১৪

সাবধান!

[ ফরাসডাঙ্গার গৌর-বিল প্রতিবাদের আড্ডায় পঠিত ]

যে হেতু এই সভার স্বাধ্যায়ী চরিত্রবান ও নিষ্ঠাবান হিন্দু ভিন্ন অন্য কাহারও উপস্থিতি প্রার্থনীয় নহে, আমি কমলাকান্ত চক্রবর্ত্তী, অহিফেনসেবী হইলেও, সনাতন ধর্ম্মের একান্ত পক্ষপাতী বলিয়া সভার কার্য্যে যোগদান করিবার অধিকারী বিধায়, সশরীরে উপস্থিত হইতে অপরাগ হওয়ায়, পত্র দ্বারা আমার বক্তব্য বলিয়া পাঠাইলাম, ক্রটী মার্জ্জনা করিবেন। ইতি—


 আদাবান্তে চ মধ্যে চ, আমার মূল কথা আমি গৌরবিলের একান্ত বিরোধী; এবং এ সভায় বাদী অথবা তদীয় অলি অছি উপস্থিত না থাকিলেও, বিচার কার্য্য এক তরফাও যখন হইবার আইন আছে, আমি একজন প্রতিবাদী হইয়া আমার বক্তব্য আপনাদিগের নিকট পেশ করিতেছি; আপনারা বিচারকর্ত্তা, ডিক্রী ডিস্‌মিস্‌ যদ্রোচতে তৎক্রিয়তাম্। বাদী যথাকালে ছানি করিতে পারেন, যদি তাঁর অভিরুচি হয়। অতএব এক তরফায় দোষোনাস্তি।

 আমার এই গৌরবিলের বিরুদ্ধে প্রথম আপত্তি—এ গৌর কে? তা’র পরিচয় কি? অজ্ঞাতকূলশীলস্যামলং দেয়ো ন কস্যচিৎ, অর্থাৎ অজ্ঞাতকুলশীলকে কখনও আমল দিবে না, এই শাস্ত্রবচনাৎ—প্রথমেই অনুসন্ধান করে’ দেখা উচিত এ গৌর কে? ইনি কি জগন্নাথ মিশ্রের পুত্র গৌর, যিনি নদীয়ায় পূর্ণচন্দ্ররূপে উদিত হ’য়ে আচণ্ডাল মুসলমানে পর্য্যন্ত প্রেম বিলিয়েছিলেন? না, তিনি নন নিশ্চয়; যেহেতু নদীয়ার চাঁদ দিল্লীতে উদিত হয়েছিলেন তথ্য প্রমাণাভাবাৎ। তবে ইনি কে? আমরা কেহই “তাঁরে চোখে দেখিনি, সুধু বাঁশী শুনেছি,” অর্থাৎ তাঁর বক্তৃতা পড়েছি; আরও শুনেছি “সে থাকে গোকুলে”, অর্থাৎ Legislative Councilএ, যথায় বহু গো-কুল একত্র হয়েছেন। অতএব অপরিচিত ব্যক্তিকে কোন মতেই আমল দেওয়া উচিত নহে।

 কিন্তু নদীয়ার গৌরচন্দ্রের সহিত এই গৌরের নামের সাদৃশ্য ছাড়া আর একটু সাদৃশ্য লক্ষিত হচ্চে, যার জন্য তাঁর রচিত বা উদ্ভাবিত বিলের বিরুদ্ধে প্রতিবাদটা খুব তীব্র হওয়া উচিত। নদীয়ার গৌরচন্দ্র প্রেম বিলিয়েছিলেন যা’কে তা’কে; যে চেয়েচে সেই পেয়েচে, যে চায় নি সে’ও পেয়েচে। এমন দো-চোকো ব্রত করে’ হয়েছিল—এলাহি কারখানা; হিন্দু মুসলমান সব এক গাড়ে হ’য়ে গিয়েছিল, হিন্দু ধর্ম্মের মূল যে ‘জাত’ তা কোথায় তলিয়ে গিয়েছিল, তা’র ঠিকানা ছিল না, নেড়ানেড়ির সৃষ্টি হয়েছিল। নাগপুরী গৌরেরও মতলব ভাল নয়, ঐ রকম এলাহি কারখানা করবার একটা মতলব তাঁর বিলের ভিতর প্রচ্ছন্ন আছে। বিলের বক্তব্যটা ঠিক আমার জানা নেই, জানবার দরকারও নেই, কিন্তু জাতটাত আর থাকবে না, যে যা’কে পাবে ধরে’ ধরে’ বিয়ে করবে, এই রকম একটা জঘন্য ব্যাপার ঘটবে শুনচি, অতএব বিলের বিরুদ্ধে আমি Protest কল্লাম।

 আর একবার জাতের মাথা খেয়ে ছিলেন বুদ্ধদেব, যিনি আমাদের দশ অবতারের এক অবতার। বুদ্ধদেব লোকটা বড় জবরদস্ত ছিলেন,—হাজার হোক রাজার ছেলে ত! চাতুর্ব্বর্ণ্য নষ্ট করে’ দেশটার খুব উন্নতি হয়েছিল শুনিচি; কিন্তু ধর্ম্মটা একেবারে চাপা পড়ে গিয়েছিল। দেশ উন্নত হ’য়ে ত কোন লাভ নেই, ধর্ম্ম নষ্ট হ’লে যে পরকাল নষ্ট হ’ল, তা’র হিসাব ত কেউ রাখে নি! তাই শঙ্করাচার্য্যের উদ্ভর হ’ল; তিনি আবার নষ্ট জাত উদ্ধার কল্লেন; হিন্দু ধর্ম্ম বা ব্রাহ্মণ্য ধর্ম্ম পুনঃ প্রতিষ্ঠিত হ’ল, বৌদ্ধ ধর্ম্ম বাপ্, বাপ্, করে’ “চীন ব্রহ্মদেশ অসভ্য জাপানে” গিয়ে আশ্রয় নিলে; যে যে দেশে বিতাড়িত বৌদ্ধধর্ম্ম গিয়ে আশ্রয় নিলে, সেগুলো আজ পর্য্যন্ত স্বাধীন, (ব্রহ্মদেশ মাত্র কাল পরাধীন হয়েচে) আর আমরা হিন্দুধর্ম্ম পুনঃ প্রতিষ্ঠিত হ’বার পর থেকেই লাথির পর লাথি, আর জুতার পর জুতা খাচ্চি; কিন্তু বদ্ধ জীব আমরা, আমাদের বুঝা উচিত, আমাদের পরকালটা কি রকম পাকা হ’য়ে গেছে, আর ইহকালে কি অমূল্য নিধি আমরা লাভ করেচি—‘চাতুব্বর্ণ্যের” স্থলে আমরা “ছাত্রিশবর্ণ্য” পেয়েছি; এই “ছাত্রিশবর্ণ্য”টা যে নষ্ট করবে তা’র বুদ্ধদেবের ন’গুণ পাপ হবে,—(চার নয় ছত্রিশ) যে রক্ষা করবে তা’র শঙ্করাচার্য্যের ন’গুণ পুণ্য হ’বে; দেশটা উচ্ছন্ন যাবে তা’র জন্য ভাবলে চলবে না, (ইহলোকের খেলা আর ক’দিন?) আমাদের পরকালটা যে ন’গুণ উজ্জ্বল হবে সেটা ভুললে চলবে না।

 এই “ছাত্রিশবর্ণ্য”টাকে রক্ষা কি করে’ করা যায় “প্রশ্ন ইহাই এখন”। প্রশ্ন বড়ই সঙ্গীন; কেন না ম্লেচ্ছ শিক্ষা ও সংস্কারের সংস্পর্শে এসে অবধি আমাদের সনাতন শিক্ষা-সংস্কার কি রকম আমাদের অজ্ঞাতসারে যে বদলে যাচ্ছে তা একটু প্রণিধান করে’ দেখলেই বুঝা যাবে।

 প্রথমতঃ, ভূদেবতা ব্রাহ্মণের প্রতি কি রকম শ্রদ্ধাহীন হ’য়ে পড়েচে লোকে? অথচ এককালে ব্রাহ্মণের পদাঘাত বুকে ধারণ করেছিলেন স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণ। সে ব্রাহ্মণ ঠিক একালের ব্রাহ্মণের মত নয় হয়ত; কিন্তু ব্রাহ্মণের আবার রকমফের কি? ব্রাহ্মণ—ব্রাহ্মণ, গলায়-পৈতে বামুন নয়, সে ত একটা হেঁয়ালীর কথা! ম্লেচ্ছ-সংস্কার বশতঃ শূদ্র আবার ব্রাহ্মণের জাতি-বিচার করতে বসেচে, এর চেয়ে অধঃপতন কি হ’তে পারে?

 দ্বিতীয়তঃ, গুরুপুরোহিতের প্রতি অশ্রদ্ধা। দু’পাতা ইংরেজী পড়ে why and wherefore জিজ্ঞাসা করতে শিখে, গুরুপুরোহিতের আর সে আদর নাই; “গুরুগ্‌গাঁই” ত উঠেই গেছে, গুরুপুরোহিতের সুধু নিজ নিজ ব্যবসায়ে আর পেট ভরে না; তাঁদের “আরও আরও কার্য্য” কর্ত্তে হচ্ছে। কি নিদারুণ পরিবর্ত্তন!

 তৃতীয়তঃ, দেশে বহুবিবাহরূপ কন্যাদায় প্রশ্নের যে সুন্দর সমীচীন মীমাংসাটা অনাদি কাল থেকে চলে’ আসছিল, ম্লেচ্ছ সংস্কারের তাড়নায়, তা’র বিরুদ্ধে লোকমত বলে’ একটা মত খাড়া করে’, তা’কে নষ্ট করা হয়েছে। উচিত ছিল, বহু বিবাহটা কুলীন ব্রাহ্মণের মধ্যে বজায় রাখা, উপরন্তু সকল জাতের মধ্যে প্রসার করে’ দেওয়া; তা’তে কুলীনের ছেলের বৈশিষ্ট্য নষ্ট হ’য়ে যেত বটে, কিন্তু সমাজের কি উপকারটা না হ’ত? এক একটি পুরুষের ডজন ডজন স্ত্রীর ব্যবস্থা থাকলে, এতদিন কন্যার বিবাহ problem টা solve হ’য়ে যেত, আর এই আক্রাগণ্ডার দিনে স্বামীগণের এক একটা ছোট খাটো জমীদারির ব্যবস্থা হ’য়ে যেত। ম্লেচ্ছ-সংস্কারের ফলে সে শুভ ব্যবস্থা হ’তে পেলে না!

 এত গেল প্রচ্ছন্ন আক্রমণ, surreptitious attacks. খোলাখুলি রকমে তিন তিন বার হিন্দুধর্ম্ম ও সমাজ আক্রান্ত হয়েছে; একবার হয়েছে, যখন আইন করে’ সতীদাহ উঠিয়ে দেওয়া হয়; সেই অবধি ভারতে সতীধর্ম্ম একরকম উঠে গেছে বল্লেই হয়; এখন যা আছে সব জাঁকড়ে সতী, কেন না রাং কি সোনা পুড়িয়ে যাচাই করে’ নেবার ত উপায় নেই; এটা কি সমাজের কম ক্ষতি!

 তারপর বিধবা-বিবাহ বিধি; এ কি কম সর্ব্বনাশের কথা? সতীদাহ ত বন্ধ, তারপর গণ্ডস্যোপরি বিস্ফোটকম্, সতীর পুনশ্চবিবাহব্যবস্থা! এতে হিন্দু সমাজের উচ্ছন্ন যাবার আর কি বাকি রইল?

 তারপর সম্মতি আইন; রজঃস্বলা হবামাত্রই হিন্দুধর্ম্মমতে গর্ভাধান করতে হ’বে। শাস্ত্র বল্‌চেন, প্রকৃতি বল্‌চে, স্ত্রী প্রথম ঋতুমতী হ’বামাত্র গর্ভাধান কর, তা’ স্ত্রীর বয়স ১০ই হ’ক,আর ১১ই হ’ক, আর ১২ই হ’ক; কিন্তু আইন তা করতে দেবে না। ফল হয়েছে এই যে, ঠিক শাস্ত্রমত ছেলে না হওয়ায়, যত অকালকুষ্মাণ্ডের জন্ম হচ্ছে।

 বার বার তিন বার! আর নয়। ম্লেচ্ছ রাজা, ম্লেচ্ছ বা ম্লেচ্ছভাবাপন্ন রাজদরবার, সে রাজা বা রাজদরবারের কি অধিকার আমাদের সামাজিক-জীবনের বা ধর্ম্ম-জীবনের উপর হাত দেয়? হ’লই বা আমাদের নির্ব্বাচিত প্রতিনিধি! জাত গেলে ধর্ম্ম কোথা থাকে? সেই জাত পাকে-প্রকারে তুলে দেবার ব্যবস্থা হয়েচে! কেহ বলবেন, এতে সমাজের উপকারই হবে; হয়ত হবে, কিন্তু জাত যাবে যে, ধর্ম্ম যাবে যে, পরকাল যাবে যে, তা’র কথা কে ভাবচে? আপনারা ভাবচেন, আর আমি কমলাকান্ত ভাবচি, তাই ভরসা! থাক্ ধর্ম্ম যাক্ প্রাণ। বার বার তিন বার হ’য়ে গেছে, বস্, আর না, আমরা গৌরের বিল চাই না। এ সময় যদি আমরা আল্‌গা দিই, বার বার চার বার হবে, তারপর আর ঠেকান যাবে না, সমাজ গড়ের মাঠ হ’য়ে যাবে, কোন বাচবিচার থাকবে না, আবার বুদ্ধ চৈতন্যের যুগ ফিরে আসবে, তা হ’লে ব্রাহ্মণের অস্তিত্ব থাকবে না, অতএব হিন্দুধর্ম্ম ও থাকবে না—সাবধান!