কমলাকান্তের পত্র (১৯২৩)/বলা ও করা
১৯
বলা ও করা
আজন্ম শুনে আসচি যে “বলা সহজ, করা শক্ত”। প্রবচন মাত্রেই যেমন আধা-সত্য এটাও তাই। কিন্তু সত্যের চেয়ে আধা-সত্য মারাত্মক হ’লেও যেমন চলতি বেশী, এ আধা-সত্যটারও চলন লোকের মুখে মুখে। সত্যের একটা পরীক্ষা (সেটা চূড়ান্ত পরীক্ষা না হ’লেও) লোকের মুখেই হ’য়ে থাকে—দাদা কি বলেন, গুরুজী কি বলেন, অমুক মহামহোপাধ্যায় কি বলেন, অমুক ন্যায়পঞ্চানন কি বলেন, শেষ মনু কি বলেন, যাজ্ঞবল্ক্য কি বলেন—যে হেতু জ্যান্তর চেয়ে মরার কথার বেশী জোর—আর মুখের যুক্তি অপেক্ষা লিখিত তথা ছাপিত যুক্তির জোর নিশ্চয়ই বেশী। ফরাসীতে বলে—parole s’en vole, ecrit reste—কথা হওয়ায় উড়ে যায়, লেখা থাকে। লেখা তথা ছাপার যেমন একটা গুণ স্থায়িত্ব, তেমনি একটা দোষ উড়ে না যাওয়া। যে কথাটা শূন্যগর্ভ বলে’ একদিনে হাওয়ায় উড়ে যেত, সেটা ছাপা হ’লে অন্ততঃ এক বছর বেঁচে থাকবে; আর যদি কোন স্থানে চাপা পড়ে থেকে, উই আর ইঁদুরের হাত থেকে কোন রকমে বেঁচে গিয়ে, দু’শ বৎসর পরে তা’র resurrection হয়—তা হ’লে সেটা আরও দু’শ বছর বেঁচে থাকবার মত পরমায়ু লাভ করবে। ছাপাখানার যদি কিছু দোষ থাকে ত এই অপদার্থকে পদার্থত্ব দিয়ে মূল্যবান করে’ তোলা—অন্য কোনদিক দিয়েও যদি না হয় ত অন্ততঃ ঐতিহাসিক তথ্য বলে’ তার কদর হবে।
কিন্তু আমি বলছিলুম—লোকে যে বলে “বলা সহজ করা শক্ত”—সেটা আধা-সত্য। বলাও যে এক রকমের করা, তা’র কথা পরে বলছি। আমি দেখছি করা সহজ, বলাই শক্ত। সম্ভাব্যের অতীত যা তা করতে কেউ পারবে না, কিন্তু যেটা বলা কিছুই অসম্ভব নয় সেটাও সকলে বলতে পারে না। চুরি করার চেয়ে, চোরকে চোর বলা শক্ত; আইন বলেচেন—the greater the truth, the greater the libel; অতএব সত্যকথা বলিচি বলে’ পার পাবার জো নেই; বরং মিথ্যা বলে’—চোরকে সাধু বলে’, বেঁড়েকে চামুরে বলে’, পার ত পাওয়াই যায়, উপরন্তু কিছু লাভও হ’য়ে যেতে পারে। দুনিয়ায় দুষ্কার্য্য বলে’ যে শ্রেণীর কাজ লোকে করে তা’র তালিকা অফুরন্ত, দুষ্কার্য্য হ’লেও লোকে করচে—কিন্তু সে দুষ্কার্য্যের ব্যাখ্যা বা পরিচয় যে দেবে তা’র উপর দুনিয়াসুদ্ধ লোক খড়্গহস্ত। অতএব আমি যদি বলি করা সহজ বলেই লোকে করে, আর বলা শক্ত বলেই লোকে বল্তে পারে না, তা হ’লে কি ভুল হবে?
করার দোষ কথার জালে ঢাকা দেওয়া যায়, কিন্তু বলার দোষ কাজ দিয়ে ঢাকা যায় না। তা হ’লে কোন্টা বলবান—করা না বলা? মনে কর প্রসন্ন দুধে জল দিয়েছে, তোমার সাহস থাকে ত তুমি হয়ত বলে ফেল্লে “দুধটা পাতলা হয়েচে”—তা’র উত্তরে প্রসন্ন তোমাকে দু’টা দুর্ব্বাক্য বলে’, বা পাওনা টাকার তাগাদা করে’ (যেটা দুর্ব্বাক্য অপেক্ষা বেশী বেদনাদায়ক) তোমাকে চুপ করিয়ে দিতে পারে; অথবা যদি সে ভাল মেজাজে থাকে, নতুন গরুর দুধ একটু পাতলাই হবে—ইত্যাকার কৈফিয়ৎ দিয়ে তোমার মুখ বন্ধ করে’ দেবে; মোটের মাথায় দুধে জল দেওয়া কার্য্যটাকে কথার জালে ঢেকে দিয়ে চলে যাবে। কিন্তু যদি সে ধর্ম্ম রক্ষা করে’ সত্যি কথাই বলে’ ফেলে—তারপর তিন দিন খাঁটি দুধ যোগালেও তা’র দুধে জল দেওয়ার অপবাদ ঢাকা পড়বে না। ছোট বড় সব কথায় ও সব কাযেই এই রকম। যুদ্ধে হেরে ভাল করে’ despatch বা communique লিখতে পারলে গাধা-হারও ঢাকা দেওয়া যেতে পারে; অনেক যুদ্ধ এই রকম বাক্য দ্বারাই জয় করা হয়েচে। জাল করা ত সব যুগে সব দেশে সব স্থলে অন্যায়, কিন্তু জাল করে’ ক্লাইভ যে কৈফিয়ৎ দিয়েচেন তা’তে ক্লাইভকে জালিয়াৎ বলতে এক জনের মাত্র সাহস হয়েচে; সে কৈফিয়ৎটা এই যে, উমিচাঁদের মত দুষ্ট লোককে জব্দ করতে তাঁকে যদি দশবার জাল করতে হয়, তা হ’লে তিনি পশ্চাৎপদ হবেন না। জাল করার চেয়ে এই বলে’ কৈফিয়ৎ দেওয়ার বাহাদুরী বেশী নয় কি?
সেইজন্য বুদ্ধিমান লোকে বেশী কথা কয় না, যা করবার তা করে’ যায়। কারণ করায় যদি কিছু গলদ বেরিয়ে যায় ত কথা দিয়ে সে গলদ সংশোধন করে’ নেবার উপায় থাকে; কিন্তু কথা, হাতের ঢিল, ছেড়ে দিলে আর তা’কে ফেরাবার উপায় থাকে না, কথা দিয়েও নয়, কাজ করেও নয়। নীরব সাধনার অনেক সময় গূঢ় তত্ত্বই এই।
কথায় বলে the less said the sooner mended, তা’র মানে, কথার ছাপ মুছে না, সে ছাপ যত গভীর হ’য়ে বসে, তা’কে মুছে ফেলা তত শক্ত; অতএব, যা কর তা কর, কথা কয়ে কার্য্যের প্রকৃতি বা উদ্দেশ্যটাকে প্রকট করে’ দিও না, যদি কোন সময়ে বিপরীত মত জাহির করতে হয়—তা ঘটে উঠবে না। কাজের প্রকৃতি মল্লিনাথের টীকায় বদলে যেতে পারে, কিন্তু কথার অর্থ খুব বেশী বদলান যায় না। এ দুনিয়ায় অনেক সময় কতবার পা পিছলে পড়ে যেতে হয়, কিন্তু কোন কথা না বলে’ ঝেড়ে উঠে পড়তে পারলে, পড়ে যাওয়াটার নানা interpretation দেওয়া যেতে পারে; কিন্তু হুঁচট্ খেয়েছি বলে আর ‘শয়নে পদ্মলাভ’ বলা চলবে না। অতএব Thou shalt not speak out এইটা দুনিয়াদারীর একাদশ Commandment হওয়া উচিত।
সে দিন বাঙ্গালার একজন বিরাটপুরুষ একখানা অগ্নিগর্ভ পত্র লিখে তাঁর উপরওয়ালাকে জানিয়ে দিলেন যে, সব হুকুম বা সকল আবদার, সব মানুষের পক্ষে মানা সম্ভব নয়। পত্রখানার ভাষা নিয়ে ও ভঙ্গী নিয়ে কতই না আলোচনা গবেষণা হ’য়ে গেছে। যাঁরা পত্রখানার ধরণটা পছন্দ করেন নি, তাঁরা যদি তাঁদের মনোমত একখানা খসড়া করে’ ছাপিয়ে দিতেন তা হ’লে ঠিক বুঝা যেত, তাঁদের কিরূপ রুচি ও শক্তি, তাঁদের টিপ্পনী থেকে ঠিক বোঝা গেল না যে, কি হ’লে তাঁরা সন্তুষ্ট হতেন। কিন্তু ধরণটা যা’ই হ’ক, পত্র লেখকের উদ্দেশ্য যে সিদ্ধ হয়েছে, প্রতিপক্ষ যে বাক্যস্ফূর্ত্তি করতে অপারগ হয়েছেন—তা’তেই তাঁর আঘাতের বেগ ও লক্ষ্য যে সম্পূর্ণরূপ সময়, ব্যক্তি ও বিষয়োপযোগী হয়েছে তা’র আর ভুল নেই। ঘুষিটা চোখে না মেরে, পিঠে মারা উচিত ছিল, অথবা ঘুষি না মেরে চড় মারা উচিত ছিল, এ নিয়ে তর্ক করা বৃথা। অথবা কড়া কথা না বলে’ দু’টা মিছরীর ছুরী হানলে মন্দ হ’ত না, এ তর্কও কোন কাজের নয়। যে হেতু দেখা যায়, যেখানে কাজের প্রতি আস্থা কম, সেইখানেই কায়দার প্রতি দৃষ্টি বেশী; আর সত্যিকারের প্রাণ যেখানে নেই, সেইখানেই আচারের আড়ম্বরই সর্ব্বস্ব।
কিন্তু দুনিয়ায় যা কিছু বড়, যা কিছু কাজের, তা কথা থেকে সুরু হয়েছিল; সে কথা বজ্রের মত দিগন্ত ধ্বনিত করে’, কাপুরুষকে কম্পিত করে’, অপরাধীকে ভর্ৎসিত করে’, অজ্ঞানকে নাড়া দিয়ে, ঝঙ্কৃত হ’য়ে উঠেছিল; শব্দব্রহ্ম জেগে উঠে, সুপ্ত জগৎকে জাগিয়ে দিয়েছিল। সে শব্দের পশ্চাতে অগ্নি ছিল, তেজ ছিল, প্রাণ ছিল—শুধু প্রতিধ্বনি মাত্র ছিল না।
শূন্যগর্ভ প্রান্তরের পরপার হ’তে প্রতিধ্বনি আসে; শন্যগর্ভ মানস-ক্ষেত্র হ’তে প্রতিধ্বনি শুনা যায়। আমাদের জীবনটাই প্রতিধ্বনিময় হ’য়ে দাঁড়িয়েচে; কোথায় কবে কোন্ ধ্যানলব্ধ মন্ত্রের উদাত্তস্বর ধ্বনিত হয়েছিল—আমাদের শূন্য মানসক্ষেত্র হ’তে তা’র প্রাণহীন পুনরাবৃত্তি শোনা যাচ্ছে। যে যেদিক থেকে হাঁক দিচ্ছে, অমনি আমাদের শূন্য জীবন-প্রান্তরের এক প্রান্ত হ’তে, তা’র প্রতিধ্বনি উত্থিত হচ্চে; কিন্তু প্রতিধ্বনি, প্রাণহীন অসম্পূর্ণ মুহূর্ত্ত মাত্র স্থায়ী; আমাদের হৃদয়ের সাড়াও তাই—প্রাণহীন ও মূহূর্ত্তমাত্র স্থায়ী। কোন ডাকই আমাদের অন্তরাত্মাকে জাগাতে পাচ্ছে না, প্রতিধ্বনির প্রতিধ্বনিতেই সব মিলিয়ে যাচ্ছে। আমাদের মুখের কথা সেই প্রতিধ্বনির প্রতিধ্বনি; এই অর্থে আমাদের পক্ষে কথা কহা সহজ, কাজ করা শক্ত। কিন্তু যে বাক্য অত্যাচারের মস্তকে বজ্ররূপে পতিত হয়, অসত্যের মর্ম্মস্থল বিদ্ধ করে, অন্যায়ের অবগুণ্ঠন ছিন্ন করে’ তা’র দানব-মূর্ত্তি প্রকাশিত করে’ দেয়, সে বাক্য জ্ঞানের পরিপূর্ণতার মধ্যে জন্মগ্রহণ করে ও অকুতোভরে স্ফুরিত হয়। সে বাক্য অমূল্য!