১৭

বাস্তু

বাস্তু প্রধানতঃ তিন প্রকার—বাস্তু-দেবতা, বাস্তু-ঘুঘু আর বাস্তু-সাপ।

 বাস্তু-দেবতা সম্বন্ধে ত্রিকালজ্ঞ ঋষিগণ এইরূপ কহিয়াছেন, যথা— “পূর্বকালে অন্ধকগণকে বধ করিবার সময় শূলী শম্ভূর ললাটের স্বেদবিন্দু ধরা পৃষ্ঠে পতিত হইলে পর, তাহা হইতে এক করালবদন প্রমথের উদ্ভব হয়। সেই ভূতযোনি জন্মিবামাত্র সপ্তদীপা বসুন্ধরাকে গ্রাস করিতে উদ্যত হয়। সমর ক্ষেত্রে নিপতিত অন্ধকগণের রুধির স্রোতে পিপাসা নিবৃত্তি না হওয়ায়, সেই প্রমথ প্রমথনাথের ধ্যানে নিমগ্ন হয়; আশুতোষ তাহার নিদারুণ তপশ্চরণে পরিতুষ্ট তইয়া বলেন ‘বরং বৃণু’। প্রমথ বলিল ‘ভূমণ্ডল হইতে ত্রিদিব পর্য্যন্ত সমস্ত গ্রাস করিতে পারি এই বর প্রদান করুন’; আশুতোষ বলিলেন ‘তথাস্তু’। তখন সেই প্রমথ নিজ দেহ বিস্তার করিয়া স্বর্গমর্ত্য আচ্ছন্ন করিয়া ফেলিল। দেবাসুর সকলেই ভীত হইয়া আত্মরক্ষার্থ পিশাচকে চতুর্দ্দিক হইতে বেষ্টন করিয়া নিশ্চল করিয়া ফেলিলেন। তখন পিশাচ বলিল ‘হে দেবগণ, আপনারা ত আমার চলৎ-শক্তি হরণ করিলেন, আমি কি খাইয়া বাঁচিয়া থাকিব?’ তখন ব্রহ্মাদি দেবতারা বলিলেন, ‘তুমি আজ হইতে বাস্তু-দেবতা হইলে, তোমার প্রীত্যর্থে যে বাস্তু-যজ্ঞাদি অনুষ্ঠিত হইবে তাহারই বলি অর্থাৎ উপকরণ তোমার ভোজ্য হইল।’ বিচক্ষণ দেবতাসকল এই প্রকারে আপনাদের বিপত্তি মানুষের উপর চাপাইয়া দিয়া নিশ্চিন্ত হইলেন।”

 পুরাণকার মাত্রেই রূপক ব্যবহারে সিদ্ধহস্ত; সোজা কথা সাদা রকমে বলা তাঁদের ধারা নয়। কিন্তু এ রূপকের গূঢ় তাৎপর্য্য কাহারও বুঝতে বাকি থাকবে না। আমাদের সুজলা-সুফলা-শস্যশ্যামলা বঙ্গভূমির উপদেবতা স্বরূপ যে ভূস্বামীকূল নিরীহ রায়তের স্কন্ধে ভর করে’ পুরুষানুক্রমে খোস মেজাজে দিনপাত করে’ আসচেন, তাঁদেরই লক্ষ্য করে’ যে এই রূপক রচনা করা হয়েচে, তা’র আর ভুল কি? আশুতোষরূপী রাজস্ব-বিশারদ পণ্ডিতগণ মাথার ঘাম পায়ে ফেলে, রাজস্বের পাকা বন্দোবস্ত করে’, সেই ভূস্বামীদিগকে Rent Collectorএর পদ থেকে উন্নীত করে’, বাস্তু-দেবতা বানিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত হয়েচেন, সেই বাস্তুগণ সমস্ত দেশটাকেই আচ্ছন্ন করে’ রেখেচেন। আর ‘বাস্তু মধ্যে তু যো বলিঃ’ তাঁদেরই প্রাপ্য হ’য়ে রয়েচে। সে বলির অন্ত নেই;—চাষা ছেলে-মেয়ের বিয়ে দেবে, তা’র জন্য বাস্তু-দেবতাকে যজ্ঞভাগ দিতে হবে, রৌদ্রে শিশিরে চাষা ক্ষেত্রে শস্য উৎপন্ন করবে, তা’র অগ্রভাগ তাঁকে দিতে হবে—ইত্যাদি ইত্যাদি।

 তারপর বাস্তু-কপোত বা ঘুঘুর কথা বলি শ্রবণ কর। এই বাস্তু-ঘুঘু নানা জাতীয়—পক্ষীতত্ত্ব-বিশারদ লাহা মহাশয় জানেন, যথা—তিলে-ঘুঘু, পাঁড়-ঘুঘু, রাম-ঘুঘু ইত্যাদি, তফাৎ মাত্র রঙে, না হ’লে সবই ঘুঘু। এই কপোতকুল যে ভিটায় চরতে আরম্ভ করে, তা’র আর নিস্তার নাই। এই কপোতকুলের কবলে পতিত হ’য়ে আজ পর্য্যন্ত কেহ যে মুক্তিলাভ করেছে তা’র প্রমাণ পাওয়া যায় না। এরা এক আড়ি দিয়ে তিন আড়ি গ্রহণ করে। এরা মহা-জন, গরীবের প্রতি অনুগ্রহ করতে পশ্চাৎপদ নয়; তবে সকল ঐহিক অনুগ্রহ যেমন মূল্য দিয়ে শোধন করে’ নিতে হয়, ইহাদেরও অনুগ্রহ শতকরা ২৫ বা ৫০ হিসাবে, ত্রৈমাসিক বিশ্রাম সহ (quarterly rest) ব্যাজ দিয়ে কিনতে হয়। আর একবার সেই মহাজনগণের আটাকাটিতে পড়লে, মরলেও নিস্তার লাভ করা যায় না। বাস্তু-দেবতার বলি যোগাতে যোগাতে নিঃস্ব চাষী এই কপোতকুলের কবলে না পড়ে’ও পারে না। দুঃখ এই, যে এ পর্য্যন্ত এমন পাখ-মারা কেহ জন্মাল না, যে এ ঘুঘুর বাসা ভেঙ্গে দিয়ে চাষীকে মুক্ত করে। দেশের প্রাণ সে বেচারা, ধুঁয়ার ছলনা করে’ নয়, সত্য সত্যই চোখে ধোঁয়া দেখে’ আর কেঁদে’ দিন কাটায়।

 তারপর বাস্তু-সাপের কথা। এ সাপ অজর অমর, এমন কি সনাতন বল্লেও চলে। বিষধর হলেও ঘরের কোণে বহুকাল বাস করার জন্য গা-সওয়া হ’য়ে গেছে; ক্রমে ল্যাজ খসে’ যাচ্ছে বটে, কিন্তু বিষের কিছু কমতি হয় নি। এ সাপকে ignore করে’ চলে’ গেলে, তোমার গা ঘেঁসে গেলেও, একবার ফোঁসটি পর্য্যন্ত করবে না, কিন্তু অসাবধানে ল্যাজে পা দিয়েছ কি অমনি ফণা বিস্তার করে দংশনোদ্যত হবে। ইনি জাতিতে ব্রাহ্মণ! এ বাস্তু গৃহ-দেবতারূপে ঘরে ঘরে বর্ত্তমান, দেশব্যাপী পুঞ্জীকৃত অন্ধকারের আশ্রয়ে ইহার বসতি, অন্ধকারই ইহার শক্তি, বাস্তু মারলে গৃহস্থলীর অকল্যাণ এই অন্ধ বিশ্বাস ইহার জীবনধারণোপায়। ফোঁসের ভয়ে কেউ কিছু মুখ ফুটে বল্‌তে পাচ্চে না, কিছু করা ত দূরের কথা, কিন্তু তাদের হৃদয়ের অন্তঃস্থল হ’তে এই প্রার্থনা উত্থিত হ’তে আরম্ভ হয়েচে:—

অয়ে কৃষ্ণ স্বামিন্ স্মরসি নহি কিং কালীয়হ্রদং,
পুরা নাগগ্রস্তং স্থিতমপি সমস্তং জনপদং।
যদীদানীং তৎ ত্বং নৃপ ন কুরুষে নাগদমনং,
সমস্তং মে নাগো গ্রসতি সবিরাগো হরি হরি॥