কমলাকান্তের পত্র (১৯২৩)/মাঝামাঝি
১৮
মাঝামাঝি
মুখুয্যে মহাশয় একজন “স্ব-ভাব” মৌতাতী, বড় উমদা লোক। “স্ব-ভাব” মৌতাতী কা’কে বলে বোধ হয় তোমরা জান না। লিভারে ব্যথা, বা অর্থকৃচ্ছতার জন্য, বা রক্ত ঠাণ্ডা হ’য়ে এলে পর যারা উপদ্রবী liquid fire পরিত্যাগ করে’ নিরুপদ্রব অহিফেন ব্রত গ্রহণ করে’ তা’রা “ভঙ্গ”। অন্ধকার হ’তে আলোয় আসলে, অর্থাৎ ধর্ম্মান্তর গ্রহণ করলে, আধ্যাত্মিক বা আত্মিক কারণ ছাড়া আরও আরও কারণ থাকতে পারে বলে’, অনেক সময় সে আলোয় আসাকে সৎসাহসের পরিচায়ক বলে’ না ধরে নিয়ে, লোকে অধঃপতনের কারণই বলে’ থাকে। মৌতাত সম্বন্ধেও বিশেষজ্ঞের সেইরূপ ধারণা; অহিফেনের সঙ্গে যার অহেতুকী প্রেম, “কারে পড়ে” প্রেম নহে, তা’কেই বলে “স্ব-ভাব” মৌতাতী, আর সব “ভঙ্গ”।
সেই মুখুয্যে মহাশয়ের বাড়ি একবার কুটুম্বিতা করতে গিয়েছিলুম। সায়াহ্নে তাঁর বৈঠকখানায় বহুলোকের সমাগম হয়; বলা বাহুল্য সকলেই মৌতাতী—স্ব-ভাব ও ভঙ্গ উভয়বিধ। মুখুয্যে মশায় সকলকে “আফিং সেবন হয়েচে ত?”—বলে’ স্বাগত জিজ্ঞাসা কল্লেন। সকলেই সস্মিত মস্তক সঞ্চালন দ্বারা জ্ঞাপন কল্লেন যে সে শুভকার্য্য যথাবিধি ও যথাকালে সম্পন্ন হয়েচে। একটি ভদ্রলোক কেবল অতিশয় চিন্তান্বিত হ’য়ে বল্লেন “দেখুন বড় মুস্কিলে পড়েছি।”
মুখুয্যে। মুস্কিল কিসের? মুস্কিলে আসান “কাল”-মাণিকপীর ত আছেনই, তা’র আর ভাবনা কি?
ভদ্রলোক। আজ্ঞে, মুস্কিল কি জানেন? আমি ঠিক ৪টার সময় আফিং খাই; ৪টা ত অনেকক্ষণ বেজেছে, কিন্তু এ পর্য্যন্ত মৌতাতও হয় নি, বেয়াড়াও ধরে নি; আফিং খেলাম কি না ঠিক বুঝতে পাচ্চি না!
মুখুয্যে। এ ত বাস্তবিকই মুস্কিলের কথা বটে! এখন পুনশ্চ খেলেও মুস্কিল, না-খেলেও মুস্কিল? খাওয়া, আর না-খাওয়া ত জানতাম ন্যায়শাস্ত্রের Excluded middle; কিন্তু এখন দেখচি তা নয়, এতদুভয়ের মাঝামাঝি একটা অবস্থাও আছে—যথা, আফিং খেয়েও যদি মৌতাত না হয়, অথবা আফিং না-খেয়েও যদি খোয়ারী না ধরে! উপায়?—অনেক বিচার বিতর্কের পর (যে হেতু where many meet there is wisdom, আর সে many যদি মৌতাতী হয় তা হ’লে ত কথাই নেই) স্থির হ’য়ে গেল যে এক মাত্রা সেবন করাই বিধি—যদি দোকরই হয়—অধিকন্তু ন দোষায়।
কিন্তু আমি সেই মুহূর্ত্তে এই “মাঝামাঝি”র সমস্যা ভাবতে লাগলুম,—দেখলুম যে, যেখানে “মাঝামাঝি” সেইখানেই মুস্কিল Golden mean বলে’ একটা অবস্থা আছে, সেটা half-way houseএর মত, মধ্য পথে ক্ষণিক বিশ্রামের স্থান হ’তে পারে, কিন্তু গন্তব্যস্থান, পথের শেষ, goal হ’তে পারে না। কাছে ও দূরে, অন্তরে বাহিরে, আমি কোথাও মাঝামাঝি ব্যবস্থা চূড়ান্ত ব্যবস্থা বলে’ দেখতে পেলুম না। প্রসন্ন খাঁটি দুধের সঙ্গে পবিত্র গঙ্গোদক মিশ্রিত করে’ যে মাঝামাঝি পদার্থ সৃষ্টি করে, তা’তে দুগ্ধ এবং গঙ্গোদক উভয়েরই মাহাত্ম্য নষ্ট হ’য়ে যায়; golden mean বলে’ প্রসন্নকে কেউ মার্জ্জনা করে না, মুখে কা’রও বলতে সাহস হ’ক আর নাই হ’ক। সাদায়-কালায় মিশিয়ে যে চুনোগলি, এণ্টালি প্রভৃতির সৃষ্টি, সে-সকল মাঝামাঝি জীবের গুণাগুণ যা’রা জানে তারা বলে—give me a true-born Englishman or an unadulterated native but not one who is neither fish nor flesh nor a good red herring, অশ্বতর golden mean হ’লেও প্রকৃতির ত্যজ্যপুত্র।
জল ও স্থলের মাঝামাঝি যে জিনিষ তা’র নাম কর্দ্দম; জলে সাঁতার কাটা চলে, স্থলে দৌড়ান যায়; কিন্তু হাতিও ‘দঁকে পড়লে’ কাবু হ’য়ে যায়—এমন কি ব্যাংএও লাথি মেরে যেতে পারে।
সত্যি ও মিথ্যা ছেলেবেলা মনে করতুম চিন্তারাজ্যকে dichotomy করে’ ভাগ করেছে। কিন্তু “ক্রমশো বিজ্ঞতমঃ” হ’য়ে বুঝলুম যে, সত্য ও মিথ্যার মাঝামাঝি একটা খুব প্রশস্ত ক্ষেত্র আছে, সেখানে সত্যের শুভ্রতা বিনয়ের কলপ দিয়ে মলিন করা হয়েচে, এবং মিথ্যার মালিন্যকে সততার চূণকাম করে’ বেশ ধবলতা দেওয়া হয়েচে; এই সত্য-মিথ্যার মাঝামাঝি ক্ষেত্রে যে খেলোয়াড় জয়যুক্ত হ’তে পারে সে কুরুক্ষেত্র বা ওয়াটারলু জয়ী অপেক্ষা দুর্দ্ধর্ষ।
স্বর্গ ও মর্ত্ত্যের মাঝামাঝি যে ত্রিশঙ্কু রাজার পারলৌকিক অবস্থানমার্গ—যে রাজ্যটা হওয়া আর না-হওয়ার মধ্যবর্ত্তী, যে রাজ্যের নাম বাঙ্গালায় বলে “হইলে-হইতে পারিত”, আর ইংরাজিতে বলে fool’s paradise, যে রাজ্যের যাত্রী আমরা অনেকেই, তা’র খুব বেশী পরিচয় দেবার প্রয়োজন হবে না।
শত্রু ও মিত্রের মাঝামাঝি এক জীব থাকেন তাঁর নাম নিরপেক্ষ neutral,—যিনি কারও অপেক্ষা করেন না, যিনি ঐহিক সম্পদে এতই উচ্চে অবস্থিত যে কারও অপেক্ষায় না থাকলেও চলে, তাই তিনিই নিরপেক্ষ। অথবা যিনি neutre অর্থাৎ ক্লীব, তিনিই neutral, জোর করে’ ‘হাঁ’ কিম্বা ‘না’ যাঁর বলবার সাহস জুয়ায় না তিনিই neutral.
এই neutrality ব্যক্তি বা সম্প্রদায় মধ্যে নানা রূপ ধারণ করতে পারে যথা, benevolent neutrality, বা armed neutrality; কিন্তু যে প্রকারের neutralityই হ’ক, যিনি নিরপেক্ষ বা ক্লীব (neutre) তিনি উভয় পক্ষেরই শত্রু; সুতরাং বিষয়বুদ্ধি সম্পন্ন লোকে বুঝেই রাখে—He who is not for us, is against us. ইহাই নিরপেক্ষতারূপ মাঝামাঝি অবস্থা বিষয়ে নিরাপদ পন্থা।
রেলে তৃতীয় শ্রেণী আছে, দ্বিতীয় শ্রেণী আছে, আর মাঝামাঝি শ্রেণী অর্থাৎ intermediate class আছে। এই মাঝামাঝি শ্রেণীর যে কি নিগ্রহ তা যে রেলপথে যাতায়াত করেছে সেই জানে। তৃতীয় শ্রেণী থেকে মাঝামাঝি শ্রেণীকে তাড়াতাড়ির সময় চেনা যায় না; ষ্টেসনে গাড়ি থামলেই আত্মরক্ষার জন্য মাঝামাঝি শ্রেণীর লোকদের “দেড়া দেড়া” বলে’ চীৎকার করতে হয়। তা’তে দুটা অনর্থ ঘটে—একতো, তৃতীয় শ্রেণীর লোকতাড়ানর জন্য তাদের বিরাগ ভাজন হ'তে হয়; তারপর, তৃতীয় শ্রেণীর যাত্রীদের হ’তে তাঁরা যে উঁচু, এই অভিমানটা প্রত্যেকবারই প্রকট হ’তে হ’তে, অন্তর্নিহিত উত্তাপটা বেড়ে গিয়ে তাঁদের নৈতিক অবনতি সাধন করে। মাঝামাঝি শ্রেণীকে চিরদিনই—রেলের গাড়িতেই হ’ক বা জীবনের পথেই হ’ক, এই রকম আপনাদের বিশেষত্বটা জাহির করবার জন্য সদাই সজাগ থাকতে হয়, পাছে গোলা লোকের সঙ্গে মিশিয়ে গিয়ে তাঁদিকে কেউ চিন্তে না পারে এইজন্য সদাই self-conscious হ’য়ে, ত্রস্ত হ’য়ে, শিউরে আড়ষ্ট হ’য়ে থাকতে হয়; তাতে সকলদিকেই অস্বস্তির কারণ হ’য়ে উঠে।
Genius যে তা’র সাতখুন মাপ; সে Convention মানে না, সে গতানুগতিক নয়। সে রেপরোয়া, আপনার পথ আপনি কেটে চলে; আর যে Genius নয়, গোলালোক, সে গড্ডলিকা প্রবাহে গা ভাসান দিয়ে নিশ্চিন্ত মনে চলে যায়। কিন্তু যে intermediate classএর লোক, অর্থাৎ গোলালোকও নয় এবং Geniusও নয়, সে সদাই অসুখী, আর তা’র ঝাঁজও অসহ্য। কবি বলেচেন—Unpretending mediocrity is good, and genius is glorious; but a weak flavour of genius in an essentially common person is detestable. It spoils the grand neutrality of a commonplace character, as the rinsings of an unwashed wine glass spoil a draught of fair water.
ধনী ও দরিদ্র এই দুই শ্রেণীর মাঝামাঝি যে স্তর, অর্থাৎ মধ্যবিত্ত লোক, তাদের মত হতভাগ্য কি কেউ আছে? ধনী যে সে potential energyতে ভরপুর; দরিদ্র যে সে তার হাত পা নিয়ে kinetic energy নিয়ে বলবান, সে দিন আনে দিন খায় বটে কিন্তু কারও মুখাপেক্ষা করে না, দরকার হ’লে গতর খাটায়, আবার দরকার হ’লে চুরি ডাকাতিও করে বা ভিক্ষা করে; কিন্তু মাঝামাঝি অর্থাৎ মধ্যবিত্ত লোক Cannot beg, nor can they steal; অনেক সময় গতর খাটাতেও নারাজ, সুধু মস্তিষ্ক চালনায় যা হয়। দুর্দ্দিনে ইহারাই বেশী কষ্ট পায়, ধনীও নয়, দরিদ্রও নয়।
জানা আর না-জানার মাঝামাঝি, জ্ঞান ও অজ্ঞানতার মধ্যবর্ত্তী অবস্থাও কি ভয়ানক! কবি বলেছেন—Where ignorance is bliss ’Tis folly to be wise—ইহার অর্থ এ নয় যে, অজ্ঞানতা ভাল জ্ঞানের অপেক্ষা; ইহার অর্থ—যখন অজ্ঞানতাই সুখের তখন জ্ঞানী হওয়া মূর্খতা। অজ্ঞানতা সুখের কখন? যখন জানা না-জানার মধ্যস্থলে থেকে মানুষ হাবুডুবু খায়, তখনই বরং অজ্ঞান তিমিরই ভাল। কেন না অন্যত্র কবি বলেছেন—Drink deep or taste not the Pyerian spring; আমাদের চলিত কথায়ও বহুকালের অভিজ্ঞতা এই ভাবেই ব্যক্ত করা আছে—
যে বুঝেচে সে মজেচে
যে বুঝেনি সে আছে ভাল
যে আধ্ বুঝেচে তার প্রাণ গেল।
একচ্ছত্রী নিরঙ্কুশ সম্রাট যার ইচ্ছাই আইন,—আর সকল শাসন ক্ষমতার প্রস্রবণরূপী জনশক্তি, তা’র আদেশ ও ইচ্ছাদ্বারা নিয়ন্ত্রিত যে শাসনযন্ত্র—এই দুই ধারার, Autocracy ও Democracyর, মধ্যবর্ত্তী একটা খিচুড়ী আছে যার নাম Limited monarchy. এ মাঝামাঝি ব্যবস্থার যে বাহার তা’র খরচ অনেক; সে খরচ বাজে খরচ বলে’ দুই একটা দেশ ছাড়া, আর সব বড় দেশ থেকে সে শ্বেত-হস্তীর পূজা উঠে গেছে
স্বাধীন ও পরাধীনের মধ্যবর্ত্তী অবস্থা হচ্ছে Protectorate; মহাযুদ্ধের পর Protectorate কথাটার কাকু ধরা পড়ে যাওয়াতে, আর একটা কথা তা’র পরিবর্ত্তে ব্যবহার আরম্ভ করা হ’য়েচে—Mandatory; বস্তু একই, অর্থাৎ দেশটা দেশবাসীরই রইল—কেবল চাবিকাটিটা Mandatory, অর্থাৎ যিনি বা যাঁরা ভারপ্রাপ্ত, তাঁদের আয়ত্ত্বের ভিতর থাকল। এই রকম Protectorate বা Mandatory ইংলণ্ডেরও আছে, ফরাসিরও আছে, ইটালিরও আছে। ফরাসির Mandatory আনাম প্রদেশ, সেখানে রাজা আছেন, তাঁর দরবার আছে—তিনি আইনে সর্ব্বশেষ স্বাক্ষর না করলে আইন মঞ্জুর নয়—কিন্তু মঞ্জুর না করাও তাঁর ইচ্ছা সাপেক্ষ নয়; এই যে Duality বা দ্বৈতবাদ, কাগজে কলমে ইহার একটা অর্থ থাকতে পারে, কিন্তু আনামবাসীদের জীবনে ইহার কোনই সার্থকতা নাই, যদি কিছু থাকে তা অর্থনষ্ট ও মনোকষ্ট দুই একসঙ্গে; কেননা মোটা মোটা মাহিনার বড় ছোট মেজো ফরাসি কর্ম্মচারী দেশের অর্থ শোষণ কচ্চেন, আর দেশের লোক যে তিমিরে সেই তিমিরে রয়ে গেছে। মাঝামাঝি থাকার পূর্ণ প্রতিফল তা’রা পাচ্চে। এইরকম সকল Protectorateএরই দুরবস্থা।
আমাদের দেশে Bureaucracy অর্থাৎ Autocracyর কথঞ্চিৎ পরিবর্ত্তন করে’, Democracyর দিকে শাসন-যন্ত্রটাকে নিয়ে যাবার জন্য, মধ্যপথে, auto-democracy (জানি না একথাটা চল্তি কি না) বা Diarchy নামধেয় একটা নবীন পদ্ধতির experiment চলেচে। বেওয়ারিশ রোগীর উপরই হাসপাতালে experiment চলে। আমরা বেওয়ারীশও বটে, রোগগ্রস্তও বটে; তাই আমাদের উপর এই উদ্ভট শাসন-পদ্ধতির experiment চলেচে—দেখা যাক রোগ গিয়ে স্বাস্থ্য ফিরে আসে, কিম্বা রোগ ও রোগী দুইই যায়!
কেহ কেহ বলেন যে এটা transitional period. আরে বাবা, গচ্ছতি ইতি জগৎ, এর স্থিতি বলে’ কিছু নেই, এটা সকল মুহূর্ত্তেই চলবে, এর সকল মুহূর্ত্তই transitional. সৃষ্টির মুহূর্ত্ত থেকে লয়ের পূর্ব্ব মুহূর্ত্ত পর্য্যন্ত সমস্তটাই একটা বড় বিরাট transition; এর স্থিতি বলে’ যদি কিছু থাকে সেই শেষে যখন finish বলে’ গ্রন্থ শেষ হ’য়ে যাবে। আর মানুষের জীবনে এই যে সৃষ্টি ও প্রলয়ের মধ্যবর্ত্তী অবস্থা, অর্থাৎ যাকে স্থিতি বলা হ’য়েচে, সেটা মাঝামাঝি অবস্থা; আর মাঝামাঝির সকল দুঃখ তা’র ভিতর আছে। কবি বলচেন—From the great deep to the great deep he goes, এই দুই অতলস্পর্শের মধ্যস্থিত—অনাদি অতীত ও অনন্ত অনাগতের মাঝামাঝি দুদিনের ঘুর্ণিপাকে কি আলোড়ন বিলোড়ন, এই ক্ষুদ্র সঙ্কীর্ণ যোজকের মধ্যে কি নাবাউঠা, কি টানাটানি,—“মাঝামাঝি”র সমস্ত দুঃখের কি একত্র সমাবেশ! এ দুঃখের একমাত্র ঔষধ আমি জানি, যদি কেউ চাও ত আমি দিতে পারি।