কমলাকান্তের পত্র (১৯২৩)/যেহেতু আমরা ভাই ভাই
১৩
যে হেতু আমরা ভাই ভাই
যে হেতু আমরা ভাই ভাই—রাঢ়ীর সঙ্গে বারেন্দ্র, পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে পূর্ব্ববঙ্গ, মনের ভিতর বেশ তফাৎ করে’ রেখেছি, যদিও মুখে খুব ভদ্রতা করে’, অর্থাৎ চালাকি করে’ বলি আমরা ভাই ভাই।
যে হেতু আমরা ভাই ভাই—ছত্রিশ জাতের খোপের ভিতর পুরে ভাইগুলিকে বেশ শ্রেণীবদ্ধ করে’ রেখেচি; খোপের বা’র হ’য়ে ভাইটী আমার খোপের দিকে এসেছেন কি অমনি চঞ্চর আঘাতে তাঁকে দূর করে’ দিয়ে বলি—“খোপের মাহাত্ম্যটা না মানলে সমাজ ছড়িয়ে পড়বে, খোপটা আছে বলেই আমরা আছি, নহিলে কবে আমাদের এই পারাবত গোষ্ঠিকে বেরালে শেষ করে’ দিত, অতএব খোপের বাহিরে আসিও না।” মাথার উপর যে বাধাহীন আকাশ বল্চে—আমি আছি, আমি বাধাহীন বলেই তোমরাও আছ, সে অশরীরী বাণী—খোপের ভিতরে বসে’ শুনেও শুনচি না। ভাই ভাই এর জীবন স্রোতের অবাধ প্রবাহে যতকিছু বিঘ্ন সৃজন করতে পারি, তা বেশ বুদ্ধি করে’ সৃজন করেচি—শৃঙ্খলার দোহাই দিয়ে তা’কে আষ্টেপিষ্টে শৃঙ্খলিত করেচি।
যে হেতু আমরা ভাই ভাই—বেহারী ভাই বরাকর নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে হাত তুলে বলচেন, প্রবেশ নিষেধ—Behar for the Beharees; উড়িয়া ভাই বৈতরণীর তীরে দাঁড়িয়ে বলচেন—Orissa for the Oryas—আসামের ভাই সকল বলতে সুরু করেচেন—Assam for the Assamese. আমরা বাঙ্গালী এখন ও মুখ ফুটে বলি নি—Bengal for the Bengalis, কিন্তু বল্লুম বলে আর দেরী নেই। আঁতের কালি মুখে ফুটে বেরুবেই, কিন্তু সে সত্যকথা গোপন করে’ তথাপি বলব—যেহেতু আমরা ভাই ভাই—
মুসলমান ভাই যখন Corporation বা Legislative councilএ সাম্প্রদায়িক নির্ব্বাচনের (Communal representation) আবদার করচে, তখন মুসলমান ভাইয়ের ভ্রাতৃবৎসলতার অভাব দেখে আর্ত্তনাদ করলে চলবে কেন? বুকের উপর হাতটা দিয়ে একবার বুঝলেই বুঝা যাবে, যে ভাইএর এই আবদার অপেক্ষা গণতন্ত্রের প্রতি অত্যধিক আকর্ষণের প্রকৃত কারণ কি! পেটের জ্বালায় মুসলমান ভাই যখন গোমাংস খাওয়া হ’তে বিরত হ’তে পারবে না, তখন তুমি হিন্দু ভাই, তার পেটের জ্বালাটাকে না মেনে, গোমাতার প্রতি অধিকতর স্নেহবান হ’য়ে, ভাইয়ের চেয়ে গরুকে অধিক ভালবাসলে, মুসলমান ভাই যদি বলে—রইল তোমার হিন্দুমুসলমানের একতা, তা’তে আঁতকে উঠলে চলবে কেন? ভাইএর পেটের জ্বালায় প্রাণ কাঁদল না—যত দুঃখ গো-বধে। ভাইএর চেয়ে গরুর আদর, তথাপি বলবে—যে হেতু আমরা ভাই ভাই—
এ ভণ্ডামি, এ আত্মপ্রতারণায় কে প্রতারিত হবে? রাজাও নয়, রাজরাজেশ্বরও নয়। অতএব অভিনয় ছাড়—এক সানকিতেই খাও, আর বক্তৃতা-মঞ্চে পরস্পর জড়াজড়ি কর, এ অভিনয়ের নিদারুণ প্রায়শ্চিত্ত একদিন করতে হবে। ভাইএর প্রতি ভাইএর প্রকৃত মনোভাবটা লুকিয়ে রাখচ, কেবল স্পষ্ট করে’ ব্যক্ত করবার সাহস নেই বলে’ ত? আমি বলি এটা একটা উৎকট ব্যাধি; রোগ চাপলে মজ্জায় গিয়ে পৌঁছায়; রোগের স্বচ্ছন্দ বিকাশ হ’তে দাও—হয় রোগ যাবে, নয় রোগী যাবে। কিন্তু চেপে রাখলে রোগীকে রক্ষা করে ধন্বন্তরীরও সাধ্য নাই। নয়ত সুচিকিৎসক ডাক, সময় থাকতে ডাক, যদি উপায় হয়।
এই বিপুল বৈচিত্র্যময় দেশের অতীত ইতিহাসে ভাই ভাইএর মিলন ঘটাবার বহুবার চেষ্টা হ’য়ে গেছে। একজন বলেচেন—“আমার ভাই হবে ত হও, নইলে তোমায় কতল করব।” বলা বাহুল্য তা’তে ভাই ভাইএ মিলন হয় নি। আর-একজন বলেচেন—“আমার এই ছত্রিশ খোপের দরজা খুলে দিলাম, যে আসতে চাও এস, এ ছত্রিশ খোপের একটা খোপে তোমার স্থান করে’ দেব।” তা’তেও সে ছত্রিশ কর্ত্তে ছত্রিশই রয়ে গেছে, ভাই ভাইএ মিল হয় নি।
আমি বৃদ্ধ কমলাকান্ত ঠিক খোলনা করে’ বুঝে উঠতে পারচি না কি করলে, এ ভাই ভাইএর বিরোধজনিত যে পাপ তা’র প্রায়শ্চিত্ত হবে। আমি বৃদ্ধ আমি ভীতু, যুবা যে সে নির্ভীক; যুবা বলবে ভয় কি? আমি বল্ব ভরসা কিসের? যৌবনের রোগ বড়কে ছোট করা; বার্দ্ধক্যের রোগ ছোটকে বড় করা; দুর্লঙ্ঘ্য পাহাড়ের মত স্তূপীকৃত জঞ্জাল, যৌবন এক ফুৎকারে উড়িয়ে দেবে; বার্দ্ধক্য চুল চিরে দেখবে, সাবধানে পা ফেলবে, একটা কাঁকর পায়ে ঠেকলে চম্কে উঠবে; যৌবনের ব্যাধি দুরাশা, বার্দ্ধক্যের ব্যাধি নৈরাশ্য; যৌবনের ব্যাধি বন্ধনহীন স্বাচ্ছন্দ্য, বার্দ্ধক্যের ব্যাধি শাস্ত্র; যৌবনের খরস্রোত পাহাড় কেটে তীর বেগে ছোটে, বার্দ্ধক্যের মন্থর গতি, পথশ্রান্ত হ’য়ে সমতল ক্ষেত্রে শতধারায় বিভক্ত হ’য়ে সাগরে মিশিয়ে গিয়ে বাঁচে।
অতএব এস যৌবন, এস রাজপুত্র, এস ভিখারী, এস জ্ঞান, এস মমতা, তোমাকে আমি এ ভারতভূমির মহিমাময় যুগে দেখেচি, আবার তোমার আগমন প্রতীক্ষা করে বসে আছি—এস, এস। ভাইএর সঙ্গে ভাইএর মিলন ঘটিয়ে দাও—কারণ আমরা যে সত্যই ভাই ভাই। ভয়ঙ্করের সম্মুখে দাঁড়িয়ে ভীত ভীতের হাত ধরে’ ভরসা পায়, নির্য্যাতনের চোটে মানুষে মানুষে মিল হয়, উদরের জ্বালায় লোকে এক জোট হয়; কিন্তু যেমন ভয়ের কারণ দূরে যায়, নির্য্যাতনের জ্বালা প্রশমিত হয়, উদরের জ্বালা নেভে, তখন আর কেউ কা’কেও চেনে না, তখন আবার মানুষ নিজ মুর্ত্তি ধরে, মুখে বলে ভাই ভাই, মনে মনে ছুরি চোকাতে থাকে। তাই ডাকছি তোমাকে, হে রাজপুত্র! তুমি যে জ্ঞান যে মমতা নিয়ে মানুষের ভিতর সুধু মানুষটাকে দেখেছিলে দেখিয়ে দিয়েছিলে—যে জ্ঞানের মহিমায় জাতি বর্ণ দেশ কাল সব ভুলে গিয়ে, মানুষ আপনার মানুষত্ব ফুটিয়ে তুলেছিল—সেই জ্ঞান ও মমতা নিয়ে, হে রাজপুত্র, হে ভিখারী, আর একবার এসো, এসো; দেখিয়ে দাও আমরা সত্যই ভাই ভাই।