২০

মা ভৈঃ

চারিদিকে সাড়া পড়ে’ গেছে, “নারী জেগেছে”, ভারত উদ্ধারের আর বেশী দেরী নেই; আমি কিন্তু দেখছি, “নারী রেগেছে”, তা’র সঙ্গে ভারত উদ্ধারের কোন সম্বন্ধই নেই। কেউ কেউ বলবেন—রেগেই যদি থাকেন—-ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে মানুষ ত রাগতে পারে না, অতএব আদৌ জেগেছেন, পশ্চাৎ রেগেছেন, এমন ত হ’তে পারে? হাঁ তা পারে; কিন্তু অনুগ্রহ করে’ যদি নিদ্রাই ভঙ্গ হ’য়ে থাকে, ত রেগে কি লাভ?

 সতী একবার রেগেছিলেন—আশুতোষের অনুনয় উপেক্ষা করে’, দশমহাবিদ্যার বিভীষিকা দেখিয়ে তাঁকে উদ্ভ্রান্ত করে’, পিতৃগৃহে অনাহুত হ’য়ে ছুটে গিয়েছিলেন—ফল হয়েছিল পিতার অজমুণ্ড, যজ্ঞপণ্ড, পরে আপনার দেহপাত। তারপর প্রেমময় পাগল স্বামীর স্কন্ধে ঘুর্ণায়মান শবদেহ দিক দিগন্তে ছড়িয়ে চতুঃষষ্টি পীঠস্থানের সৃষ্টি; কিন্তু ধ্বংসলীলার সেইখানেই অবসান হয় নি—প্রত্যাখ্যাত স্বামীর সহিত পুনর্মিলনের আকাঙ্খায় গিরিরাজ-গৃহে পুনরায় জন্ম পরিগ্রহ, এবং পরিত্যাগের পর পুনর্মিলন হ’য়ে তবে সে নাটকের পরিসমাপ্তি হয়েছিল। তবে তফাৎ এই, সব স্বামী ভাঙ্গড়ভোলা নয়, এমন কি আফিমখোর কমলাকান্ত পর্য্যন্ত নয়। অতএব এ রাগের ফল কি হবে তাই লোকে ভেবে আকুল হচ্চে।

 কিন্তু আমি কমলাকান্ত চক্রবর্ত্তী ভাবনার বিশেষ কারণ দেখচি না। প্রথম কারণ, মা সকল তাঁদের নিজের মামলার ওকালতি নিজেই আরম্ভ করে’ দিয়েছেন। এই অসমসাহসিকতার কাজ পুরুষও করতে সাহস করত না। মোকদ্দমা চালাতে হ’লে উকীলের যে প্রয়োজনীয়তা আছে, সেটা বিষয়বুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তিমাত্রেই স্বীকার করবেন। ধর্ম্মাধিকরণের কাঠগড়ায় ফরিয়াদী হ’য়ে দাঁড়িয়ে, নিজের মামলার নিজে সওয়াল জবাব করা, প্রলয়ঙ্করী বুদ্ধির অন্যতম পরিচয় বলে’ আমার আশঙ্কা হয়। ফল যে খুব সম্ভব মোকদ্দমায় হার, সে বিষয়ে আমার মনে সন্দেহ হয় না। অতএব স্বামী তথা আ-সামীগণকে আমি আশ্বাস দিয়ে, ‘মা ভৈঃ’ বলতে কিছুমাত্র কুণ্ঠিত হচ্চি না।

 মা সকল যে সব প্রশ্ন নিয়ে রেগেচেন, বা জেগেচেন, যাই বলুন, তা’র মধ্যে মূল হচ্চে—সাম্য—স্ত্রী ও পুরুষের সমানাধিকরণ, equality of the sexes. এই equality বা সাম্য, আপাততঃ এমনই ন্যায়সঙ্গত এবং যুক্তিসঙ্গত বলে’ মনে হচ্চে যে, সে সম্বন্ধে যে কোন তর্ক চলতে পারে তা মনেই আসে না। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তা নয়। স্ত্রী ও পুরুষের মধ্যে সাম্য মাত্র এক হিসাবে আছে—স্ত্রী ও পুরুষ উভয়েই genus homo এই পর্য্যায়ভুক্ত; তা ছাড়া, স্ত্রী ও পুরুষের মধ্যে সমতা নেই বল্লেই হয়—সামাজিক বা পারিবারিক unit হিসাবে স্ত্রী ও পুরুষ দু’টা ভিন্ন জীব।

 ভিন্ন হ’লেই ছোট বড় হ’তে হবে, তার কিছু মানে নেই; বোম্বাই আম আর মর্ত্তমান কলা, দু’টা ভিন্ন ফল,—কিন্তু কে ছোট কে বড়, ও-প্রশ্নের কোন মানেই হয় না; ১০ টাকায় এক মণ চাল,—১০ টা টাকা, আর ১ মণ চাল, দুই তুল্য মূল্য হ’তে পারে, কিন্তু দু’টা এক বস্তু নয়। অতএব দেখা যায়, ভিন্ন হ’লেও তুল্য-মূল্য হ’তে পারে; কিন্তু তুল্য-মূল্য বলে’ এক বা সমধর্ম্মী নাও হ’তে পারে। স্ত্রী ও পুরুষ সম্বন্ধে সেই কথা—ভিন্নধর্মী বলে’ কেউ কারও চেয়ে ছোট বা বড় নয়; তুল্য-মূল্যই যদি হয় তা হ’লেও এক নয়।

 People do not realise that equity and equality are not the same thing, that equality may co-exist with difference, and is not secured by sameness, and that just as the heart and the liver may each he considered “equals”, tho’ performing different functions, so the equality between men and women may, after all, best be secured by not striving for identity.

 স্ত্রী ও পুরুষ তথাপি সমান, যদি মা সকল একথা বলেন, তা হ’লে আমাকে বলতেই হবে, মা সকল “রেগেছেন”, জেগেছেন একথা বলতে পারব না।

 তারপর স্বাধীনতার কথা; মা সকলের আব্দার এই,—কেন স্ত্রী পুরুষের অধীন হ’য়ে, আজ্ঞাবাহী, পুতুল-নাচের পুতুল হ’য়ে থাকবে। এখানেও আমি “রাগার”ই লক্ষণ দেখতে পাই—“জাগার” লক্ষণ দেখতে পাই না। প্রথম কথা, গৃহস্থলীটা প্রাচীন Sparta রাজ্যের মত যুগ্ম রাজার রাজ্য হবে, না এক রাজার রাজা হবে? দুইএ এক না হ’য়ে গিয়ে, দুইজন (স্ত্রী ও পুরুষ) “স্বতন্ত্র উন্নত” হ’য়ে গৃহস্থলীকে যদি Democratic নীতি অনুসারে শাসন করতে চান, তা হ’লে রাজ্য ছেড়ে বনে গিয়েই বেশী সুখশান্তি লাভের আশা করা যায়। কার্য্যক্ষেত্রে কিন্তু দেখা যায়, যে অধিকাংশ স্থলে একের প্রাধান্যই বলবান হ’য়ে ওঠে—তা সেটা স্ত্রীরই হ’ক, বা পুরুষেরই হ’ক, অথবা স্ত্রী পুরুষ দুইএ মিশে এক হয়েই হ’ক; কিন্তু যেখানে Dual sovereignty সেইখানেই বিরোধ ও পরে বিচ্ছেদ। মা সকলের এটাও দেখা উচিত যে ঘরের বাইরে এই পরাধীন দেশে, পুরুষ বেচারী যে স্বাধীনতা উপভোগ করে, তা’র চেয়ে কিছু কম স্বাধীনতা স্ত্রীগণ অন্তঃপুর মধ্যে উপভোগ করেন না।

 তবে মা সকলের পুরুষের উপর বড় বেশী আক্রোশ এইজন্য যে, পুরুষ ব্যাভিচারী হ’লে তার সাতখুন মাপ, কিন্তু রমণীর ক্ষণিক দুর্ব্বলতার জন্য একটু পদস্খলন হলেই, সে বেচারী চিরদিনের জন্য দাগী হ’য়ে গেল, তা’র এতটুকু অপরাধেরও মার্জ্জনা নেই। মা সকলের এ কথাটা একটু খোলসা করে’ বুঝতে চাই। পুরুষের পক্ষে আইনটাকে খুব কড়া করে’ দেওয়া যদি তাঁদের অভিপ্রায় হয়, তা’তে আমার আপত্তি নেই, আমি বরং তা’র খুব পরিপোষণ করি। কিন্তু পুরুষের বেলা আইনটা যেমন আল্‌গা, নারীর বেলাও, সমানাধিকরণের নিয়মে, তেমনি আল্‌গা কেন হবে না—মা সকলের যদি এই অভিপ্রায় হয়, তা হ’লে নারী রেগেছে বলব না ত কি? আর রাগের সঙ্গেই বুদ্ধিনাশ, আর তারপর—বিনাশ।

 সাম্যবাদী বা বাদিনীরা যাই বলুন আর যাই করুন, ব্যাভিচারের যদি পারিবারিক পরিণাম কল্পনা করে’ দেখা যায়, তা হ’লে সে পরিণামকে কিছুতেই সমান বলা যায় না। Nothing will equalise the offence, however you equalise the penalty. For nothing can equalise its “consequences” or the degree of wrong that may be done by one to the other.

 স্ত্রীগণের স্বাধীনতা লাভের উপায় হিসাবে বলা হয়েছে যে, তাঁরা নিজের নিজের পায়ের উপর ভর দিয়ে দাঁড়াতে শিখুন, অর্থাৎ নিজে নিজে উপায়ক্ষম হ’ন, এবং তদনুযায়ী বিদ্যা বা শিল্প শিক্ষা করুন। কমলাকান্তের গৃহ শূন্য—সে হাত পুড়িয়ে রেঁধেই খেয়ে থাকে, তবুও আমার পুরুষ ভ্রাতাগণের পক্ষ হ’তে এইমাত্র বলবার আছে যে, এই দারুণ আক্রাগণ্ডার দিনেও, পুরুষ একক কষ্ট করে’ও, কোনদিন এ পর্য্যন্ত তা’র গৃহিণীকে বলে’ নি—“আর পারি না, তুমি তোমার পেটের অন্ন গতর খাটিয়ে সংস্থান করে নাও।” পুরুষের দুঃখে দুঃখিত হ’য়ে যদি নারী গতর খাটাতে চায় ত সেটা ভালই বলতে হ’বে; কিন্তু যদি ঐটে অছিলে মাত্র করে’ নিজের স্বাতন্ত্র্যলাভের পথ পরিষ্কার করে’ নিতে থাকে, তা হ’লে পুরুষ বেচারীর কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে দেওয়া হবে।

 তারপর মা সকল একবার ভেবে নেবেন যে, একবার গতর খাটাতে বেরিয়ে পড়লে, আর স্ত্রী-শিল্প আর পুরুষ-শিল্প বলে’ কোন পার্থক্য থাকবে না। ব্যাঙ্কের দাওয়ান থেকে আরম্ভ করে’ কোদালপাড়া পর্য্যন্ত, সবই করতে হবে। যে দেশ থেকে স্ত্রী-স্বাধীনতার ঢেউ এ দেশে উপস্থিত এসে লেগেছে, সে দেশে factory girl থেকে আরম্ভ করে’ ছুতার, রাজমিস্ত্রি, chauffeur, গাড়োয়ান, মেয়েরা সব কাজই কচ্চে, আবার member of Parliamentও হয়েচে। স্ত্রী পুরুষ ভেদাভেদে কার্য্যের ভেদাভেদ হয় নি, এবং স্ত্রী “স্বাধীন” বলে’ পুরুষের অধীনতা পাশ থেকে একেবারে মুক্ত হ’তেও পারে নি।

 কেন পারে নি তা’র কারণ বলচি। স্বাধীনতা ও সাম্য ছাড়া আর একটা জিনিষ আছে, সেটার নাম—মৈত্রী। এই মৈত্রীর ক্ষুধা, কি পুরুষ কি স্ত্রী, উভয়েরই হৃদয়ে চিরদিন আছে ও থাকবে; স্ত্রীপুরুষের মধ্যে স্বাধীনতা ও সাম্যের দাবী অপ্রাকৃত, অলীক—কিন্তু মৈত্রীর আহ্বান তাদের প্রকৃতির নিভৃত কন্দর থেকে চিরদিন প্রতিমুহূর্ত্তে ধ্বনিত হচ্চে, সে আহ্বানকে কানে তুলা দিলেও, শুন্‌তে হ’বে, কেননা সেটা বাইরের আহ্বান নয়—সেটা ভিতরের ডাক।