কমলাকান্তের পত্র (১৯২৩)/ঐহিক ও পারত্রিক
১৬
ঐহিক ও পারত্রিক
এই ক্ষুৎপিপাসায় কাতর, সুখদুঃখের আলো-আঁধারে দিশেহারা, আশা-নিরাশার নাগর-দোলায় দোলায়মান মনুষ্য-জীবন শ্রান্ত ক্লান্ত হ’য়ে যখন অবসন্ন হ’য়ে যায়, আন্তরিক চেষ্টার ফসল যখন ফলে না, আন্তরিক স্নেহ-ভক্তির যখন প্রতিদান মিলে না, সুচিন্তিত কার্য্যশৃঙ্খলা যখন অর্দ্ধপথে কোন অপরিজ্ঞাত কারণে ছিন্ন হ’য়ে যায়, মানুষ তখন হালে পানি না পেয়ে, এই দুস্তর ভবসিন্ধু পারে এক সুখরাজ্যের কল্পনা করে’ ধৈর্য্য ধরে’ থাকে—যে সুখরাজ্যে তা’র সকল অতীত চেষ্টার ফল থরে থরে সাজান আছে, ইজ়ীবনে সকল ব্যর্থতা যেখানে সার্থক হ’য়ে উঠবে, প্রত্যেক স্নেহবিন্দুর প্রতিদান মিলবে, এ জীবন-মরুভূমির সকল উত্তাপ, সকল নীরসতা অপগত হ’য়ে যেখানে সুধু শান্তি, স্বস্তি, চরিতার্থতা, সৌন্দর্য্য চির-বিরাজমান থাকবে।
স্বর্গের কল্পনাটাই আমার ছেলে-ভুলান “রূপকথা” বলে মনে হয়, তা সে কল্পনাময় সুখস্থানকে—Atlantis বল, Heaven বল, Empyrian বল, Valhalla বল, বেহেস্ত বল, আর বৈকুণ্ঠই বল। বয়স হ’লেও মানুষ শিশুই থাকে; রোরুদ্যমান ছেলের হাতে পিটে দিলে সে যেমন শান্ত হয়, জীবনের কষাঘাতে দীর্ণ-পৃষ্ঠ মানুষ স্বর্গরূপ মোয়া হাতে পাবার আশ্বাস মাত্র পেয়েই, তেমনই শান্ত পরিতৃপ্ত হয়। এ জীবনের কষাঘাত সে বড় আশায় বুক বেঁধে সহ্য করে’ যায়। আইনতঃ ১৮ বছর বয়স হ’লে মানুষ সাবালক হয়, কিন্তু আমি দেখচি মানুষ as such আজ পর্য্যন্ত সাবালক হয় নি। কারও কারও মতে নাবালক থাকাটাই মনুষ্যত্ব; আর সাবালক হওয়াই মনুষ্যত্বের বিকার; জ্ঞান-বৃক্ষের ফল খাওয়াটা যে মানব-গোষ্ঠীর আদি পুরুষের প্রথম ও প্রধান অপরাধ বলা হয়েছে, সে গল্পের মূলে এই তত্ত্বই নিহিত রয়েচে।
ভিন্ন ভিন্ন দেশের, ভিন্ন ভিন্ন যুগের, ভিন্ন ভিন্ন জাতির স্বর্গের কল্পনা, সেই সেই দেশ, ও যুগ, ও জাতির বিশিষ্টতা নিয়ে রচিত। কিন্তু একটু প্রণিধান করে দেখলেই বুঝা যাবে যে, সকল স্বর্গের কল্পনাই যার যেখানে ব্যথা—যে ব্যথার আর প্রতীকার হল না, বা যার যেখানে আনন্দ,—যে আনন্দের সমাপ্তি মানুষ চায় না, তা’র কল্পিত স্বর্গে সে ব্যথার অবসান, আর সে আনন্দের অফুরন্ত আয়োজন। ঐহিক জীবনের শেষ হয়, মানুষ মরে—স্বর্গে মানুষ দেবতা হ’য়ে যায়, মরণের অতীত হয়। দিনরাত খেটে খেটে মানুষ পেটের অন্ন সংগ্রহ করতে পারে না—স্বর্গরাজ্যে আহারের মোটেই অভাব নেই। এ জীবনে পরস্পর দ্বন্দ্ব প্রতিযোগিতা কলহ, এই অন্ন নিয়ে,— স্বর্গরাজ্যে সে অন্ন-সমস্যার সমীচীন মীমাংসা হ’য়ে গেছে, অমৃত ভাণ্ড অফুরন্ত, পান করবামাত্র পরিতৃপ্তি, সুতরাং প্রতিযোগিতা নেই, দ্বেষ নেই, হিংসা নেই। এ জীবনে ছোট বড়, যুবা বৃদ্ধ সুরূপ কুরূপ, ধনী দরিদ্র, কত রকমের পার্থক্য, কত প্রকার শ্রেণীবিভাগ—স্বর্গে সব সমান, সব একাকার,—সব সুন্দর, সব যুবা, সকলেই রক্তাম্বর-পরিহিত, চতুরস্র।
দুঃখের বিষয় কেউ স্বর্গ হ’তে ফিরে এসে সে দেশটার firsthand পরিচয় দেয় নি! আমি আফিমের (যে দিব্যবস্তুটা অমৃত বা ambrosiaরই পার্থিব সংস্করণ) মৌজে কতবার “অশ্বিনী ভরণী কৃত্তিকা রোহিণী” পার হ’য়ে সে দিব্যদেশে গিয়েছি—মৌজ ফুরালে আবার ফিরে এসেছি। আমি কিন্তু সে দেশের খুব বেশী সুখ্যাতি করতে পারলুম না। দেশটা বড়ই একঘেয়ে। দেশটা খুব তক্তকে ঝক্ঝকে, কোথাও মলামাটি নেই, কোথাও একটু হেলাগোছা নেই—যেন একটা খুব বড় রকমের Whiteaway Laidlawর দোকান—সেখানে যেন সদাই মৌজ—সেখানে খোঁয়ারির হাই উঠে না—সদাই ভরপুর নেশা। খানিকক্ষণ থাকতে ভাল, কিন্তু শীঘ্রই অরুচি জন্মে যায়। সেখানে কিছুক্ষণ বেড়িয়ে আসাটা মন্দ নয় কিন্তু বেশী দিন থাকা চলে না—অনন্ত জীবনের কথা ত দূরে! আমি যতবার গেছি, কিছুক্ষণ পরে ফিরে আসতে পথ পাই নি। আমার এই বিচিত্র, সুখে দুঃখে বিজড়িত, মলামাটি মাখা,—কষ্টের মধ্যে সুখের, অভাবের মধ্যে পূর্ণতার, অসাফল্যের মধ্যে সাফল্যের, খোঁয়ারীর মধ্যে মৌতাতের, সম্ভাবনা মাত্র নিয়ে যে জীবন—ক্ষণিকের হ’লেও, যে আনন্দ প্রদান করে, অমৃতের মধ্যে তা’র সন্ধান মিলে না। সম্ভাবনার যে উন্মাদ আনন্দ, তা অমৃতের মধ্যে নেই, আফিমের মধ্যে আছে। সেখানে সবই হ’য়ে গেছি, কিছু হ’তে বাকী নেই; সবটাই সম্পূর্ণ, সেখানে গল্পটা শেষ হ’য়ে গেছে। আমার জীবন সম্ভাবনা নিয়ে, আমার জীবন-নাটকের যবনিকা পড়ে নি, পড়বে না; আমি যাব, আর-এক কমলাকান্ত আসবে। সেখানে কমলাকান্ত এক এবং অদ্বিতীয়, এবং তা’র আর পরিবর্ত্তন নেই। সে একটা জ্যান্ত mummy হ’য়ে পড়ে থাকা মাত্র।
এখন পৌরাণিক যুগ গিয়ে বিজ্ঞানের যুগ এসেছে; স্বর্গের কল্পনাটাও একটু বদ্লে গিয়ে নতুন মূর্ত্তি ধরেছে। নক্ষত্র-লোকের পরপারে স্বর্গকে আর বিজ্ঞানের telescopeএ দেখা যাচ্ছে না; তাই মানুষ আপনার গৃহস্থালীর ভেতর, আপনার রচিত সমাজ-দেহের ভেতর, রাষ্ট্র-বিস্তারের মধ্যে, স্বর্গের ভিত গাড়তে সুরু করেচে। Valhalla, বা Empyrianএর কল্পনা ছেড়ে দিয়ে, মানুষ Utopiaর নূতন বনেদ্ খুঁড়তে আরম্ভ করেচে।
Some day here and everywhere Life, of which you and I are but anticipatory atoms and eddies, Life will awaken indeed, one and whole and marvellous like a child awakening to conscious life.
এই সেই পুরাতন কল্পনা নূতন আকারে হাজির করা হয়েছে মাত্র; এ কল্পনার মূলে সেই আকাঙ্ক্ষা—সম্পূর্ণ হ’লেই আখ্যায়িকার পরিসমাপ্তি ও যবনিকা পতন। Serenity, beauty, all the works of men—in perfect harmony—minds brought to harmony—an energetic peace—confusions dispersed—A world of spirits—crystal clear.
সুধু অমৃত ও চতুর্হস্ত আর রক্তাম্বর বাদ, আর সবই সেই পুরাতন কথা। বৈজ্ঞানিক Utopiaয় কি থাকবে আর কি থাকবে না, তা’র বিশেষ বিবরণ এই—
Here was no yelping and howling of tired and irritated dogs, no braying, bellowing, squealing, and distressful outcries of uneasy beasts, no farm-yard clamour, no shouts of anger, no barking and coughing, no sounds of hammering, beating, sawing, grinding, Mechanical hooting, whistling, screaming, and the like, no clattering of distant trains, clanking of automobiles, or other ill-contrived mechanisms, the tiresome and ugly noises of many an unpleasant creature were heard no more. In Utopia the ear, like the eye, was at peace. The air which had once been a mud of felted noises was now a purified silence.
কিন্তু আমি বুঝতে পারি না, ৩০০০ বৎসর পূর্ব্বে মানুষ মোটের মাথায় যা ছিল, এখনও তাই রয়েছে, অতএব ৩০০০ হাজার বৎসর পরেও তাই থাকবে না কেন? এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডটা তাই থাকবে, সেই মৃত্যু, সেই ব্যাধি, সেই ভূমিকম্প, সেই ঝঞ্ঝাবাত, সেই বিষধর সর্প, সেই অগ্ন্যুৎপাৎ, জলে স্থলে সেই হিংস্র পশু পক্ষী—সুধু মাঝখান থেকে মানুষ দেবভাবাপন্ন হ’য়ে যাবে, আমি একথা বিশ্বাস করি না। যে উপায়ে ভূতল রসাতলে না গিয়ে স্বর্গরাজ্যে পরিণত হ’তে পারে তা’ আমি জানি। তবে মানুষ যদি চিরদিন নাবালক থেকেই সুখী হয়, দিদিমার গল্পেই যদি তা’র শান্তিলাভ ঘটে, আমি তা’কে নূতন পন্থা বাৎলে দিয়ে বিব্রত করতে প্রস্তুত নই; আর পথ বাৎলাতে গেলে নিজের বিপদও কম নয়!