কমলাকান্তের পত্র (১৯২৩)/সৈরিন্ধ্রী

২১

সৈরিন্ধ্রী

আমি একদিন প্রসন্নকে বল্লুম—স্বাধীন হ’বে, প্রসন্ন? প্রসন্ন হাঁ করে’ রইল। প্রসন্ন মনে কল্লে হয়ত আমি নেশার ঝোঁকে কথা কচ্চি—তা নয়; আমি আবার বল্লুম—প্রসন্ন, স্বাধীন হবে?

 প্রসন্ন। আমি আবার কার অধীন? আমি কার’ খেয়ে রেখেচি যে, পরের এন্তাজারি করতে হবে?

 আমি। তবুও স্বাধীন হ’লে—যা খুসি করবে, যেখানে খুসী যাবে।

 প্রসন্ন। আমি কোথা যাই না? আমায় আটকে রাখে কে? আমাকে বেঁধে রেখেছে কে? আমি হাটে যাই, মাঠে যাই, তীর্থে যাই, মেলায় মচ্ছবে কোথা যাই না—

 আমি। তা বটে, কিন্তু তবু তুমি স্বাধীন হ’লে আর এক রকম হ’য়ে যাবে— স্বাধীন হ’য়ে যাবে।

 প্রসন্ন। সে কি রকম?

 আমি। বুঝতে পাচ্চ না—স্বাধীন না হ’লে স্বাধীনতার মর্ম্ম বুঝতে পারবে না।

 কিন্তু প্রকৃত কথা বলতে কি, প্রসন্নর কথায় আমারই মনে ধাঁধা লাগতে লাগল, স্বাধীন হ’লে এর বেশী প্রসন্ন আরও কি হ’তে পারত? লড়াইএ যেত—না বক্তৃতা করত?

 প্রসন্ন। হাতে পায়ে বেড়ির মধ্যে ত তুমি। বুড়ো ব্রাহ্মণ কোন যোগ্যতা নেই—নিজের ভালমন্দ জ্ঞান নেই—যেন কচি ছেলে—যেন পাগল—তুমিই ত আমার বুড়া বয়সের সব চেয়ে বড় বাঁধন—তা ছাড়া আমার মঙ্গলা আর-একটা বাঁধন, বাঁধনের মধ্যে ত এই দুই।

 আমি। গো-ব্রাহ্মণ-হিতায় চ—প্রসন্ন ঠিক শাস্ত্রসম্মত হিন্দুজীবনই ত যাপন কচ্ছ। প্রসন্ন, তোমার আর পুনর্জন্ম হবে না, তুমি তরে’ গেলে—তুমি স্বাধীন হও আর না-হও, তা’তে কিছু এসে যাবে না। কিন্তু বয়সকালে তুমি ত ছাড়া গরুটির মত ছিলে না—তখন ত গোঁজেবাঁধা-গরুর মত সাধু ঘোষের গোয়ালে বাঁধা থাকতে।

 প্রসন্ন। যখন যেমন তখন তেমন করতে হবে ত! না হ’লে, সংসার চলবে কেন?

 আমি বড় বিস্মিত হলুম; প্রসন্নর দিক দিয়ে স্বাধীনতার আবদার একবারও এল না; আমি “যার বিয়ে তার মনে নেই, পাড়া পড়শীর ঘুম নেই” হিসাবে জাগিয়ে তুল্‌তে গিয়েও কৃতকার্য্য হলুম না। হায় রে বাঙ্গালীর নারী!

 প্রসন্ন। রাখ তোমার স্বাধীনতার বাজে কথা; দুটো মহাভারতের কথা বল। আমার এ বেলা কোন কাজ নেই।

 মহাভারতের কথা অমৃত সমান, কোন কাজ না থাকলে সে আমার মুখে শুনতে আসত; পুণ্যবতী বলেই শুন্‌ত, কি শুনে পুণ্যবতী হ’ত, তা ঠিক বলতে পারলুম না। যা হ’ক, স্বাধীনতার কথা ভাবতে ভাবতে সৈরিন্ধ্রীর ইতিহাস মনে পড়ে’ গেছল—সেইখান থেকে গল্পটা আরম্ভ করে দিলুম।

 পঞ্চস্বামী বিরাট রাজার সভায় আত্মগোপন করিয়া অজ্ঞাতবাস করিতেছেন। রূপসম্পন্না অনাথা একবস্ত্রা পাঞ্চালতনয়া দ্রৌপদী আশ্রয় ভিক্ষার্থ সুদেষ্ণার নিকট উপস্থিত হইলে, বিরাট-বধূ তাহার অলৌকিক সৌন্দর্য্য দেখিয়া চকিত হইয়া উঠিয়াছেন, পাছে এই লাবণ্যবতী বিরাটরাজার দৃষ্টিপথে পতিতা হন—তাহা হইলে সর্ব্বনাশ হইতে পারে। জিজ্ঞাসা করিলেন,—“তুমি কি কর্ম্ম করিতে অভিলাষ কর?” দ্রৌপদী বলিলেন―“আমি সৈরিন্ধ্রী পরিচারিকা মাত্র, কেশপাশ বিন্যাস, গন্ধ বিলেপনাদি পেষণ ও মল্লিকা উপল চম্পকাদি পুষ্পপুঞ্জের বিচিত্র পরম শোভান্বিত মাল্যগ্রন্থনে আমার নৈপুণ্য আছে। পূর্ব্বে আমি কৃষ্ণের প্রেয়সী সত্যভামার আরাধনা করিতাম, পরে দ্রৌপদীর পরিচর্য্যা করিয়াছিলাম। আমি উত্তম অশন বসন লাভ করিয়া সর্ব্বত্র বিচরণ করি, এবং যে স্থানে যতদিন তাহা লাভ করি, সেস্থানে ততদিন আমার মন রত থাকে; সেইজন্য আমার নাম মানিনী; আমি আপনার নিকেতনে অবস্থানার্থ সমাগতা হইলাম।”

 সুদেষ্ণা কহিলেন—“হে শুচিস্মিতে, শুভ্রূ, লোকে যেমন আত্মবিনাশের জন্য বৃক্ষে আরোহণ করে, অথবা কর্কটী যেমন আপন মরণ-কারণ গর্ভধারণ করে, তোমাকে রাজগৃহে আশ্রয় দিলে আমার পক্ষেও সেইরূপ ঘটিতে পারে।” দ্রৌপদী কহিলেন—“মহাসত্ত্ব পঞ্চ গন্ধর্ব্ব যুবা প্রচ্ছন্ন ভাবে আমাকে সতত রক্ষা করিয়া থাকেন, অতএব কোন ব্যক্তিই আমার প্রতি লুব্ধ হইতে পারিবে না।” সুদেষ্ণা এই বাক্যে আশ্বস্ত হইয়া বলিলেন—“এরূপ হইলে আমি তোমাকে ইচ্ছানুরূপ বাস করাইব—তোমাকে কোন ক্রমেই উচ্ছিষ্ট স্পর্শ বা কাহারও পাদ প্রক্ষালন করিতে হইবে না।”


 মহাভারতের কথা অমৃত সমান—কিন্তু নারী সম্বন্ধে এ কথা আমার অমৃত সমান লাগল না; প্রসন্ন শুনছিল, তা’রও লাগল না। নারী কি এত সন্দিগ্ধ—নারীর প্রতি এত অবিশ্বাসিনী যে, রূপবতী ললনার গৃহমধ্যে অবস্থিতি মাত্রে স্বামীর মন বিচলিত হ’য়ে সর্ব্বনাশের সূচনা করতে পারে এমন হীন কল্পনা তা’র মনে উদিত হওয়া সম্ভব? কিন্তু মানবচরিত্র জ্ঞানের বিশাল বারিধিতুল্য—ব্যাসের অগাধ পাণ্ডিত্যে সন্দিহান হ’তেও পারলুম না। প্রসন্ন বল্লে—এটা মেয়ে-মানুষ মেয়ে-মানুষকে বিশ্বাস করে না, তা নয়; মেয়ে-মানুষ পুরুষকে বিশ্বাস করে না, এইমাত্র প্রমাণ হচ্চে। আমার সে কথায় মন উঠল না, কেননা, এ ত আর কলিযুগের কথা নয়; আর প্রসন্নর কথাই যদি সত্যি হয়, ত যুগে যুগে স্ত্রী স্ত্রীই আছে—আর পুরুষ পুরুষই থেকে গেছে; কেননা হাজারই নারী জেগে থাকুন, অজ্ঞাতকুলশীলা রূপবতী ললনা গৃহমধ্যে প্রবেশ কল্লে, স্বামীর প্রতি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিপাত ও তৎসঙ্গে অভ্যাগতার প্রতি সন্দেহ, তাঁর হৃদয় আচ্ছন্ন করে’ দেবে! তবে সুদেষ্ণার মত অন্তরের আশঙ্কা স্পষ্ট করে’ ব্যক্ত করবার মত বলের হয় ত তাঁর অভাব হ’তে পারে।

 আমি আরও একটু ভেবে দেখলুম—এ প্রকার গূঢ় সন্দেহের দ্বারা নারী যত সহজে নারীর অমর্য্যাদা করে, পুরুষ তত শীঘ্র পারে না; তথা-কথিত শিক্ষা ইত্যাদির দ্বারা বিশেষ তারতম্য হয় না।


 তারপর বিরাটরাজের শ্যালক মহাবল কীচক দেবতার ন্যায় বিচরণ-কারিণী দ্রৌপদীকে হঠাৎ নিরীক্ষণ করিয়া কুসুম-শরে প্রপীড়িত হইয়া, ভগিনী সুদেষ্ণাকে জিজ্ঞাসা করিল—“শুভে! সুজ়াত-মদিরা-তুল্য-মোহকারিণী এই শোভন কামিনী কে?” সুদেষ্ণা ভ্রাতাকে তাহার পরিচয় দিলেন, এবং উভয়ের মিলন সাধন জন্য উপায় উদ্ভাবন করিয়া উপদেশ দিলেন। কৌশলে সৈরিন্ধ্রীকে কীচকের নিকেতনে প্রেরণাভিলাষে বলিলেন—“সৈরিন্ধ্রী, আমি পিপাসায় সাতিশয় ব্যথিতা হইয়াছি, অতএব তুমি শীঘ্র কীচকের গৃহে গমন পূর্ব্বক কিঞ্চিৎ সুরা আনয়ন কর।” সৈরিন্ধ্রী এই আদেশ প্রত্যাহার করিবার জন্য বিরাট-মহিষীকে অনেক অনুনয় বিনয় করিলেন; কিন্তু কোন ফল হইল না; তিনি ক্রন্দন করিতে করিতে শঙ্কাপূর্ণ চিত্তে দৈবের শরণাপন্ন হইয়া কীচকের গৃহে প্রবেশ করিলেন। ‘পার-গমনেচ্ছু ব্যক্তি নৌকালাভ করিলে যেমন আহ্লাদিত হয়’ কীচক সেইরূপ হৃষ্টচিত্তে তাঁহার অভ্যর্থনা করিল।


 এ কি চিত্র? ভ্রাতা, ভগিনী, আশ্রিতা কুলললনা, এ তিনের মধ্যে এ কি বীভৎস ব্যাপার? এ কি ‘যা শত্রু পরে পরে’? স্বীয় প্রেমাস্পদের হৃদয়ে একাধিপত্য রক্ষা করবার মানসে, ভগিনী জেনে-শুনে আশ্রিতাকে পশুপ্রকৃতি ভ্রাতার কবলে প্রেরণ করেন? এই কি অমৃত সমান কথার নমুনা, অথবা কথা সত্য এবং সত্যই একমাত্র অমৃত, সুমিষ্ট না হ’লেও।


 কীচকের হস্তে লাঞ্ছিতা দ্রৌপদী রাজার শরণার্থিনী হইয়া রাজসভায় উপস্থিত; যুধিষ্ঠিরের সমক্ষে কীচক তাঁহার কেশাকর্ষণ করিয়া তাঁহাকে পদাঘাত করিল। দ্রৌপদী আত্মগোপনকারী নিরুদ্বিগ্ন স্বামীগণকে উদ্দেশ করিয়া বলিলেন—“পতিব্রতা প্রেয়সীকে সূতপুত্র কর্ত্তৃক বধ্যমানা দেখিয়াও যাঁহারা ক্লীবের ন্যায় সহ্য করিতেছেন তাঁহাদের বীর্য্য ও তেজ কোথায় রহিল?” বিরাট-রাজকে উদ্দেশ করিয়া বলিলেন—“কীচককে দণ্ডিত না করায় আপনার রাজ-ধর্ম্ম দস্যু-ধর্ম্মের তুল্য হইতেছে।”

 বিরাট কহিলেন, “তোমরা উভয়ে পরোক্ষে কিরূপে বিবাদ করিয়াছ তাহা আমি জানি না, তদ্বিষয়ের যাথার্থ্য অবগত না হইলে আমি কি প্রকারে বিচার-কৌশল প্রয়োগ করিতে পারি।” বিচার কৌশলের বিশেষত্বই এই। ফলে কোন প্রতীকার হইল না; যুধিষ্ঠির ক্রোধে প্রজ্জ্বলিত হইলেও পত্নীকে বলিলেন—“যাঁহারা বীরপত্নী হ’ন পতির অনুরোধে তাঁহারা দুঃসহ ক্লেশ সহ্য করেন। সামান্য নটীর ন্যায় নির্লজ্জা হইয়া রাজসভায় ক্রন্দন করা উচিত নহে; সভাসদগণের ক্রীড়ায় ব্যাঘাত হইতেছে, তুমি এখন যাও, গন্ধর্ব্বেরা সময় পাইলে বৈরনির্য্যাতন করিবেন।” এই প্রকার ইঙ্গিত করিয়া যুধিষ্ঠির নির্য্যাতিতা পত্নীকে স্থানান্তরে যাইতে বলিলেন। যাইবার সময় সৈরিন্ধ্রী কহিলেন,—“আমি যাঁহাদিগের সহধর্ম্মিণী বোধ হয় তাঁহারা অতিরিক্ত দয়াশীল!” রোষাবেগ বশত আরক্ত-নয়না আলুলায়িতকেশা কৃষ্ণা যুধিষ্ঠিরকে এই বলিয়া ভর্ৎসনা করিয়া রাজসভা ত্যাগ করিলেন।

 “ভীমসেন ব্যতীত আমার মনঃপ্রীতি সম্পাদন করিতে আর কেহই সমর্থ হইবে না”—এই চিন্তা করিতে করিতে সৈরিন্ধ্রী, মৃগরাজবধূ যেমন দুর্গম বনে প্রসুপ্ত সিংহকে জাগরিত করে, তদ্রূপ ভীমসেনকে প্রবুদ্ধ করিলেন; বলিলেন,—“উঠুন, মৃতের ন্যায় কি প্রকারে নিদ্রিত রহিয়াছেন—আপনার ভার্য্যা অপমানিতা, পাপিষ্ঠ জীবিত, আপনি কেমন করিয়া সুখে নিদ্রা যাইতেছেন?”

 দ্রৌপদী ভীমসেনের নিকট আপনার হৃদয়ের দ্বার উদ্ঘাটিত করিয়া, সকল দুঃখ, সকল অপমানের কথা বলিয়া, পাপিষ্ঠের প্রায়শ্চিত্তের বিধান করিতে অনুরোধ করিলেন। ভীমসেন ভার্য্যাকে শান্ত করিলেন এবং বৈরনির্য্যাতনের প্রতিশ্রুতি দান করিলেন। পরদিন রাত্রিতে কীচককে গোপনে হত্যা করিলেন—কেননা তখনও পাণ্ডবগণের অজ্ঞাতবাসের পরিসমাপ্তি হয় নাই। কীচক নিপাতনে দ্রৌপদী সন্তাপরহিতা ও পরম আনন্দিতা হইলেন।


 মহাভারতের সৈরিন্ধ্রীর ইতিহাস আলোচনা করতে করতে, আমার বর্ত্তমান কালের সৈরিন্ধ্রী বা সৈরিন্ধ্রীপদপ্রার্থিনী নারীগণের কথা স্বতই মনে হ’ল। এই বিরাট রাজ্যে আত্মগুপ্ত বা প্রকৃতই ক্লীব-ধর্ম্মচারী পতিগণের নিদ্রালু অবস্থায়, নারীর সৈরিন্ধ্রীবৃত্তি সাতিশয় বিপদসঙ্কুল তা’র সন্দেহ নেই। দেশে ও সমাজে কীচক ও উপকীচকগণের কখনও অসদ্ভাব হবে না—যা দ্বাপরে হয় নি তা কলিতে হবে কেন? অতএব একদিকে বিচার কৌশল-প্রয়োগপটু রাজা ও ক্লীবধর্ম্মী পুরুষ, ও অপরদিকে পশুপ্রকৃতি কীচক ও উপকীচকগণ—এতদুভয়ের মধ্যে স্বৈরবিহারিণী নারীর বিপদ অনেক, একথা বিস্মৃত হ’লে চলবে না। দ্রৌপদীর মত তেজস্বিনী বিচক্ষণা রমণীরও যখন আত্মসম্মান রক্ষার জন্য ভীমসেন ভিন্ন গতি ছিল না, তখন ভীমসেন সম্বন্ধে নিশ্চিন্ত না হ’য়ে, আধুনিক সৈরিন্ধ্রীগণ এই বিরাট রাজ্যে স্বৈরবিহারের স্বাধীনতার অভিলাসিনী হবেন না—কিন্তু আবার এ কথাও সত্য যে, এই স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা যদি বিদেশীয় অনুকরণের বিকৃত পরিণাম বা বিলাসমাত্র না হয়—যদি নারী অন্তরের সহিত স্বৈরিণী হবার অভিলাষী হ’য়ে থাকেন, এবং দেশের বর্ত্তমান অবস্থায় তা’র যথার্থ প্রয়োজন হ’য়ে থাকে, তা হ’লে সূপকার নিদ্রিত ভীমসেনেরও নিদ্রাভঙ্গ হবে; নির্য্যাতিতা পত্নীর মান, সেই সঙ্গে নিজের মান রাখবার জন্য তিনি স্বতঃ প্রবুদ্ধ হ’য়ে দণ্ডায়মান হবেন। নারী স্বৈরিণী হ’লে, তাঁর দায়িত্ব আরও বৃদ্ধি পেলও, তিনি কখনই নিশ্চেষ্ট থাকতে পারবেন না।

 প্রসন্ন বলিল—তা’র নিজের মান নিজের হাতে, তার ভীমার্জ্জুনের দরকার নেই, সম্মার্জনীই যথেষ্ট।