ও দেশে ছেড়ে দেওয়া, তা'রই জন্যে জীবনের সমস্ত শক্তির প্রয়োগ করতে হ’বে; আপনার জীবনে যেটা সিদ্ধ হ’ল না, অথচ হওয়া উচিত ছিল, পরজন্মে অর্থাৎ ছেলে-মেয়ের জীবনে যাতে সেটার পূরণ হ'তে পারে তার ব্যবস্থা করতে হবে; এইখানেই স্ত্রী-পুরুষের মিলনের সার্থকতার প্রথম স্তর, আর এইখানে Egotism আর টগ্‌বগানির অবসান।

 তারপর সমাজ ও জাতি; মা বাপের ঋণ বলে’ যদি কিছু থাকে তা’র চেয়ে বড় ঋণ সমাজের কাছে, দেশের কাছে। সে ঋণ, চক্রবৃদ্ধি হিসাবে, পুরুষানুক্রমে বেড়েই যায়, কমে না; যত পার তুমি পরিশোধ কর, তারপর পরজন্মে, অর্থাৎ তুমিই তোমার পুত্ররূপে পরিশোধ করবে। যুগে যুগে নব নব ঋণভার অর্থাৎ কর্ত্তব্যের ভার এসে পড়বে, তা' পালন করবার উপযোগী তীক্ষ্ণ মস্তিষ্ক, সুবিমল চরিত্র, সুপ্রশস্ত বুকের ছাতি—এসব প্রস্তুত করে' দিয়ে তোমায় যেতে হবে; আপনাকে ছাড়িয়ে সংসার, সংসার ছাড়িয়ে সমাজ, সমাজ ছাড়িয়ে দেশকে প্রেমের বন্যায় প্লাবিত করে' দিতে হবে—সে প্রেমের উৎস হবে তুমি ও তোমার নারী—দুই এ মিলে অর্ধনারীশ্বর; তবে ত বিবাহ বল, প্রেম বল সার্থক হবে, নয়ত “দেবা” “দেবী”র পিরীতি ত কুকুর কুক্কুরীর সম্মিলন মাত্র।

 যারা ঠেকে শিখ্চে (আমরাও অনেক ঠেকে শিখেছিলুম এখন ভুল্তে বসেচি) তাদেরই একজন বিদূষীর লেখনি নিঃসৃত বাণী উদ্ধৃত করে’ আমার পত্র শেষ করি; Englandএর বদলে India এই পাঠান্তর গ্রহণ করলে অর্থের কোন উনিশ-বিশ হবে না—Let the young women of England learn as a new great faith that the sons and daughters they bear are not their children and the children of their husbands only, but the sons and daughters of England—the inheritors of all the fine tradition of our race. Let us spread the new romance of Love's responsibility to Life; let us honour ideals of self-dedication to our husbands, understanding their dependence upon us, to our homes, to our sons and our daughters, to our race, its great ones and their deeds; our moral obligations to all children even before they are born.