কমলাকান্তের পত্র (১৯২৩)/বাসাংসি জীর্ণানি

২৩

বাসাংসি জীর্ণানি

পাগলা মাখম বলেছিল—“কাপড়ের ভিতর তুইও নেংট, আমিও নেংট, সবাই নেংট”; তা’তে মেচোহাটার মেচুনি বেটি তা’র গায়ে আঁস-জল ছিটিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু কথাটা সত্যি; নিছক মানুষটা উলঙ্গই বটে, তা’র কোমরের কাপড়খানা বা পাজামাটা মানুষ নয়, মানুষটাকে ঢেকে রাখবারই যন্ত্রবিশেষ।

শাস্ত্র বলেচেন—মৃত্যু মানে কাপড় ছাড়া, পুরাতন ছেড়ে নূতন কাপড় পরিধান করা; এ কথার ভিতর একটু রহস্য র’য়ে গেছে। যেটা মানুষ, যেটা সত্যিকারের তুমি বা আমি, যেটা উলঙ্গ নিরুপাধিক আত্মা, সেটা ঠিক উলঙ্গই থেকে যায়; কণ্ঠী নামাবলি, আচকান টুপী, হ্যাট কোট, পাগড়ী পায়জামা পরা মনুষ্যদেহের ভিতর দিয়ে সেটা উলঙ্গই থেকে চলে’ যায়, সেটার বিকৃতিও হয় না, পরিবর্ত্তনও হয় না।

 কাপড়ের ভিতর তুমি আমি উলঙ্গ থাকলেও, পরিচ্ছদের সঙ্গে একটা ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ হ’য়ে যায়; তোমার আমার প্রকৃতির, সংস্কারের, mentalityর ছাপ পরিধেয়ের উপর ফুটে ওঠে। আমি শুনেচি যীশুখৃষ্টকে ক্রস্ থেকে নামিয়ে যে পরিচ্ছদে ঢাকা দিয়েছিল, সেটা এখনও Vaticanএ যত্ন করে’ একটা আধারের মধ্যে রেখে দেওয়া হয়েচে; বৎসরে একবার সে আধারটা খোলা হয়। কয়েক বৎসর আগে একবার একজন ফটোগ্রাফার সেই পরিচ্ছদটার ফটো নেন; প্লেটখানা develope করে দেখা গেল—সেই পরিচ্ছদের মধ্যে একটা মানুষের মূর্ত্তির স্পষ্ট ছাপ রয়েছে। হ’তে পারে এটা একটা photographic jugglery, কিন্তু আমার বিশ্বাস মানুষটার দেহের ছাপটা এতদিন তার পরিচ্ছদে লেগে থাক আর নাই থাক, কিন্তু মানুষটার মনের ছাপ তা’র পোষাকে ছিলই ছিল; আর, কতখানি মনের রাজ্য আর কতখানি দেহের রাজ্য তা’ত এখনও সঠিক বলা যাচ্চে না। যাই হ’ক, মানুষ যখন তা’র পোষাকের ভঙ্গীটা বদলে ফেলে, তখন বুঝতে হবে যে তা’র মনও বদলে গেছে, পুরাতন মানুষটা মরে গেছে; এবং সকল মরার পরই যখন বাঁচা আরম্ভ, তখনই সেই মরা-বাঁচার সন্ধিস্থলেই অতর্কিতে সে, সাপের খোলসছাড়ার মত, বাসাংসি জীর্ণানি ত্যাগ করে’ “নবানি” গ্রহণ করতে আরম্ভ করেচে; আর পুরাতন ও নূতন উভয়বিধ পরিচ্ছদেই তা’রই মনের ছাপ থেকে গেছে। অতএব কথাটা উল্টেপাল্টে দুই রকম করে’ই বলা চলে—মরা মানে কাপড় ছাড়া, আর কাপড় ছাড়া মানেই মরা, তথা নূতন জীবনের আরম্ভ ও নূতন পরিচ্ছদ পরিগ্রহ।

 ব্যক্তিগত ভাবে একটা মানুষের পক্ষে এ কথাটা যেমন সত্য, মনুষ্য গোষ্ঠী বা সমাজ অথবা জাতির পক্ষেও তেমনি সত্য। আমরা যুগে যুগে কতবার কত রকমই পোষাক বদলালুম তা’র কি ইয়ত্তা আছে; আবার এক যুগেই কত রকম ভোল ফেরালুম তা’রই বা নির্ণয় কে করে! আমার দেখতাই ত হ্যাট কোট থেকে গান্ধীটুপী পর্য্যন্ত চলে’ গেল। কিন্তু সেটা স্বতন্ত্র রকমের জিনিষ, সেটাকে fashion মাত্র বলা যায়—সেটা যাত্রার দলের সং-সাজা বলতে পারা যায়; সেটা মাত্র খেয়াল; আসরের বাইরে এসে “যে কেলো, সেই কেলো”—তা’র কথা বলচি না। যখন সমগ্র জাতটা একটা নূতন পোষাক পরে, একটা নূতন পদ্ধতি গ্রহণ করে—তখনই মরা-বাঁচার কথা আসতে পারে।

 আমাদের গ্রামের জমিদার বাবুর বড় ঘরে—যা’কে তোমরা drawing-room বল—তাঁর চার পুরুষের ছবি টাঙ্গান আছে। তাঁর প্রপিতামহ-ঠাকুর মুসলমানী কায়দায় সজ্জিত—মাথায় নাপিতের টুপির মত টুপি, পা পর্য্যন্ত লম্বা কাবা, কোমরে চাপরাসীদের মত দড়ার কোমরবন্ধ, চুড়িদার পায়জামা, পায়ে নাগরা জুতা, হাতে শটকার নল, পকেট থেকে রঙ্গীন রেশমী রুমাল ঝুলছে। পিতামহ শামলা মাথায়, চোগা চাপকান, পেণ্টুলান, পৃষ্ঠে শালের ত্রিকোণ রুমাল, ইংরেজী রৌপ্য-বগলস দেওয়া জুতা পরিহিত। পিতা riding-suit, হাতে চাবুক, পায়ে top-boot, পার্শ্বে সুসজ্জিত ঘোড়া দণ্ডায়মান। জমিদার বাবু স্বয়ং, চুনট্‌করা আদ্ধির পাঞ্জাবী, ফরাসডাঙ্গার মিহি translucent ধুতি, পারে লপেটা। এই যে চার পুরুষের চার রকমের পোষাক, এ চার রকমের মৃত্যুরই লক্ষণ। কেউ কেউ বলবেন ওটা আমাদের জাতের স্বধর্ম্ম—এখনি যদি “চিনে মালাই ফট” এসে আমাদের দেশটা দখল করে’ বসে, আমরা অমনি চুড়িদার ছেড়ে কেলিকোর চায়না কোট ধরব, কাটের জুতা পরব, টিকী রাখব, আর নপ্পি, moving cheeseএর চেয়েও অতি উপাদেয় বলে, খেতে আরম্ভ করব। কিন্তু তা’তে আমার প্রস্তাবের সমর্থন করে’ আর-একটা ঘটনার উল্লেখ করাই হবে, অর্থাৎ আমরা আর-একবার মরব, এইটেই প্রমাণ হবে মাত্র।

 কাটা কাপড়ের পরিচ্ছদ ছাড়া আর একটা অদৃশ্য পরিচ্ছদ আছে, যেটা মানুষের মনটাকে আরও গভীরতর ভাবে ঢেকে রাখে—যা’র প্রভাব তা’র পোষাকে ত ব্যক্ত হয়ই—তা’র চোখে মুখে, কথায় বার্ত্তায়, হাসিতে কাশিতে, কাজে অকাজে পর্য্যন্ত ফুটে ওঠে—সে পরিচ্ছদ বা প্রচ্ছদের নাম গতানুগতিকতা, tradition, custom ইত্যাদি।

 সব গতানুগতিকতার প্রারম্ভে একটা বিশিষ্ট হেতুবাদ ছিল, একটা raison d’etre ছিল, এটা কল্পনা করা অন্যায় হবে না। হয়ত সে হেতুবাদ পণ্ডিত গোষ্ঠীর মনের ভিতর লুক্কায়িত থাকলেও খুব স্পষ্টই ছিল। কিন্তু লুকোচুরীর মধ্যে, কালক্রমে সে হেতুবাদ ঝাপসা হ’য়ে এল, ক্রমে পণ্ডিতদের মন থেকেও সেটা উপে গেল। তখন “বিয়েয় বেরাল বাঁধার” মত সেটা একটা অপরিজ্ঞাত হেঁয়ালীমাত্রে পর্যবসিত হ’ল; “এটা কর কেন” জিজ্ঞাসা কল্লে সকলেই বল্‌তে আরম্ভ কল্লে ‘ওটা করতে হয়”। “যদি না করি তা হ’লে কি হয়?” তা’র উত্তরে কোন গূঢ় অকল্যাণের ভয় প্রদর্শন করা হ’ল। ব্যাপার এইখানে এসে দাঁড়াল—“হয়” আর “ভয়ের” রাজ্য চলতে লাগল। ভুতচতুর্দ্দশীতে চৌদ্দ প্রদীপ কেন দিতে হয়, আর চৌদ্দ শাক কেন খেতে হয়, তা’র উত্তর—“হয়, নইলে ভূতে ধরে”, নয়ত একটা আজগুবি electricity ঘটিত ব্যাখ্যা, নয়ত গালাগাল।

 এই ‘হয়’ আর ‘ভয়ের’ জ্বালায় দেশটা ঝালাপালা হয়েচে; অতএব জানবে আর দেরী নেই, ‘কাপড় ছাড়বার’ সময় হ’য়ে এসেচে, বহুদিনের জীর্ণবস্ত্র পরিত্যাগ করে’ নববস্ত্র পরিধানের সময় এসেছে, খোলস্ ছেড়ে নবজীবন আরম্ভ হ’তে চলেচে, দুর্ব্বল দুর্ব্বাক্যের আঘাতে তা’কে আর আটক করতে পারবে না।

 ভারতের যুগে যুগে এই রকমই হয়েচে। অজ্ঞানতার মহাপ্লাবন থেকে বেদের অর্থাৎ জ্ঞানের উদ্ধার—সে জ্ঞানের দিব্যজ্যোতি যখন আবার যজ্ঞের ধূমে সমাচ্ছন্ন হ’য়ে নিষ্প্রভ হ’য়েচে, তখন বুদ্ধ প্রবুদ্ধ হয়েচেন। আবার চারিদিকে অজ্ঞানতা, নিরর্থক গতানুগতিকতার প্রভাব বিস্তৃত হ’য়ে জাতটা কিংকর্ত্তব্যবিমূঢ় হ’য়ে উঠেচে, অর্থহীন ’হয়’কে নয় করতে প্রস্তুত হ’য়েচে, ভয়কে শিরোধার্য্য করে’ নিতে রাজী হচ্চে না; প্রতি কথার ‘কেন’ জিজ্ঞাসা কর্ত্তে শুরু করেছে,; সদুত্তর না পেলে ‘হয়’ আর ‘ভয়’কে যুগপৎ জলাঞ্জলি দিয়ে নব পরিচ্ছদে—যুক্তির জ্ঞানের নির্ভীকতার স্বাচ্ছন্দ্যের পরিচ্ছদে, বিভূষিত হ’য়ে দাঁড়িয়ে উঠবে।

 একদিকে গুরু দেবতা আর-একদিকে কুম্ভীপাক নরক, এই দুইএর জোরে এতাবৎকাল সমাজনেতৃগণ সমাজটাকে মুঠোর ভেতর করে’ রেখেছিলেন; এখন হাতের চেয়ে আম বড় হ’য়ে উঠেছে, আর কুম্ভীপাকটাকে মোটেই লোকে মানতে চাচ্চে না। এখন যাকে মান্‌তে চাচ্চে, অর্থাৎ যুক্তিকে ও জ্ঞানকে, সেটা গুরুদেবতাগণের মোটের উপর খুবই অভাব হ’য়ে পড়েচে। তাঁদের এখন সম্বলের মধ্যে গালাগাল, যে কেহ তাঁদের বিরোধী—যাহা কিছু তাঁদের বিরোধী—তা’র প্রতি অজস্র গালিবর্ষণই তাঁদের বল। তাঁরা বুঝতে পারচেন না যে, ‘হয়’ আর ‘ভয়ের’ দ্বারা আর রাজত্ব করা চলচে না; দোর্দ্দণ্ড প্রতাপ ইংরাজ রাজের তা চলচে না, তাঁকেও কাউন্সিলের মধ্যে ও কাউন্সিলের বাইরে কৈফিয়ত দিতে হচ্চে, লোকের মত জান্‌তে হচ্চে, বুঝতে হচ্চে, বোঝাতে হচ্চে।

 ঠিক এই পর্য্যন্ত এসে পৌঁছিচি, এমন সময় প্রসন্ন এসে পাশে দাঁড়াল; আমাকে দপ্তর নিয়ে বস্‌তে দেখলে প্রসন্ন বিরক্ত হ’ত, হাজার হ’ক গয়লার মেয়ে, দপ্তরের মাহাত্ম্য সে কি বুঝবে! যাই হ’ক আমি বল্লাম—প্রসন্ন শোন আমি কি লিখলুম—বাসাংসি জীর্ণানি—

 প্রসন্ন। ও আবার কি? ওটা কোন্ দেশের ভাষা?

 আমি। এই দেশেরই ভাষা, দেবভাষা—সংস্কৃত ভাষা—

 প্রসন্ন। ওর মানে কি?

 আমি। মানে জিজ্ঞাসা করচ তুমিও? আচ্ছা বল্‌চি—মানে ছেঁড়া কাপড়—

 প্রসন্ন। ছেঁড়া কাপড় নিয়ে তোমার কি কাজ? ছেঁড়া কাপড় দিয়ে ত আমরা বাসন কিনি। তা যা হ’ক, ছেঁড়া কাপড় বল্লেই ত হ’ত; যা লোকে বুঝবে না এমন কথা না বল্লেই ত হ’ত।

 আমি। তাই কি হ’ত? ছেঁড়া কাপড় বল্লেই ত তোমার বাসনকেনার কথা মনে আসত; আমার এ বাসাংসি জীর্ণানিতে বাসন-কেনার ব্যাপার মোটেই নেই।

 প্রসন্ন। আমার ও-সবে দরকার নেই, তুমি বলবে এক, আর বোঝাতে চাইবে আর-এক, অত ঘোরফের আমি বুঝি না; সোজাসুজি যা বুঝি, সোজা করে’ বল, আমি শুন্‌তে রাজি আছি।

 অমি। তা হ’লে তোমার শাস্ত্র-কথা শুনা হ’তে পারে না, তুমি যেমন আছ তেমনি থাক।