কমলাকান্তের পত্র (১৯২৩)/কামিনী কাঞ্চন
২২
কামিনী কাঞ্চন
বুদ্ধদেব থেকে আরম্ভ করে’ মহম্মদ, তারপর পরমহংসদেব পর্য্যন্ত কামিনীর প্রতি একান্ত বিমুখ। ভাষাটা যদি ভাবের আবরণ না হ’য়ে ভাবের অভিব্যক্তিই হয়, তা হ’লে কামিনী কথাটাতেই নারীর প্রতি চিরদিনের অশ্রদ্ধাই crystallised হ’য়ে রয়েছে। wo-man কথাতেই নাকি man এর woeই সূচনা করে। মাঝে মাঝে কবি, (যাঁকে কবিগুরু বাতুল বলেচেন) নারীকে ministering angel বলে’ সুখ্যাতি করেচেন; কিন্তু সে কথায় নারীর কামিনী আখ্য মুছে যায় নি, সংসারেও তা’র স্থান খুব প্রশস্ত হ’য়েও যায় নি। কিন্তু স্বর্গই বল আর সংসারই বল, নারী ছাড়া সম্পূর্ণ হয় না, অতএব যতই হেনস্তা কর নারীকে একটা প্রকৃষ্ট স্থান দিয়ে রাখতেই হবে; সে স্থান কোথায় হবে তা’ নিয়ে জগৎ জুড়ে একটা বিতণ্ডা চলেচে; শীঘ্রই পুরাতন ব্যবস্থার একটা পরিবর্ত্তন হ’য়ে যাবে বলে’ মনে হয়। নারী মানুষ, সে আপনার একটা হেস্তনেস্ত করে’ জগতের দরবারে আপনার স্থান করে’ নেবে। কিন্তু কাঞ্চন সম্বন্ধে অন্য কথা।
অর্থমনর্থং ভাবঘ্ন নিত্যম্। এই ত কাঞ্চনের প্রতি সনাতন গালাগাল। আমার মনে হয় একথা যিনি বলেছিলেন তিনি আমারই মত অর্থহীন নিরর্থক জীবন যাপন করে’, “দ্রাক্ষাফল হয় অতিশল্প অম্লরসে পরিপূর্ণ” বলে’ আপনার মনকে প্রবোধ দিয়েছিলেন। যিনি সে ফলের ঝুড়ি নিয়ে বসে’ তা’র রসাস্বাদ করবার সুযোগ পেয়েছেন—তাঁর মুখে দ্রাক্ষাফলের মিষ্টত্ব, স্নিগ্ধত্ব, পুষ্টিকারিত্ব ইত্যাদি গুণেরই ব্যাখ্যা শুনতে পাওয়া গেছে; আর যাঁরা সে রসে বঞ্চিত, অধিকাংশক্ষেত্রে তাঁদেরই মুখে স্তুতির পরিবর্ত্তে নিন্দা উদ্ঘোষিত হয়েচে।
অর্থ অনর্থের মূল, হয়ত এক সময়ে ছিল; যখন দেশে চোরডাকাতের ভয় বেশী ছিল—যখন সুধু ধন নয়, ধনাপবাদেও ডাকাত পড়ত, যখন টাকা থাকলে দেশের রাজার পর্য্যন্ত চক্ষু-পীড়া উপস্থিত হ’ত। অর্থ সম্বন্ধে সে অনিশ্চিততা এখন নেই; এখন অর্থকে অনর্থ বললে চলবে কেন?
আমি ত দেখিচি অর্থ অপেক্ষা চিরস্থায়ী জিনিষ আর নেই। মানুষ যায়, তা’র বিদ্যা বুদ্ধি, তা’র জ্ঞান, তা’র পাণ্ডিত্য, তা’র সঙ্গে লোপ পায় (খানিকটা সে জ্ঞান বা পাণ্ডিত্যের প্রতিচ্ছবি হয়ত ছাপা কাগজে কিছুদিনের জন্য থেকে যায়), কিন্তু তা’র সঞ্চিত অর্থ অমর হ’য়ে যুগ যুগান্তর থাকতে পারে। তার ধর্ম্মপ্রাণতা, তা’র দেহের সঙ্গে ভষ্ম হ’য়ে যায়; কিছুদিন হয়ত তার সুনামের সুরভি বন্ধুজনের হৃদয়-মন সুরভিত করে’ রাখে; কিন্তু তা’র সঞ্চিত পুঞ্জীকৃত অর্থ যদি থাকে, ত সে পুরুষানুক্রমে তা’র স্মৃতিকে জাগিয়ে রাখতে পারে; তা’র পরিশ্রম, অধ্যবসায়, বুদ্ধি, বিচক্ষণতার সমবায়ে যে অর্থ সঞ্চিত হয়েছিল, সেই অর্থ একটা বিরাট potential energyর power-house হ’য়ে বেঁচে থাকতে পারে; এবং সে potential energy কোনদিন kinetic energyতে পরিণত হ’য়ে, সঞ্চয়কারীর পরিশ্রম অধ্যবসায় বুদ্ধি বিচক্ষণতার পুনর্জন্ম হ’তে পারে।
সকলেই জানে এবং আমিও জানি যে, অর্থ অনর্থ হ’য়ে উঠে যখন সে অবস্তুতে বস্তুত্ব আরোপ করে, অপদার্থকে পদার্থত্ব দেয়; সমাজে ও রাষ্ট্র মধ্যে relative ও absolute value উল্টেপাল্টে দেয়। কিন্তু সেটা অর্থের দোষ নয়, জগতের দোষ, অর্থাৎ মানুষের মনের দোষ। আমি দেখিচি যে, অর্থ না থাকলে বন্ধু মিলে না; কবি বলেছেন “কড়ি বিনা বন্ধু কই”। অর্থ থাকলে অনেক অনর্থ সমাজে সম্ভব হয়—ঘটেও; “কড়িতে বুড়ার বিয়া, কড়ি লাগি মরে গিয়া, কড়িতে কুলবতী মজে”—সে সব সত্য। কিন্তু কড়িতে অসম্ভবও সম্ভব হয়—“কড়িতে বাঘের দুগ্ধ মিলে।” আমি আরও দেখিচি যে অর্থের অত্যাচার, অর্থের ব্যভিচার যা কিছু, সঞ্চয়কারীর দ্বারা খুব অল্পই হ’য়ে থাকে। যে বুদ্ধি বিচক্ষণতার দ্বারা অর্থ সঞ্চয় হয়, সেই বুদ্ধিবিচক্ষণতাই তাকে ব্যভিচার হ’তে রক্ষা করে; ব্যভিচার আসে নিম্নতর পর্য্যায়ে, যখন মানুষ “বাবা কি কল করেচে, সই করলেই টাকা” বলে’ চেক বা দাখিলা সই করে’, আর আলাদিনের আশ্চর্য্য প্রদীপের মত ভুতে টাকা এনে দেয়। সঞ্চয়ীর যে গুণ তা’ ব্যভিচারকে দূরে রেখে দেয়। যে সঞ্চয় করে না, সুধু সঞ্চিত বিত্ত ব্যয় করে, তা’র সে বাঁধ থাকে না, সে স্বতই উচ্ছৃঙ্খল হ’য়ে যাবে তা’র আর আশ্চর্য্য কি? পাণ্ডিত্যের বিদ্যাবত্তার দিক দিয়েও ত এই দোষ দেখা যায়। পণ্ডিতের পুত্র মূর্খ, কিন্তু বাবার দোহাই দিয়ে তরে’ যাবার চেষ্টা তা’রও হয়, এ ত শত শত রয়েছে। “আমার বাবার টোল ছিল—আমি মূর্খ?” এ আস্ফালন ত অনেক মূর্খের মুখে শুনা যায়; পাণ্ডিত্যের ফল যদি কিছু মাত্রও উত্তরাধিকার সূত্রে পুত্রে অর্শা’ত তা হ’লে, অর্থবানের পুত্রের যে দর্প, সেটা খুব অনন্যসাধারণ হ’ত না।
আমি কাঞ্চনের স্বপক্ষে এত কথা বলচি তা’র প্রধান কারণ আমার বিশ্বাস আমরা গরীব হয়েছি বলে’ ধনীর প্রতি ও ধনের প্রতি নাসিকা কুঞ্চিত করতে আরম্ভ করেচি। তা’তে কিছুই এসে যেত না, যদি আমাদের প্রতি মুহূর্ত্তে, ধনীর সঙ্গে ও ধনের সঙ্গে সংগ্রাম করতে না হ’ত। আমরা যেমন ন্যাংটা, বাটপাড়ের ভয় রাখি না, আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বীও যদি ন্যাংটা হ’ত, তা হ’লে Soul-force দিয়ে ভারতউদ্ধার হ’য়ে যেত। কিন্তু অবস্থা তা নয়; আমাদের Soul-force দিয়ে Sole-force বা Kick-forceএর বেগ ধারণ কর্ত্তে হচ্চে। এখানে সুতরাং আমাদের Sole-forceএরই আপাততঃ অধিক দরকার; একথা Soul-forceএর ঋষি পাকেপ্রকারে স্বীকারই করেছেন—এক কোটী টাকা, আর এক লক্ষ স্বেচ্ছাসেবকের ফরমায়েস করে’। এক কোটী টাকা ত Soul-force নয়ই, আর হাত-পা বিশিষ্ট এক লক্ষ স্বেচ্ছাসেবকও নিছক Soulforceএর dynamo নয়।
যন্ত্রটার এক প্রান্তে Soul-force অপর প্রান্তে Sole-force বা Kick-force—একটাকে পরিচালন জন্য, লক্ষ্য স্থির করে’ প্রয়োগ করবার জন্য, আর-একটার প্রয়োজন—driverএর Soul-force আর boilerএর horse power এই দুইএর সমবায় না হ’লে কোন forceই কাজের হবে না।
অতএব যতটা soul-forceএর গুণ-গরিমার প্রচার করা হচ্চে, যাতে sole-force ততটা বাড়ে, তা’র প্রয়োজনীয়তারও ততখানি প্রচার করা হ’ক—কামিনী কাঞ্চন ত্যাগ কর, অর্থকে অনর্থ ভাব, এ সব কথা তুলে রেখে দিয়ে, এই কথাই বলা হ’ক যে, প্রত্যেক যুবা পুরুষকে দেশসেবার জন্য তথা আপনার সেবার জন্য, অধ্যাত্ম সাধনার সঙ্গে সঙ্গে অর্থ-সাধনা কর্ত্তে হবে। টাকা রোজকার কর্ত্তে হ’বে, কর্ম্মযোগের অঙ্গস্বরূপ অর্থ-যোগ করতে হবে। না হ’লে সব কর্ম্মযোগ কর্ম্মভোগে পরিণত হবে, আর সব ত্যাগই প্রাণত্যাগে শেষ হ’য়ে যাবে। Non-co-operationই করুন আর co-operationই করুন, উভয়বিধ পন্থায় অর্থের বিশেষ প্রয়োজন আছে—আর সে অর্থ সুধু ভিক্ষা বৃত্তি করে’ অর্জ্জন করা যাবে না। এই যে জার্ম্মাণ জাতি non-co-operation করে’ ফ্রান্সের আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষা করচে, তা’র জন্য কত কোটি অর্থব্যয় হচ্চে তা’র ঠিক আছে! গায়ের জোরে অসমর্থ কল্লে, অর্থের জোরে এখনও জার্ম্মাণি টিকে আছে—যে-মুহূর্ত্তে সে জোর শেষ হবে, সেই মুহূর্ত্তেই ফ্রান্সের পায়ে লুটিয়ে পড়তে হবে। Soul-force, patriotism বা দেশাত্ম বোধ, বা discipline যাই বলুন, এ সব যে নেই তা নয়; তবে এ সমস্তই অর্থের খোঁটার জোরে দাঁড়িয়ে আছে; এই অর্থের খোঁটা ধরে’ এখনও জার্ম্মাণ মেড়া লড়ছে, এ খোঁটা ভাঙ্গলে তা’র এ লড়াই শেষ হ’য়ে যাবে। তাই বলচি—অর্থমনর্থম্ এ ভ্রান্ত উপদেশ দেওয়া বন্ধ করে দেওয়া হ’ক; ভিক্ষুক—spiritual হ’ক বা material হ’ক, আমাদের দেশে আর এক মুহূর্ত্ত থাকা নয়; অর্থ উপার্জ্জন কর, ব্যক্তিগত সঞ্চয়ের পরিমাণ বৃদ্ধি কর, জাতীয় অর্থভাণ্ডার পূর্ণ কর। অন্ততঃ ধনের খাতিরেও সকলে তোমাদের সম্মান করবে—ভয় করবে।