কমলাকান্তের পত্র (১৯২৩)/বিজ্ঞান ও বিজ্ঞাপন

১৫

বিজ্ঞান ও বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞানে মোক্ষ, বিজ্ঞানে ভবযন্ত্রণার পরিসমাপ্তি; বিজ্ঞানে সাজুয্য, সালোক্য ইত্যাদি পরলোকের পারিতোষিক মিলে; কিন্তু ইহলোকে সুধু বিজ্ঞানে বড় সুবিধা হয় না। ইহলোকের দেবতাগণের সাধুজ্য বা সালোক্য প্রাপ্তির জন্য, বিজ্ঞানের উপর বিজ্ঞাপনের বাহার চড়াতে হয়; বিজ্ঞান না থাকলে সে বাহার আরও একটু খোলতাই করে’ দিতে হয়, তা হ’লেই সাজুয্য বা সালোক্য মিলতে পারে—যেহেতু স্বর্গের দেবতা অন্তর্যামী, ইহলোকের উপরওয়ালারা অন্তর্যামী ত নহেনই, বরং তাঁরা জেগে ঘুমান। চোখে আঙ্গুল না দিলে তাঁদের ঘুম ভাঙ্গে না— এই চোখে আঙ্গুল দেওয়ার নামই বিজ্ঞাপন।

 নীলকমল পাগল, তাই বলেছিল যে, তা’র অধিকারী মহাশয় তা’র গুণের আদর করেন বলে’ তা’কে আদর করে’ ১০ টাকা মাইনে করে’ দিতে চেয়েছিলেন। গুণ অনেকেরই আছে, কিন্তু অধিকারী মহাশয়েরা পারত-পক্ষে তা’ স্বীকার করতে প্রস্তুত নন, আদর কর তো চুলোয় যাক। এই জীবন-রঙ্গমঞ্চে অনেক নটেরই কিছু-না-কিছু গুণপনা আছেই আছে, বা গুণের খোশনাম আছে; কিন্তু অধিকারী মহাশয় তা বুঝেন না। গুণ থাকলেই গুণের খোশনাম থাকে না;—অনেকে মদ না খেয়ে মাতাল, আফিম না খেয়ে মৌতাতী, ধন না থেকেও ধনাপবাদগ্রস্ত; গুণ থাকতেও অনেকের “কোন গুণ নাই, তা’র কপালে আগুন।”

 অন্তর্যামী জানলেই হ’ল, আর কেহ জানল আর না জানল যাদের একই কথা, সে পরকালগ্রস্ত খেয়ালীদের কথা ছেড়ে দিলাম। যারা নটরাজ মানেন না, অধিকারী মহাশয়কেই মানেন, তাঁদের সুবিধার জন্য গোটাকতক সদুপদেশ আমি মৌজের মাথায় বলে’ যাচ্চি শ্রবণ কর। কবি বলেচেন—Some are born great, some achieve greatness, and some have greatness thrust upon them. এই তৃতীয় শ্রেণীর greatness কি উপায়ে লাভ করা যায়, আমি তা’র কতকগুলি মুষ্টিযোগ বলব মনঃসংযোগ পূর্ব্বক শ্রবণ কর। যারা great না হয়েও great হ’তে চায়, এবং যারা চায় না, উভয় শ্রেণীর লোকেরই উপকার হবে।

 বিশ্ব-রঙ্গমঞ্চে শতকরা ৯৯ জনের বড় হওয়া না-হওয়া বিজ্ঞাপনের উপর নির্ভর করে। কবি বলেছেন—Sweet are the uses of adversity, কিন্তু আমি বলি,—Sweeter are the uses of advertisement, বিজ্ঞাপন আর hypnotism একই মূল সূত্রের উপর অবস্থিত। ঘুমাও-ঘুমাও-ঘুমাও পুনঃপুনঃ বলতে বলতে হাতচালা দিয়ে যেমন hypnotiser ঘুম পাড়ায়, কানের কাছে কেবল ঘুম, আর ঘুম, আর ঘুম, ঘুমন্ত স্বরে ধ্বনিত হ’তে হ’তে যেমন সত্যই ঘুম আসে—ঘাটে মাঠে পথে আকাশে বাতাসে কেবল তোমার গুণের কথা, তোমার রূপের কথা, তোমার ঐশ্বর্য্যের কথা, তোমার দয়া-দাক্ষিণ্যের কথা, তোমার শৌর্য্যের কথা, তোমার লেখনীচাতুর্য্যের কথা—তুমি যেটাকে ফুটিয়ে তুলতে চাও,—ক্রমাগত চিত্রিত, বিচিত্রিত, গীত, পঠিত, ধ্বনিত, প্রতিধ্বনিত করতে থাক, স্বল্প কালেই তোমার খোশনাম অল্পবিস্তর জাহির হবেই হবে। কথায় বলে, throw dirt and some will stick; আমি বলি, throw praise and some will stick; আর একবার লাগলে আর ভাবনা নেই; তার উপর প্রলেপ দিতে থাক,—একমেটে, দোমেটে, তেমেটে, তারপর রং ফলিয়ে চোখ চান্‌কে নাও।

 কিন্তু এ কাজ করবে কে? এ ছিটেন, এ খোশনামের broadcasting করবে কে? এ আঁকন আঁকবে কে? এ গান গইেবে কে? আমাদের হিন্দুশাস্ত্রে যে নিজের শ্রাদ্ধ নিজে করবার বিধি আছে সেটা অতিবড় ভাগ্যবানের জন্যই; এ ঐহিক কল্যাণের জন্যও নিজের শ্রাদ্ধ নিজেকেই করতে হবে, নিজের গান নিজেকেই গাইতে হবে, নিজের চিত্র নিজেকেই চিত্রিত করতে হবে।

 আত্মপ্রশংসার তীব্র সুরা বিনয়ের জল মিশিয়ে “পান্তাভাত” করলে চল্‌বে না; বিনয়ের যেখানে প্রয়োজন তা পরে বল্‌চি, কিন্তু এ নাটকের প্রথম অঙ্কে অতিরঞ্জনের আতঙ্কটাকে একেবারে বিসর্জ্জন দিতে হবে; তম ও ইষ্ঠ প্রত্যয়ের ছড়াছড়ি করে’ দিতে হবে— superlative এর বন্যা বহিয়ে দিতে হবে। কারণ এ আজব দুনিয়া—বাধ্য না করলে কেউ কখনও আপনার দোষ, আর পরের গুণ স্বীকার করবে না, বিজ্ঞাপনের তোড়ে সব resistance ভেসে যাবে; আর একবার সুর ধরিয়ে দিতে পারলে, দোহারের অভাব হবে না, সত্বর আসর জমজমাট হ’য়ে উঠবে।

 অতএব তুমি যাই কর, বা কিছু নাই কর, কলমটি নিয়ে বস, এবং নিজের হাতে একটি সুরচিত para লেখ—তুমি কতবড় বীর, বা কতবড় সাধু, বা কতবড় পণ্ডিত, তা’ বেশ স্পষ্ট করে’ বলে’ দাও, এবং অপরের নাম দিয়ে সে paraটি সংবাদ পত্রে পাঠিয়ে দাও। সংবাদ পত্রের authentic মানে একটা নাম আর ঠিকানা, সুতরাং সে authenticity দেবার ভাবনা নেই; তোমারই রচিত para তোমার গুণ দুনিয়ায় ছিটিয়ে দেবে, এবং কোন-না-কোন উর্ব্বর ক্ষেত্রে সে বীজ পড়ে’ অঙ্কুরিত হবে, পল্লবিত হ’য়ে উঠবে। একজন খোসামুদে কোন লোহার কার্ত্তিক বাবু সম্বন্ধে বলেছিল—“বাবুর রংটা শ্যামবর্ণ হ’লে কি হয়, রংএর জলুস কি রকম!”—এইখানেই advertisementএর মূল তত্ত্ব ব্যক্ত হ’য়ে পড়েছে; এই রংএর জলুসটাই বিজ্ঞাপনের আখ্যান বস্তু, শ্যামলিমা নয়। তোমার সকল চাটুকারের মূল চাটুকার তুমি স্বয়ং, তুমি যেমন তোমার খোসামোদ করতে পার, এমনটি আর কেউ পারে না; সুতরাং তোমাকেই চাটুকারের চটুল বাক্যের ফোয়ারা ছুটাতে হবে, তোমার শ্রাদ্ধ তোমাকেই করতে হবে। চক্ষুলজ্জা করলে চলবে না; আর সংবাদ পত্রের সম্পাদকের সঙ্গে তোমার চোখাচোখি যে হবেই তা’র ত কোন কথা নেই, অতএব চক্ষুলজ্জা কিসের?

 মনে রাখবে এ যজ্ঞে, তোমার বকলম ঋষি, তুমি দেবতা, ও “ধরি মাছ না ছুঁই পানি” মন্ত্র।

 একজন নাচতে জানত, কিন্তু লোকে জানত না যে সে নাচতে জানে; তা’র শুভানুধ্যায়ী বন্ধু একজন তা’কে বল্‌লে—Wherefore are these things hid? Wherefore have these gifts a curtain before them? Why dost thou not go to church in a galliard and come home in a coranto? Is it a world to hide virtues in? এ উপদেশ অমূল্য; নাচতে নাচতে গির্জ্জায় যাওয়াটা হয়ত শোভন নয়, কিন্তু শোভন অশোভন অত বিচার করতে গেলে, গুণের প্রচার কি করে’ হয়?

 প্রচারের আর একটা পন্থা আছে—সেটা একটু বাঁকা; যখন সোজা আঙ্গুলে ঘি বা’র হয় না, তখন আঙ্গুলটাকে বাঁকানর বিধি আছে; এও সেই প্রকার। সোজাসুজি উপায়ে যখন লোকের দৃষ্টি আকৃষ্ট হ’ল না, তখন কবি বলেচেন—put thyself into the trick of singularity—অর্থাৎ যদি বাঁ দিকে টেরী কাটা চলতি ফ্যাসান হয়, ত তুমি কাটবে ডান দিকে; যদি টিকি রাখা রেয়জ হয়, তুমি টিকি কেটে ফেল্‌বে; চা খাওয়া প্রথা হ’লে তুমি চা ছেড়ে দেবে, and vice versa; দেখবে লোকের দৃষ্টি আকর্ষণ হবেই হবে, লোকে বলবে—লোকটার চিন্তার, চরিত্রের বিশিষ্টতা আছে—independence of character আছে। কিন্তু independence কথাটার বড় চড়া গন্ধ, অনেকের নাকে সহ্য হয় না, অতএব এপথে একটু বিপদও আছে। মোটকথা তবে, এই singularity যদি গড্ডলিকা প্রবাহের অনুকূল স্রোত ধরে’ চলে তা হ’লে বিপদ খুব কম, যথা—বিলাত প্রত্যাগত হ’য়েও যদি মুরগী না খাও, ডাক্তারী বিদ্যা শিখেও যদি মাদুলির মাহাত্ম্য ঘোষণা কর, Astronomy পড়েও যদি ‘মঘার’ আঘাতে ভয় কর, নিজে সাহেব সেজেও যদি গৃহিণীকে পর্দ্দার ভেতর পুরে রাখ, তা হ’লে এ trick of singularityতে তোমার মৌলিকত্ব, তোমার বুদ্ধিমত্তারই পরিচয় প্রদান করবে; কারণ কুসংস্কার ত্যাগে ও কুসংস্কার পোষণে উভয়ত্রই মৌলিকত্ব থাকতে পারে।

 এর চেয়ে বিজ্ঞাপনের আর একটা সহজ ও অপেক্ষাকৃত নিরাপদ উপায় হচ্ছে, কোন উদীয়মান জ্যোতিষ্কের উপগ্রহ-রূপ ধারণ করা; তা’র এ ধার-করা, আলোয় উজ্জ্বল হওয়ার একটু নিগ্রহের সম্ভাবনাও আছে,—জ্যোতিষ্ক নিষ্প্রভ হ’য়ে গেলে, নিজেকেও নিষ্প্রভ হ’য়ে যেতে হবে। অতএব একটু বুদ্ধি করে’ বস্তু চিনে নিতে হবে; আর যদি ভুলই হ’য়ে পড়ে, তা হ’লে নিভবার আগে যখন প্রদীপ হাসতে থাকবে, সেই সময়ে তা’কে পরিত্যাগ করে’ অপর কোন উদীয়মান নক্ষত্রের অন্বেষণে ফিরতে হবে; সেখানে কিছু মমতা করলে চলবে না, কেননা যে দেশের ও দশের মাঝে একজন হ’তে চায়, তার মমতা বা চক্ষুলজ্জা প্রভৃতি বালাই থাকলে চলবে না।

 এইবার বিনয়ের নানা ভঙ্গীর কথা বল্‌ব।

 একবার গুণ জাহির হ’য়ে গেলে, অর্থাৎ আমার এই মুষ্টিযোগটা লাগলে, তারপর বিনয় কাজে লাগতে পারে; যখন লোকে তোমারি প্রতিমা মন্দিরে মন্দিরে গড়চে, তোমারি ছবি টাঙ্গাচ্ছে, তোমাকে সম্বর্দ্ধনা করচে (হয়ত তোমারই ব্যবস্থামত), তখন তুমি খুব বিনয়ী হ’য়ে বলবে—হাত দুটা কচ্‌লাতে কচ্‌লাতে, ঘাড় নুইয়ে, ভূমি সংলগ্ন দৃষ্টি হ’য়ে—“আপনাদেরই কৃপা, আমি অতি অকিঞ্চন, এটা আমাকে সম্বর্দ্ধনা করচেন না, আমায় উপলক্ষ করে’ আপনারা আমার জাতকে, আমার সম্প্রদায়কে, আমার professionকেই সম্বর্ন্ধনা করচেন—ইত্যাদি ইত্যাদি।

 সতি দেবতার পশ্চাদ্ভাগ দগ্ধ করে’ সুদূর আমেরিকা থেকে বা home থেকে লম্বা খেতাব ‘জুগাড়’ করে’ আনিয়ে, সেটা ব্যবহার না করায়, পরম পবিত্র বিনয় প্রকাশ পায়; আজকাল খেতাব পরিত্যাগে কিছু সম্মান বেশী; একেবারে পরিত্যাগ যদি নাও করতে পার, খেতাবটা ব্যবহার না করে’ যদি বল—“আমি অতবড় খেতাবের উপযুক্ত নই” খেতাবটা ব্যবহার করার চেয়ে বেশী মান অর্জ্জন করবে।

 যদি তুমি লেখক হও, অর্থাৎ বই লিখে ছাপিয়ে থাক—নিজের নাম সই-করা ভুমিকায় বিনয়ের বন্যা বহিয়ে দিয়ে—প্রকাশকের নাম দিয়ে নিজের ঢাক নিজে পিটতে পার, এও এক রকম বিনয়। আর একরকম বিনয়, চর্ব্ব্য-চুষ্য-লেহ্য-পেয় দিয়ে ভোজ দিয়ে গললগ্নীকৃতবাস হ’য়ে অতিথিগণের সমক্ষে বলা—‘বিদুরের খুদ, কিছু মনে করবেন না’; অথবা বৈদ্যনাথ কি সিমুলতলায়, দুতলা বাড়ী তৈরী করে’ মর্ম্মরে মুড়ে দিয়ে, দরজায় মর্ম্মর-ফলকে লিখে দেওয়া —‘নন্দন কুটির’। এই রকম বিবিধ ক্ষেত্রে তোমার সুনামের সোনার বিনয় সোহাগার কাজ করবে। একেই বলে ‘বড় হবি তো ছোট হ’, অর্থাৎ ছোট হওয়ার ভান কর; তা না করে’, সত্য সত্য ছোট হলেই ছাগলে মুড়িয়ে খাবে।—ইতি বিজ্ঞান-বিজ্ঞাপন-মাহাত্ম্য-কথা।