কলিকাতার ইতিহাস/অষ্টম অধ্যায়
অষ্টম অধ্যায়।
ইংরেজ শাসনাধীনে দেওয়ানী ও ফৌজদারী
বিচারবিতরণের ইতিবৃত্ত।
ভলটেয়ায় বলিয়াছেন, “কোন প্রকার শাসনপ্রণালীই এ পর্য্যন্ত সম্পূর্ণ নির্দ্দোষ হইতে পারে নাই, কারণ মানুষ চিরদিনই ষড়রিপুর অধীন; তাহাদের যদি রিপুই না থাকিত, তাহা হইলে তাহাদের কোন প্রকার শাসনপ্রণালীরই প্রয়োজন হইত না। মানুষের সহিত মানুষের বিবাদস্থলে মানুষর বিচারবিতরণব্যাপারে পুর্ব্বোক্ত উক্তির সত্যতা সবিশেষরূপে প্রমাণিত হইয়া থাকে। কথায় বলে, আদিম অবস্থায় “জোর যার মুলুক তার” ছিল। প্রথম সৃষ্ট মনুষ্য যৎকালে নিজ প্রয়োজন সাধনার্থ ভূমি বেষ্টন করিয়া লন এবং স্বয়ং তাহা ভোগ করিতে থাকেন, তৎকালে তিনি সেই ভূমির অধিকারী ও স্বামী হইয়া পড়েন। ইহা হইতেই তাঁহার স্বত্বের উদ্ভব হয়। বর্ত্তমান সভ্য দেশসমূহে পুরোহিত-বিচারালয়গুলির কার্য্যাবলী অতি অদ্ভুত ব্যাপার বলিয়াই প্রতীয়মান হয়। প্রোটেষ্টাণ্টগণ কর্ত্তৃক ক্যাথলিকদিগের প্রতি এবং ক্যাথলিকগণকর্ত্তৃক প্রোটেষ্টাণ্টদিগের প্রতি ব্যবহার পর্য্যালোচনা করিলে দেখিতে পাওয়া যায়, রিপুগণ কিরূপে বিচারবুদ্ধিকে বিকৃত করে। হায়! অত্যাচার-উৎপীড়ন এইখানেই শেষ হয় নাই। পাপীদিগের চিরনরক ভোগের নিমিত্ত ভগবানের ক্রোধ ও অভিশাপের প্রার্থনা করা হইত। মানুষ যতদিন রিপুর অধীন থাকিবে, ততদিন পক্ষপাতশূন্য পূর্ণ ন্যায়বিচারের আশা করা বিড়ম্বনামাত্র। মানবগর্ব্বের ফল সম্বন্ধে রুসোর উক্তির মধ্যে এমন একটি সত্য নিহিত আছে, যাহা অস্বীকার করিবার উপায় নাই। তিনি বলেন, “সমাজের বিশৃঙ্খলাসমূহের মূল কারণ অনুসন্ধান করিলে আমরা দেখিতে পাই যে, মানুষ যে সমস্ত বিপৎপাত হইতে ক্লেশ পায়, সেগুলি ভ্রান্তি হইতে উদ্ভুত হয়,অজ্ঞতা হইতে আরও অধিক উদ্ভুত হয়—আর আমরা যাহা আদৌ জানি না, সেগুলি আমাদের যত ক্ষতি করে, তাহা অপেক্ষা আমরা যাহা জানি বলিয়া মনে করি, সেগুলি তদপেক্ষা অধিক ক্ষতি করে।
১৭শ ও ১৮শ খৃষ্টাব্দে মুসলমানেরা যে ভাবে বিচার বিতরণ করিতেন, তাহার নিন্দা করা কতকগুলি লেখকের রীতি হইয়া উঠিয়াছে। ঐ সময়ে ফ্রান্সে এবং ইউরোপের অন্যান্য অংশে দেওয়ানী ও ফৌজদারী উভয় প্রকার আইনই এরূপ কঠোর ছিল এবং তন্নিবন্ধন নীতিসমূহের মধ্যে কতকগুলি এরূপ অসঙ্গত ছিল যে, তত্তুলনায় মুসলমানদিগের আইনকানুনগুলিকে অনেক শ্রেষ্ঠ বলা যাইতে পারে।
নবাব মহম্মদ রেজা খাঁ বলেন যে, মুসলমান-শাসনকালে দুই প্রকার বিচারালয় ছিল; একটির নাম ছিল আদালত, অর্থাৎ আলিয়া বা নবাবের নিজস্ব বিচারালয়, এবং অপরটির নাম ছিল খলসা কাচারি। এই শেষোক্ত বিচারালয়ে ভূমির রাজস্ব, ঋণ ও অন্যান্য প্রকার মোকদ্দমার শুনানি ও মীমাংসা হইত। এই বিচারালয়ে যে রায় প্রকাশ করা হইত, তাহাতে হাকিমের অর্থাৎ বিচারকের স্বাক্ষর থাকিত। আদালতে অর্থাৎ নবাবের নিজ বিচারালয়ে খুন, ডাকাতি ও অন্যান্য গুরুতর অপরাধের ফৌজদারী মোকদ্দমাগুলির শুনানি ও বিচার হইত। এই বিচারালয়ে কয়েকজন বিচারক থাকিতেন, কিন্তু শেষ হুকুম দিবার ক্ষমতা নবাব স্বহস্তে রাখিতেন। বিচারকদিগের মধ্যে যিনি সর্ব্বপ্রধান বা অধ্যক্ষ থাকিতেন, তিনি নবাবের সহিত সাক্ষাৎ করিয়া মোকদ্দমার সমস্ত অবস্থা বুঝাইয়া দিতেন, এবং মোকদ্দমার রায় সম্বন্ধে সকল বিচারকের মত এক হইলে নবাব তাহাতে স্বাক্ষর করিতেন। আসামীর নিজ ধর্ম্ম ও আইন-অনুসারে তাহার প্রতি দণ্ডবিধান করা হইত।
কলিকাতা হাইকোর্টের ভূতপুর্ব্ব জজ সি, ডি, ফীল্ড সাহেব লিখিয়াছেন, মুসলমান-রাজত্বকালে দুই বিভিন্ন শ্রেণীর বিচারালয় কর্ত্তৃক বিচার বিতরিত হইত, যথা (১) কাজিদিগের অধিষ্ঠিত বিচারালয়। ইহারা মুসলমান আইনের সুবিস্তৃত ব্যবস্থা অনুসারে কার্য্য করিতেন, এবং (২) রাজপুরুষগণের অধিষ্ঠিত বিচারালয়, ইঁহারা কোন নির্দিষ্ট নিয়মের অধীন হইয়া কার্য্য করিতেন না, পরন্তু আপনাদের স্বার্থসাধনের দিকে দৃষ্টি রাখিয়াই কার্য্য করিতেন, বিশেষতঃ বিবদমান পক্ষদ্বয় ভিন্নজাতীয় ও ভিন্ন ধর্মাবলম্বী হইলে ইঁহারা বড়ই সুবিধা পাইয়া বসিতেন; কিন্তু রাজা সময়ে সময়ে আবেদনাদির তদন্ত করিতেন; কিন্তু যুদ্ধব্যাপারে ও রাজকীয় অন্যান্য কার্য্যে অথবা অন্তঃপুরের আমোদপ্রমোদে তাঁহাকে অধিক সময় ব্যাপৃত থাকিতে হইত বলিয়া তিনি বিচারবিতরণ-কার্য্যে নিয়মিতরূপে বা কোনরূপ প্রণালীসঙ্গতভাবে যোগদান করিবার অবসর পাইতেন না। সুবাসমূহে অর্থাৎ বিভিন্ন প্রদেশগুলিতেও ঐ দুই শ্রেণীর বিচারালয় ছিল। কাজি সবিশেষ খ্যাতি ও প্রতিষ্ঠাসম্পন্ন ব্যক্তি হইলে তদনুপাতে বিচারবিতরণকার্য্যেও তাঁহার প্রভাব অধিক হইত; কিন্তু সাধারণতঃ সুবাদারগণ ও তাঁহাদের কর্ম্মচারীরা অপেক্ষাকৃত গুরুতর মোকদ্দমা গুলির বিচারের ভার স্বহস্তে গ্রহণ করিতেন, কাজেই সেস্থলে কাজি দলিলপত্র রেজিষ্টারী করিবার ও বিবাহ সম্পন্ন করিবার কর্ম্মচারীমাত্রে পরিণত হইয়া পড়িতেন। কোম্পানিকে দেওয়ানী সনন্দ প্রদানের অব্যবহিত পরবর্ত্তী কালে মুর্শিদাবাদে যে সকল বিচারসম্পর্কীয় কর্ম্মচারী ছিলেন, নিম্নে তাঁহাদের একটি তালিকা দেওয়া হইল:
১। নাজিম-ইনি প্রাণদণ্ডযোগ্য অপরাধীদিগের বিচার কালে স্বয়ং প্রধান বিচারপতিরূপে অধ্যক্ষতা করিতেন।
২। দেওয়ান—ভূসম্পত্তিসম্পর্কীয় মোকদ্দমার বিচারভার ইঁহার হস্তে ছিল; কিন্তু ইনি খুব কম সময়ই স্বয়ং এই ক্ষমতার পরিচালনা করিতেন।
৩। দারোগা-আদালত-আলআলিকা অর্থাৎ ফৌজদারী আদালতে নাজিমের প্রতিনিধি-ইনি বিবাদ ঝগড়া ও গালাগালির এবং, ভূসম্পত্তি ও উত্তরাধিকার ব্যতীত অন্যান্য প্রকার সম্পত্তিসংক্রান্ত যাবতীয় মোকদ্দমার বিচার করিতেন।
৪। দারোগা-ই-আদালত দেওয়ানী—অর্থাৎ দেওয়ানী আদালতের দেওয়ানের প্রতিনিধি।
৫। ফৌজদার—অর্থাৎ পুলিসের কর্ম্মচারী ও প্রাণদণ্ডযোগ্য নহে এরূপ যাবতীয় মোকদ্দমার বিচারক।
৬। কাজি—ইনি উত্তরাধিকারসংক্রান্ত মোকদ্দমার বিচার করিতেন।
৭। মুক্তাসিব—ইহার হস্তে মাতলামি এবং সুরা ও অন্যান্য নেশার জিনিস বিক্রয় সম্বন্ধীয় মোকদ্দমার বিচার এবং কৃত্রিম বাট খারা ও কাঠাপালি প্রভৃতি পরিমাণ-যন্ত্র গুলির তদন্তের ভার ছিল।
৮। মুফ্তি-ইনি কাজির নিকট আইনের ব্যাখ্যা করিতেন, এবং কাজি তাহাতে একমত হইলে তদনুসারে মীমাংসা করিতেন। তিনি ভিন্নমত হইলে নাজিমের নিকট তাহা নিবেদন করা হইত, এবং নাজিম অন্যান্য বিচারকদিগকে লইয়া একটি সভা করিতেন।
৯। কানুনগো—অর্থাৎ ভূমির রেজিষ্ট্রার। ইহার নিকট ভূমিঘটিত মোকদ্দমার বিচারভার সময়ে সময়ে অর্পণ করা হইত।
১০। কোতয়াল অর্থাৎ নিশাকালের শান্তিরক্ষক কর্ম্মচারী। ইনি ফৌজদারের অধীন।
আইন আক্বরি গ্রন্থে উল্লিখিত হইয়াছে যে, বিচার-বিতরণে ও পুলিসের কার্য্যে পশ্চাদুক্ত কর্ম্মচারিগণ নিযুক্ত ছিলেন, যথা(১) মীর-ই-আদল অর্থাৎ প্রধান বিচারপতি, ইনি বোধ হয় কাজি অপেক্ষা উচ্চপদস্থ ছিলেন, কারণ কাজির রায়ে ইঁহার অনুমোদন প্রয়োজন হইত; (২) শান্তিস্থাপন ও পুলিশ রক্ষার নিমিত্ত ফৌজদারঃ এবং (৩) কোতয়াল অর্থাৎ নগরের হেড, কনেষ্টবল। ফৌজদার ফৌজদারী মোকদ্দমার বিচারক্ষমতা পরিচালনা করিতেন। মুসলমানরাজত্বের শেষাংশে বিচারবিতরণের কার্য্য অনেকটা হীন হইয়া পড়িয়াছিল। ধর্ম্মাধিকরণগুলি নিরীহ নির্দ্দোষ প্রজাবর্গের প্রতি অত্যাচার উৎপীড়নের প্রধান যন্ত্রস্বরূপ হইয়া উঠিয়াছিল। এমন কি, অতি সামান্য সামান্য জমিদারেরাও আপনাদের এক একটি বিচারালয় প্রতিষ্ঠা করিয়া বাসিয়াছিল। সমরপ্রিয় দুঃসাহসিক পুরুষেরাই সমস্ত ক্ষমতা ও প্রভুত্ব আত্মসাৎ করিয়াছিল; তাহারা আপনাদের প্রভুত্ব অক্ষুন্নভাবে বজায় রাখিবার অভিপ্রায়ে ধনবান ও বিত্তশালীদিগের বিভব লুণ্ঠন করিত। এরূপ অবস্থায় আইন আকবরী এবং প্রবলপ্রতাপসম্রাট্ আলমগীর অর্থাৎ ঔরঙ্গজেবের ফেতাওয়াই আলেমগিরি গ্রন্থের বিধিব্যবস্থাসমূহ যে উপেক্ষিত হইবে, তাহাতে আর আশ্চর্য্য কি? সেগুলি তৎকালে নিতান্ত অকার্য্যকর হইয়া পড়িয়াছিল। পূর্ব্বোক্ত প্রকার দুঃসাহসিক পুরুষেরা এবং দস্যুতস্করেরাই ন্যায়বিচারের বিধিব্যবস্থাসমূহ ব্যাখ্যা করিত। তৎকালে প্রত্যেকেই এক একজন প্রধান হইয়া উঠিয়াছিল। ইতোমধ্যে ইউরোপীয়রা রঙ্গস্থলে অবতীর্ণ হইলেন। তাঁহাদের ব্যবসায় বাণিজ্য-সংক্রান্ত দ্বেষাদ্বেষি ও বিবাদবিসংবাদসমূহ তৎকালীন বিশৃঙ্খল অবস্থার পরিমাণ শতগুণে বর্দ্ধিত করিয়া তুলিল।
হিন্দুরা কি ভাবে বিচার কার্য্য নির্ব্বাহ করিতেন, তৎসম্বন্ধে আমরা কোন কথাই বলি নাই। আমাদিগের গ্রন্থের আয়তন আমাদিগকে তদ্বিষয়ে পূর্ণ আলোচনা করিতে দিতেছে না। মনুর ব্যবস্থা এবং অন্যান্য কতিপয় স্মৃতিগ্রন্থ হইতে দেওয়ানী, ফৌজদারী, মিউনিসিপাল ও অপরাপর বিষয়সংক্রান্ত হিন্দু-ধর্ম্মাধিকরণসমুহের পূর্ণতত্ত্ব অবগত হইতে পারা যায়। ঐ সকল পুস্তকের অনেকগুলিই অধুনা ইংরেজি ভাষায় অনূদিত হইয়া প্রকাশিত হইয়াছে। সুতরাং ইংরেজী ভাষাভিজ্ঞ পাঠকগণ ঐ সমস্ত অনুবাদ পাঠ করিলে অনেক জ্ঞান লাভ করিতে পারেন। ইংরেজ-শাসনকালের প্রথম অবস্থায় “জাতিমালা-কাহারী” নামে একটি হিন্দু বিচারালয় ছিল। তৎপ্রসঙ্গে ওয়ারেন হেষ্টিংস সাহেব লিখিয়াছেন,—“সাধারণতঃ জাতিমালা কাছারী নামে অভিহিত জাতিবিষয়ক বিচারালয়টি গভর্ণমেণ্টের ন্যায় প্রাচীন, এবং ইহার কার্য্যকলাপ দেশের অন্যান্য বিচারালয়ের ন্যায় নিয়মিত ও শৃঙ্খলাসম্পন্ন।” ওয়ারেন হেষ্টিংস্ সাহেবের উক্তি হইতে ইহাও জানা যায় যে, অপেক্ষাকৃত নিম্নশ্রেণীর লোকদিগের মধ্যে যে সকল বিবাদ বিসম্বাদ উপস্থিত হইত, এই বিচারালয় তাহারই নিস্পত্তি করিত। ইহার কার্য্যবিবরণী হইতে প্রতীয়মান হয় যে, গভর্ণর জেনারেলের বেনিয়ানগণই (মুচ্ছদ্দিগণই) স্বয়ং গভর্ণরের পরিবর্ত্তে ইহার অধ্যক্ষতা করিতেন।
১৬৯৮ (১৬৯৯) খৃষ্টাব্দে বা তৎসমকালে কলিকাতা নগরী প্রেসিডেন্সি পদবীতে উন্নীত হয়, এবং এই প্রেসিডেন্সির নাম হয় “ফোর্ট উইলিয়াম্ ইন বেঙ্গল্ (Fort Williaim in Bengal)"| একজন প্রেসিডেণ্ট (সর্ব্বাধ্যক্ষ) এবং নিম্নলিখিত কর্ম্মচারিগণসংবলিত একটী কাউন্সিল (মন্ত্রিসমাজ) নিয়োজিত হন। কর্ম্মচারিগণের পদের নাম যথা-(১) একাউণ্টাণ্ট (Acountant), (২) মালগুদামরক্ষক (Warehouse-keeper), {৩) ম্যারীন্ পর্সার (Marine Purser) এবং (৪) রিসিভার অভ রেভিনিউ বা কলিকাতার কলেক্টর (Receiver of Revenue or Collector of Calcutta)। জন বেয়ার্ড সাহেব কাউন্সিলের প্রথম প্রেসিডেণ্ট হইলেন। সর্ব্বপ্রকার কার্য্য-বস্তুতঃ সমস্ত শাসনব্যাপার প্রেসিডেণ্ট ও কাউন্সিলের হস্তে ন্যস্ত ছিল। তৎকালে কোনরূপ বিচারালয় প্রতিষ্ঠিত হয় নাই।
১৬০১ খৃষ্টাব্দে মহারাণী এলিজাবেথ যে সনন্দ প্রদান করেন, তদ্দ্বারা বণিক্ কোম্পানি আপনাদের ক্ষমতা লাভ করেন এবং সে ক্ষমতা স্পষ্টরূপে নির্দ্দিষ্ট হইয়াছে। তাহাতে অন্যান্য নিয়মও দৃষ্ট হয়, যথা—কোম্পানি এরূপ ও এতগুলি আইন কানুন, বিধিব্যবস্থা, ও আদেশ-নির্দেশ প্রস্তুত ও বিধিবদ্ধ করিতে পারিবেন, যাহা তাঁহাদের নিকট বা তথায় ও তৎকালে উপস্থিত তাঁহাদের অধিকাংশের নিকট উক্ত কোম্পানির এবং তাবৎ ফ্যাক্টর (factors), মাষ্টার (Masters), ম্যারিনার (Mariners), অন্যান্য কর্ম্মচারিবর্গের সুশাসন ও সুপরিচালনের নিমিত্ত এবং তাঁহাদের ব্যবসায় ও বাণিজ্যের স্থায়িত্ব ও অধিকতর উন্নতিসাধনের নিমিত্ত প্রয়োজনীয় ও সুবিধাজনক বোধ হইবে।” তাঁহারা আরও ক্ষমতা পাইলেন যে, তাঁহারা এরূপ আইন প্রস্তুত ও প্রয়োগ করিতে পারিবেন এবং প্রয়োজন হইলে তাঁহারা ইচ্ছানুসারে তাহা রহিত বা পরিবর্ত্তিত করিতে পারিবেন, এবং তদ্ভিন্ন লোকে যাহাতে ঐ সমস্ত আইন কানুন যথাযথ ভাবে মানিয়া চলে, এতদুদ্দেশ্যে তাঁহারা আপনাদের বিবেচনামত কারাদণ্ড, অর্থদণ্ড প্রভৃতি শাস্তিপ্রয়োগের ব্যবস্থা করিতে পারিবেন।
১৬১৮ খৃষ্টাব্দ ইংরেজদিগের স্বার্থসাধনের বিশিষ্ট অনুকূল হইয়াছিল। ইংল্যাণ্ডেশ্বর ১ম জেম্সের প্রখ্যাত দূত সার টমাস রো তাঁহার রাজার প্রতিনিধিরূপে ১৬১৫ খৃষ্টাব্দে দিল্লীনগরে মোগল-রাজ-সভায় উপস্থিত হন। তিনি মোগলসম্রাট জাহাঙ্গীরের এরূপ প্রীতিভাজন হইয়া উঠেন যে, তিনি ভারতে বাণিজ্যকারী তাঁহার স্বদেশীয়গণের নিমিত্ত সম্রাটের নিকট হইতে অতি মূল্যবান অধিকারসমূহ লাভ করেন। কাউয়েল সাহেব বলেন, মোগল সম্রট এই অধিকার প্রদান করিয়াছিলেন যে, ইংরেজদিগের পরস্পরের মধ্যে বিবাদের নিষ্পত্তি ইংরেজেরা স্বয়ংই করিতে পারিবেন। ইষ্টইণ্ডিয়া কোম্পানি ১৭শ শতাব্দীর অবসানের পূর্ব্বেই মাদ্রাজে ও কলিকাতায় দুর্গনির্মাণের অনুমতি প্রাপ্ত হন এবং তাহা কার্য্যেও পরিণত করেন। এইরূপে তাঁহারা আপন আপন কুঠির সীমার মধ্যে আপনাদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত করিয়া তাহা রক্ষা করিতে প্রবৃত্ত হন। এই সকল গড়বন্দীর ভিতর ইউরোপীয়দিগের ন্যায় দেশীয়েরাও গৃহনির্ম্মাণপূর্ব্বক বাস করিতে আরম্ভ করেন এবং সেইজন্য নবাব দেশীয়দিগের বিচারার্থ কাজি বা অন্য বিচারপতি প্রেরণ করিতে উদ্যত হইলে কোম্পানির কর্ম্মচারীরা তাঁহাকে এই কার্য্য হইতে নিবৃত্তি করিবার নিমিত্ত উৎকোচ প্রদান করিয়া বশীভূত করিতেন।
১৬০১ খৃষ্টাব্দের সনদ ১৬০৯ ও ১৬৬১ অব্দে পুনর্নবীভূত হয়। পরন্তু ১৬৯৮ অব্দে লর্ড গডলফিনের বিধান অনুসারে তদানীন্তন দুইটি কোম্পানি মিলিত হইয়া যায় এবং তদবধি ইষ্টইণ্ডিয়া কোম্পানি নামে পরিচিত হইতে আরম্ভ করে। সেই সনন্দঅনুসারে কোম্পানি আপনাদের যাবতীয় দুর্গ, কুঠি ও আবাদের শাসনক্ষমতা প্রাপ্ত হন,—কেবল রাজক্ষমতাটুকু ইংল্যাণ্ডেশ্বরের নিজ হস্তে থাকে। পুর্ব্বের ন্যায় বিচারালয়সমুহ প্রতিষ্ঠিত হয়, কিন্তু আইন করিবার ক্ষমতা সম্বন্ধে তৎকালে কোন কথাই বলা হয় নাই।
১৭২০ অব্দে বা তৎসমকালে শাসনসম্পর্কীয় কতকগুলি বিষয়ের ভার কলিকাতার “জমিদার’ নামক কর্ম্মচারীর হস্তে অর্পণ করা হয়। কাউন্সিলের কোন সদস্য যদি ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারী হইতেন, সাধারণতঃ তিনিই এই পদে অধিষ্ঠিত হইতেন। এই বিচারালয়ের নাম “ফৌজদারী কাছারী” ছিল। ১_২০ অব্দে ইহার প্রথম স্থাপন কাল হইতে ১৭৫৬ অব্দ পর্য্যন্ত গোবিন্দরাম মিত্র জমিদারের দেওয়ান অর্থাৎ প্রতিনিধিরূপে কার্য্য করেন। ষ্টার্নডেল সাহেবের মতে গ্রীক্ নামক একজন সাহেব প্রথম জমিদার হন। জমিদারের প্রধান বা সদর কাছারী কলিকাতায় অবস্থিত ছিল; তথায় তিনি জমি প্রজাবিলি করিতেন এবং কোন প্রজা যথাসময়ে খাজনা দিতে না পারিলে তিনি তৎকালপ্রচলিত অন্য কোন বিচারালয়ে বিচারপ্রার্থী না হইয়া স্বয়ংই তাহাকে কারাবদ্ধ করিয়া ও বেত্রাঘাত করিয়া দণ্ডপ্রদান করিতেন। জমিদারের কর্ত্তব্যকর্ম্ম সম্বন্ধে হলওয়েল সাহেব এইরূপ বলেন-তাঁহার দুইটী ক্ষমতা ছিল, সে দুইটী ক্ষমতা পরস্পর হইতে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ও বিভিন্ন। তিনি সুপারিণ্টেণ্ডেণ্ট ও কলেক্টর ছিলেন, এবং তদ্ভিন্ন জমিদারী কাছারীর অধ্যক্ষ অর্থাৎ বিচারপতি ছিলেন। এই পদের বেতন মাসিক ২০০০৲ টাকা নির্দ্দিষ্ট ছিল। কিন্তু হলওয়েল সাহেব বলেন, তাহার উপরি-পাওনারও তুলনায় এই বেতন কিছুই নহে। কথিত আছে যে, “বিভিন্ন কুঠির আয়ের অধিকাংশই তাঁহার পকেটে যাইত। তদ্ভিন্ন তিনি নিজে স্বতন্ত্রভাবে বাণিজ্য করিতেন, এবং তাহা হইতেও প্রভূত লাভ পাইতেন। •••••• তদানীন্তন প্রবলবাত্যাসঙ্কুল রাজনৈতিক ঝটিকায় তথাকথিত প্যাগোডা বৃক্ষ প্রকম্পিত হইলে তাঁহার উদরপুর্ত্তির যথেষ্ট সুযোগ ঘটিত।”
উল্লিখিত আছে যে, যে সকল স্থলে দেশীয়েরা ইংরেজধর্ম্মাধিকরণে বিচারপ্রার্থী না হইত, তত্তাবৎ স্থলে জমিদারই সমস্ত ফৌজদারী মোকদ্দমার বিচার করিতেন। তিনি দেশীয়দিগের মধ্যে সর্ব্বপ্রকার পরিমাণ টাকার মোকদ্দমার নিষ্পত্তি করতেন। কেবল প্রাণদণ্ডজন্য অপরাধের মোকদ্দমাতেই তিনি রায় প্রকাশ করিতে পাইতেন, কিন্তু যে স্থলে চাবুকের প্রহারে[১] মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হইত, কেবল সেই স্থলেই প্রেসিডেণ্ট বা কাউন্সিলের অনুমোদন গ্রহণ করা হইত।
আমরা এক্ষণে জন্ জেফানিয়া হলওয়েল নামক বিখ্যাত জমিদারের বৃত্তান্ত সংক্ষেপে বলিতে প্রবৃত্ত হইতেছি। তিনি জাতিতে আইরিশ ছিলেন। তিনি পূর্ব্ব ভারতগামী একখানি জাহাজের সার্জ্জেণ্টের মেট (সহকারী) হইয়া ১৭৩২ অব্দে কলিকাতায় উপস্থিত হন। ১৭৩৬ অব্দে তিনি মেয়র্স কোর্টের অন্যতম এল্ডারম্যান্ নিযুক্ত হন এবং ১৭৪৮ অব্দে ইউরোপে প্রতিগমন করেন। তিনি জমিদারের কাছারী সংক্রান্ত কুপ্রথাসমুহ ও দোষাবলীর সংস্কারসাধনার্থ একটী মন্তব্য লিপিবদ্ধ করিয়া ডিরেক্টর সভায় বিচারার্থ অর্পণ করেন, এবং ডিরেক্টরেরা তজ্জন্য তাঁহার প্রতি এতদূর সন্তুষ্ট হন যে, তাঁহারা তাঁহাকে কলিকাতার স্থায়ী জমিদার ও কাউন্সিলারের দ্বাদশ সদস্য নিযুক্ত করেন। ১৭৬০ অব্দে ক্লাইভ স্বদেশে প্রতিগমন করিলে তিনি কয়েক মাস গভর্ণররূপে কার্য্য করেন। তিনি এক সময়ে বর্ত্তমান ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গনির্ম্মাণঘটিত একটি ফৌজদারী মোকদ্দমা রুজু করিতে উদ্যত হইলে কোন ব্যক্তি তাঁহাকে ঐ কার্য্য হইতে বিরত করিবার অভিপ্রায়ে এক লক্ষ টাকা উৎকোচস্বরূপ প্রদান করেন। হলওয়েল সাহেব ঐ টাকা স্বয়ং গ্রহণ না করিয়া উহা কোম্পানীকে অর্পণ করিয়াছিলেন। তিনি কতকগুলি মূল্যবান্ পুস্তিকা প্রচার করেন। সেগুলি হলওয়েল ইণ্ডিয়া ট্রাক্টস্ (Holwell India Tracts) নামে পরিচিত। তাহা হইতে কলিকাতাসংক্রান্ত অনেক প্রয়োজনীয় কথাই জানিতে পারা যায়। তিনি ১৭৮০ অব্দে ইংল্যাণ্ডে প্রত্যাবৃত্ত এবং ১৭৯৮ অব্দে মৃত্যুমুখে পতিত হন।
১৭২৬ অব্দে (পাদ্রি লঙ সাহেব বলেন, ১৭২৪ অব্দে) কলিকাতায় “মেয়র্স কোর্ট” সংস্থাপন ব্যাপারের আলোচনায় অনেক প্রাচীন কথার স্মৃতিই জাগিয়া উঠে। ডিরেক্টর-সভার আদেশক্রমেই উহা প্রথম সংস্থাপিত হয়। ডিরেক্টরগণ অপরাপর যুক্তি ব্যতীত এইরূপ যুক্তিও প্রদর্শন করেন যে, “মাদ্রাজ, ফোর্ট উইলিয়াম ও বোম্বাই নগরে দেওয়ানী মোকদ্দমাসমূহের অপেক্ষাকৃত সত্বর ও সুন্দর নিষ্পত্তির নিমিত্ত এবং প্রাণদণ্ডযোগ্য ও অন্যান্য প্রকার অপরাধ ও দুরাচরণের বিচার ও দণ্ডবিধানের নিমিত্ত যথেচিত ও যথোপযুক্ত ক্ষমতার অভাব দৃষ্ট হয়। একজন মেয়র ও নয়জন এল্ডারম্যান্ লইয়া এই বিচারালয় গঠিত হয় এবং স্থির হয় যে, ইঁহাদের মধ্যে সাতজন এল্ডারম্যান্ ও মেয়র প্রকৃত বৃটেনজাত বৃটিশ-প্রজা হওয়া আবশ্যক। অবশিষ্ট দুইজন বৈদেশিক প্রোটেষ্ট্যাণ্ট হইতে পারেন, কিন্তু তাঁহারা গ্রেট বৃটেনের সহিত মিত্রতাসূত্রে আবদ্ধ কোন রাজ্যের বা রাজার প্রজা হওয়া চাই। মেয়র ও এল্ডারম্যানদিগের নিয়োগ ক্ষমতা গভর্ণর বা কাউন্সিলের প্রেসিডেণ্টের হস্তে অর্পিত হয়। রেণি সাহেবের মতে, মেয়র প্রতিবৎসর এল্ডারম্যানগণ কর্ত্তৃক নির্বাচিত হইতেন। এল্ডারাম্যানের পদ আজীবনকাল স্থায়ী হইত, কিন্তু গভর্ণর ও কাউন্সিল কোন যুক্তিসঙ্গত হেতুতে যে কোনও এণ্ডারম্যানকে পদচ্যুত করিতে পারিতেন। এই বিচারালয়ের সর্ব্বপ্রকার দেওয়ানী মোকদ্দমার বিচারক্ষমতা ছিল। তদ্ভিন্ন উইলের প্রোবেট বিচার এবং যাহারা উইল না করিয়া মরিত, তাহাদের বিষয়সম্পত্তি পরিচালনের ক্ষমতা পত্র অর্পণ করিবারও ইহার ক্ষমতা ছিল।
মেয়র ও এল্ডারম্যানগণের পারিশ্রমিক মাসিক ২০।২২৲ টাকা ছিল। রেণি সাহেব বলেন, মেয়র ও এল্ডারম্যানগণ আফিসের নির্দ্দিষ্ট পরিচ্ছদ পরিধান করিতেন। মেয়র একটি মখমলের গদির উপর উপবেশন করিতেন, এবং এল্ডারম্যানগণ গাউনের স্থলে লাল তাফতা ধারণ করিয়া উপস্থিত হইতেন। ফৌজদারী ও দেওয়ানী মোকদ্দমায় কেবলমাত্র ইউরোপীয়দিগের উপরই “মেয়র্স কোর্টের অধিকার ছিল; পরন্তু পক্ষগণের সম্মতিক্রমে দেশীয়দিগের পরস্পরের মধ্যবর্ত্তী মোকদ্দমাও তথায় দায়ের হইতে পাইত। অবশেষে এইরূপ ঘোষিত হয় যে, দেশীয়দিগের মোকদ্দমাগুলি তাহাদের আপনাদের মধ্যেই নিষ্পত্তি হইবে, এবং তাহাদের উপর “মেয়র্স কোর্টের” কোনও ক্ষমতাই থাকিবে না। বুরশিয়ার সাহেব কলিকাতায় “মেয়র্স কোর্ট” নির্ম্মাণ করেন। উহা তৎকালে “কোর্ট হাউস্” নামে পরিচিত এবং ওল্ড কোর্ট হাউস্ ষ্ট্রীট নামক রাস্তায় অবস্থিত ছিল। কোন কোন লেখক উহার কার্য্যবিবরণী প্রসঙ্গে উহার অদ্ভুত বিচারফল ও রায় প্রকাশ করিয়া পাঠকগণকে আমোদিত করিয়া থাকেন। জনৈক লেখক “কলিকাতা রিভিউ পত্রে” পশ্চাল্লিখিত আখ্যায়িকা প্রচার করিয়াছেন;—
কলিকাতা কাউন্সিলের জনৈক ইউরোপীয় সদস্য (যিনি তৎকালে “জমিদার”ও ছিলেন উইলিয়াম উইলসন্ নামক জনৈক পাইল প্রস্তুতকারকের নিকট কিঞ্চিৎ অর্থ (মোট ৭৫৷৷৴৭ পাই) ঋণী ছিলেন, এই শেষোক্ত ব্যক্তি প্রথমোক্ত ব্যক্তির নিমিত্ত সামান্য কোন কার্য্য সম্পন্ন করিয়াছিলেন। পাইল প্রস্তুতকারক উক্ত ভদ্রলোকের নিকট আপনার প্রাপ্য টাকার বিল ও তৎসহ তাহার রসিদ প্রেরণ করিলেন, কিন্তু ভদ্রলোকটি তাহা অতিরিক্ত জ্ঞান করিয়া টাকা দিলেন না, অধিকন্তু সেই বিল ও রসিদ নিজে রাখিয়া দিলেন। পাইল প্রস্তুতকারক এই ব্যাপার মেয়র্স কোর্টের গোচর করিলেন। তখন সেই ভদ্রলোক সাধারণের নিকট অপদস্থ হইবার ভয়ে বিলের সমস্ত টাকা মায় মোকদ্দমার খরচা প্রদান করিয়া মোকদ্দমা আপোষে মিটাইয়া ফেলিতে সম্মত হইলেন। বাদীর এটর্নির একজন হিন্দু “কলিকাতার কৃষ্ণকায় বণিক্” বেনিয়ান (মুছুদ্দী) ছিল। এই ব্যক্তি সমাজে সাতিশয় মান্যগণ্য ছিলেন। বাদীর এটর্ণি আপনার এই বেনিয়াটিকে উক্ত ভদ্রলোকের নিকট উক্ত টাকার তাগাদায় পুনঃ পুনঃ প্রেরণ করিতে বাধ্য হন। কিন্তু কোন বারেই কিছুমাত্র টাকা না পাইয়া শেষবারে অত্যন্ত রাগিয়া উঠিলেন এবং উক্ত ভদ্রলোককে বলিলেন যে, যদি এই টাকা দেওয়া না হয়, তাহা হইলে কোন রূপ অশুভফল উৎপন্ন হইতে পারে। এই কথা বলায় সেই “জমিদার” সাহেব ক্রোধে ক্ষিপ্তপ্রায় হইয়া উঠিলেন এবং কৃষ্ণকায় বণিক্কে ধরিয়া কাছারীতে লইয়া যাইবার আদেশ প্রদান করিলেন। তথায় নীত হইলে, বিনা বিচারে তাঁহার হাত পা বাঁধা হইল ও তাঁহাকে কশাঘাত করা হইল এবং “জমিদার” সাহেব স্বীয় চর্ম্মপাদুকাদ্বারা তাঁহার মস্তকে প্রহার করিলেন।
গভর্ণর ভেরেলেষ্ট সাহেব আর একটি আখ্যায়িকা এইরূপে বিবৃত করিয়াছেন;—
১৭৬২ অব্দে জনৈক দেশীয় ব্যক্তি তাহার একটি পত্নীকে পরপুরুষাভিগমন কার্য্যে ধরিয়া ফেলে। প্রাচ্য দেশের সর্ব্বত্রই স্ত্রীলোকেরা তাহাদের স্বামীর ইচ্ছার সম্পূর্ণ অধীন এবং প্রত্যেক স্বামী নিজ পত্নীকৃত অহিতাচরণের প্রতিশোধ গ্রহণকর্ত্তা। সুতরাং ঐ ব্যক্তি পত্নীর অপরাধসম্বন্ধে নিঃসন্দিগ্ধ হইয়া তাহার নাসিকা কর্ত্তনপুর্ব্বক তাহার দণ্ডবিধান করে। পুরুষটি কলিকাতার সেশন (দায়রা) আদালতে অভিযুক্ত হইল। সে সমস্ত ঘটনা স্বীকার করিল, কিন্তু আত্মপক্ষসমর্থনার্থ বলিল যে, আমি যেরূপ বিধিব্যবস্থা ও আচার ব্যবহারসমূহের মধ্যে শিক্ষিত হইয়াছি, তাহার বিরুদ্ধে আমি কোন অপরাধই করি নাই; স্ত্রীলোকটী আমার নিজ সম্পত্তি এবং দেশীয় রীতি-অনুসারে তাহার দুশ্চরিত্রতার নিমিত্ত তাহার দেহে কোনরূপ চিহ্ন করিয়া দিবার অধিকার আমার আছে; আপনারা যে সমস্ত আইন-অনুসারে আমার বিচার করিতেছেন, তাহাদের কথা আমি পূর্ব্বে কখনও শুনি নাই, কিন্তু আমি বিচারক গণকে একটি কথা জিজ্ঞাসা করিতে চাই,—আপনারা কি বিশ্বাস করেন যে, যদি আমি জানিতাম যে ইহার দণ্ড মৃত্যু, তাহা হইলে আপনারা যাহাকে এক্ষণে অপরাধ বলিতেছেন, আমি কখনও তাহা করিতাম কি? এইরূপ সুন্দর আত্মপক্ষ সমর্থন-সত্ত্বেও ঐ ব্যক্তি অপরাধী বিবেচিত হইয়া মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হইয়াছিল, কারণ যদি আদালতের বিচার-ক্ষমতা থাকে, তাহা হইলে উহা অবশ্য ইংরেজের আইন-অনুসারেই বিচারকার্য্য নির্ব্বাহ করিবে।”
রাধাচরণ মিত্র নামক এক ব্যক্তি ও জাল করার অপরাধে মৃত্যু দণ্ডাজ্ঞা প্রাপ্ত হয়, কিন্তু কলিকাতার অধিবাসীরা ১৭৬৫ অব্দের মার্চ্চ মাসে এক আবেদনপত্র প্রেরণ করায় ঐ দণ্ডাজ্ঞা রহিত হইয়া যায়। রাধাচরণ মিত্রের বৃত্তান্ত সাধারণের নিকট সুবিদিত আছে, সুতরাং এস্থলে তাহার সবিস্তার উল্লেখ নিপ্রয়োজন। বস্তুতঃ “কলিকাতা রিভিউ পত্রে” জনৈক লেখক লিখিয়াছেন যে, “মেয়র্স কোট গভর্ণমেণ্টের অঙ্গুলি চালনার অধীন ছিল, এমন অনেক মোকদ্দমা ঘটিয়াছে যে, ঐ সকল স্থলে গভর্ণরের আদেশক্রমে বিচার ব্যর্থ বা রহিত হইয়া গিয়াছে, কারণ গভর্ণর স্বীয় প্রভাব বলে কোর্টের সদস্যগণকে যথেচ্ছ পরিচালিত করতেন। এইরূপে যদিও এমন অনেক দৃষ্টান্ত প্রদর্শন করা যাইতে পারে যে, তদ্বারা বিচার বিতরণ কার্য্যে ব্যক্তিবিশেষের খেয়াল বা অযোগ্যতার বিশিষ্ট পরিচয় পাওয়া যায়, তথাপি ঐ সকল বিচারালয়ের দ্বারা যে তৎকালে মহোপকার সাধিত হইয়াছিল, তাহাতে মুহুর্ত্তমাত্রও সন্দেহ করিবার কোন কারণ নাই। ঐগুলি সমাজের উপরও অতি সুস্পষ্ট শুভফলসমূহ উৎপাদন করিয়াছিল।
কোর্ট অভ্ রিকোয়েষ্ট (Courtofrepuest) নামক বিচারালয় ১৭৫৩ অব্দে স্থাপিত হয়। ইহাতে ২৪ জন কমিশনার থাকিতেন এবং তাঁহারা সকলেই কলিকাতার অধিবাসিগণের মধ্য হইতে গভর্ণর ও কাউন্সিল কর্ত্তৃক নির্ব্বাচিত হইতেন। যে সকল স্থলে ঋণ, শুল্ক বা বিবাদীয় বিষয় প্যাগোডা বা ৪০ শিলিঙের অনধিক, কেবল সেই সকল মোকদ্দমারই তাঁহারা বিচার করিতেন। প্রতি বৃহস্পতিবারে অভিযোগসমূহ শ্রুত হইত এবং ৩ জন সদস্য উপস্থিত হইলেই বিচারালয়ের অধিবেশন হইত। প্রথম প্রথম দেশীয় অধিবাসীরা কমিশনার নির্ব্বাচিত হইতেন, কিন্তু অবশেষে কেবল ইউরোপীয় বণিক গণই সদস্যরূপে নির্ব্বাচিত হইতেন।
“কোর্ট অভ্ কোয়ার্টার সেশন্স” নামক বিচারালয়ে কেবল নরহত্যা, রাজবিদ্রোহ প্রভৃতি উৎকট অপরাধসমূহের বিচার হইত। ইহাও কথিত আছে যে, এতদ্ভিন্ন কলিকাতায় মোগলদিগের ক্ষমতাধীনে আরও তিনটি বিচারালয় ছিল। কোম্পানির ভূমি ও কুঠির সীমার মধ্যে সুধারা ও শান্তি এবং সুশাসন পরীক্ষা করাই এই সকল বিচারালয়ের আদিম উদ্দেশ্য ছিল।
ইংরেজ কর্ত্তৃক বঙ্গবিজয়ের পর বিচারালয়গুলির অবস্থা উত্তরোত্তর অধিকতর নিয়মবহির্ভূত হইয়া পড়িতে লাগিল। শাসন-তরণীর কর্ণ মুসলমান সুবাদারের হস্তেই ছিল। গুরুতর রাজনৈতিক হেতু বশতঃ তৎকালে শাসনরশ্মি মুসলমানদিগের হস্তে রাখাই অত্যাবশক বিবেচিত হইয়াছিল। এইরূপে রাজক্ষমতা এবং দেওয়ানী ও ফৌজদারী মোকদ্দমার বিচারভার তাঁহাদের হস্তেই থাকিয়া যায়। সুবার শাসন দুই অংশে বিভক্ত ছিল, যথা (১) দেওয়ানী অর্থাৎ রাজস্ব সংগ্রহ এবং দেওয়ানী বিচারের প্রধান প্রধান বিভাগের পরিচালন, এবং (২) নিজামৎ অর্থাৎ সামরিক বিভাগ এবং তৎসহ ফৌজদারী বিচারবিভাগের তত্ত্বাবধান। তৎকালে দেওয়ানী নিজামতের অধীন ছিল। ইহা যেন স্মরণ থাকে যে, ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি ইংলণ্ডের রাজা ও পার্লামেণ্ট সভার শাসনাধীন ছিল। পার্লামেণ্ট সভা আবার ইংলণ্ডের জনসাধারণের অধীন। পলাসীর যুদ্ধের পর কোম্পানি এত দ্দেশে ভূম্যধিকার লাভ করিলেন বটে, কিন্তু তাঁহারা শীঘ্রই দেখিলেন যে তাঁহারা মহা সঙ্কটে পতিত হইয়াছেন। পার্লামেণ্ট তাঁহাদের কার্য্যে হস্তক্ষেপ করিতে লাগিলেন, এবং তাঁহাদিগকে কি পরিমাণ ক্ষমতা ও দায়িত্ব বিধিসঙ্গতরূপে প্রদান করা যাইতে পারে, তৎসম্বন্ধে সদস্যের পর সদস্য বাদানুবাদ করিতে লাগিলেন। ভারতবর্ষের সুশাসনের নিমিত্ত সময়ে সময়ে এক একটা আইন বিধিবদ্ধ হইতে লাগিল এবং তদ্বারা কোম্পানির উপর রাজার ক্ষমতাপরিচালনের ও শাসনের সীমা নির্দ্দিষ্ট হইতে লাগিল। এদিকে ভারতবর্ষে দ্বিবিধ শাসনপ্রণালীর (অর্থাৎ ইংরেজী নীতি রীতিতে পরিচালিত এক প্রণালীর এবং প্রচলিত মুসলমান রীতি অনুসারে পরিচালিত অপর প্রণালীর) ফল অতি সত্বর প্রকাশ পাইতে লাগিল।
বাণিজ্য দ্বারা যে কোন প্রকারে অধিক লাভ করাই কোম্পানি মুখ উদ্দেশ্য ছিল; আবার সুবাদারের অত্যাচার উৎপীড়নে ও শোণিত শোষণে জনসাধারণ একরূপ ক্ষিপ্তপ্রায় হইয়া উঠিয়াছিল। এতৎ সম্বন্ধে জেনারেল বর্জায়ন্ সাহেবের উক্তির উল্লেখ করিলেই এস্থলে যথেষ্ট হইবে। পার্লামেণ্টের কমন্স সভা ১৭৭২ অব্দে ভারতের অবস্থা বিষয়ে অনুসন্ধান করিবার নিমিত্ত যে কমিটি নিযুক্ত করেন, এই মহাত্মা তাহার চেয়ারম্যান্ অর্থাৎ সভাপতি বা অধ্যক্ষ ছিলেন। তিনি বলিয়াছেন, পাপাচার, অর্থশোষণ ও অবিচারের এরূপ দৃশ্য, এরূপ অশ্রুতপূর্ব্ব নিষ্ঠুরাচরণ, এবং নৈতিক সাধুতার প্রত্যেক নিয়মের, প্রত্যেক ধর্ম্মবন্ধনের ও শাসন-প্রণালীর প্রত্যেক নীতির এরূপ প্রকাশ্য উল্লঙ্ঘন পুর্ব্বে আর কখনও দৃষ্ট হয় নাই * * * এরূপ বহু অপরাধ সর্ব্বদা ঘটিত, যাহা মানবপ্রকৃতির সম্পূর্ণ বিরুদ্ধ, এবং এমন বহু কার্য্য, ঘটিত, যাহা বিশ্বাসঘাতকতা ও নরহত্যা দ্বারা সংসাধন করা হইত।
১৭৬৫ অব্দ অতি গুরুতর পরিবর্ত্তনসমূহের সহিত সংশ্লিষ্ট। উক্ত বৎসর লর্ড ক্লাইভ শেষ বার বঙ্গদেশে আগমন করেন। হেষ্টিংস্ নামক স্থানের যুদ্ধের পর “উইলিয়াম কি কঙ্কারের” উপর যেরূপ অতি গুরুতর ও দুঃসাধ্য কার্য্যসাধনের ভার পড়িয়াছিল, এবার লর্ড ক্লাইভও তদ্রূপ গুরুতর ও দুঃসাধ্য কার্য্য সাধনের ভার প্রাপ্ত হন। ইণ্ডিয়া অফিসে ক্লাইবের শত্রুগণ প্রথমে যেভাবে তাঁহার বিরুদ্ধাচরণের ভাব প্রদর্শন করেন এবং তাঁহারা পরে আপনাদের উক্তির প্রত্যাহার করায় ক্লাইভ যে ভাবে উক্ত ভার গ্রহণ করেন, তত্তাবতের পুঙ্খানুপুঙ্খ আলোচনায় প্রবৃত্ত হওয়া এস্থলে অনাবশ্যক। টরেন্স সাহেব স্বকীয় এম্পায়ার ইন্ এসিয়া (Empiare in Asia) নামক গ্রন্থে সেই অবস্থার কথা অতি বিশদভাবে এইরূপে বর্ণনা করিয়াছেন;—
“লোকের চক্ষু আর একবার ক্লাইভের উপর পতিত হইল তিনি যে অবস্থা অর্জ্জন করিয়াছিলেন, তাহার আরাম ও বিলাস উপভোগ করিতে কেবল আরম্ভ করিয়াছিলেন মাত্র। বার্কেলি স্কোয়ার-স্থিত তাঁহার ভবন, তাঁহার সাজসজ্জা, এমন কি তাঁহার পরিচ্ছদ পর্য্যন্ত তাঁহার দৈনিক বিভব ও উল্লাসের পরিচয় প্রদান করিত। পার্লামেণ্ট সভায় তাঁহার আয়ত্তাধীনে এক ডজন ভোট ছিল; এজন্য প্রতিযোগী রাজনৈতিকগণ তাঁহার সঙ্গলাভের চেষ্টা করিত। জীবিত সেনানায়কদিগের মধ্যে একমাত্র তিনিই রীতিমত যুদ্ধে প্রকৃতপ্রস্তাবে জয়লাভ করিয়াছিলেন; এজন্য তিনি হর্স্ গার্ডস (Horse guards) দলে পরম সমাদর প্রাপ্ত হইতেন। ইংরেজদিগের মধ্যে একমাত্র তিনিই জাতীয় ঋণের পরিমাণ বর্দ্ধিত না করিয়া ইংলণ্ডেশ্বরের অধিকার বিস্তৃত করিয়াছিলেন, এজন্য রাজা তৃতীয় জর্জ্জ লেভিতে (দরবারে) তাঁহার সহিত কথা কহিতে ভাল বাসিতেন। সেণ্ট জেমস্ ষ্ট্রীটের খোষপোষাকী ফুলবাবুরা তাঁহাকে ব্যঙ্গবিদ্রুপ করিলেও এবং বিলাসিনী রমণীকুল তাঁহাকে অমার্জ্জিত বলিয়া হাস্যপরিহাস করিলেও জনসাধারণ তাঁহাকে বীর বলিয়া জ্ঞান করিতে লাগিল এবং রাজনীতিবেত্তারা তাঁহাকে অসাধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন শাসক বলিয়া বিবেচনা করিতে লাগিলেন। ইণ্ডিয়া ষ্টকের স্বত্বাধিকারিগণ ভাবিতে লাগিলেন, যদি ক্লাইভকে বুঝাইয়া সুঝাইয়া বঙ্গদেশে প্রত্যাবর্ত্তন করাইতে পারা যায়, তাহা হইলে সমস্তই নিশ্চিত সুন্দররূপে চলিবে। চেয়ারম্যান্ সলিভ্যান সাহেব কিন্তু তাঁহার ব্যক্তিগত শত্রু ছিলেন, এবং তাঁহার সহযোগীদিগের মধ্যে এনেকেই তাঁহার নিকট নত হইতে সঙ্কুচিত হইতে লাগিলেন, কারণ তাঁহারা বুঝিয়াছিলেন যে, তিনিই অতঃপর তাঁহাদের প্রভু হইয়া বসিবেন। কিন্তু এদিকে অবস্থা খারাপ হইতে আরও খারাপ হইয়া উঠিল এবং ত্রুটিসমূহ উত্তরোত্তর বাড়িয়া উঠিতে লাগিল। শতকরা ১০৲ টাকা হারে ডিভিডেণ্ড (লাভ) কিরূপে দেওয়া হইবে, ইহাই ভাবনার বিষয় হইল। ইণ্ডিয়া হাউসে বিষম বাদানুবাদ উপস্থিত হইল, তাহাতে ক্লাইভ, জেদ করিলেন যে, সলিভ্যানকে পদচ্যুত করা হউক। অবশেষে তিনি কলিকাতার শাসন-বল্গা পুনগ্রহণ করিবার ক্ষমতা প্রাপ্ত হইলেন, এবং রাজা তাঁহার এইরূপ নামকরণ করিলেন, এসিয়ার যাবতীয় ইংরেজ সৈন্যের জেনারেল-ইন-চীফ অর্থাৎ প্রধান অধিনায়ক।
ক্লাইভ প্রথমে অতি মহনীয় দৃঢ়তার সহিত কর্ম্মচারিবর্গের সংস্কার-সাধনে ব্রতী হইলেন; এই কার্য্যের নিমিত্ত তাঁহাকে উত্তরকালে বহু ক্লেশ ভোগ করিতে হইয়াছিল। পরে তিনি কোম্পানির অধিকারকে বিধিসঙ্গত ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করিলেন। দিল্লীর প্রবলপ্রতাপ মোগলসম্রাটের নিকট হইতে তিনি দেওয়ানী সনন্দ গ্রহণ করিলেন; ইহাতে বঙ্গের শাসনপ্রণালী এক অভিনব ভিত্তির উপর স্থাপিত হইল। বঙ্গের আভ্যন্তরিক শাসনসংক্রান্ত এই সকল সুব্যবস্থা ব্যতিরিক্ত তিনি কতিপয় সন্ধিপত্রদ্বারা ভারতের অন্যান্য রাজশক্তির সহিতও সম্বন্ধ স্থাপন করিলেন। এই সমস্ত বিভিন্ন প্রকারের শাসন-সংস্কার-সাধনে ও রাজনৈতিক কার্য্যের সম্পাদনে লর্ড ক্লাইভের পারসী ভাষার সেক্রেটারী ও দেওয়ান মহারাজ নষকৃষ্ণ বাহাদুর তাঁহার বিস্তর সাহায্য করেন। দেওয়ানী সনদে যাহা লিখিত হইয়াছিল, তাহার মর্মার্থ এইরূপ;—
“এই সুসময়ে আমাদের রাজকীয় সনন্দ (যাহা সকলকে অবশ্যই মানিয়া চলিতে হইবে) প্রচার করা হইল; যেহেতু উচ্চ ও প্রতাপান্বিত, উন্নত সন্ত্রাগণের মধ্যে মহাসমুন্নত, প্রখ্যাত যোদ্ধাদিগের মধ্যে প্রধান, আমাদের বিশ্বস্ত ভৃত্য ও প্রকৃত শুভকাঙ্ক্ষী, এবং আমাদের রাজকীয় অনুগ্রহলাভের সুযোগ্য ইংরেজ কোম্পানির অনুরাগ ও উপকারের বিবেচনায় আমরা তাঁহাদিগকে বঙ্গীয় ১৯৭২ অব্দের ফসল রবির প্রারম্ভ হইতে বঙ্গ, বিহার ও উড়িষ্যা এই প্রদেশত্রয়ের দেওয়ানি এমনভাবে প্রদান করিলাম যে, ইহাতে অন্য কোনও ব্যক্তির সংস্রব থাকিবে না এবং আদালত দেওয়ানি নিমিত্ত যে শুল্ক প্রদান করিতেন, তাহাও তাহাদিগকে দিতে হইবে না, অতএব ইহা আবশ্যক যে, উক্ত কোম্পানি রাজকীয় করস্বরূপ বার্ষিক ২৬ লক্ষ টাকা প্রদানের প্রতিভূ হইতে অঙ্গীকারাবদ্ধ হন (এই টাকা নবাব নাজুম্-উদ্দৌলা বাহাদুরের সময় হইতে নিরূপিত হইয়াছে) এবং ঐ টাকা নিয়মিতরূপে রাজসরকারে প্রেরণ করেন, এবং এই স্থলে, যেহেতু উক্ত কোম্পানিকে বঙ্গ প্রভৃতি প্রদেশগুলির রক্ষার জন্য বহুসৈন্য পোষণ করিতে হইবে, অতএব রাজসরকারে উক্ত ২৬ লক্ষ টাকা প্রেরণের পর এবং নিজামতের সমস্ত ব্যয়নির্ব্বাহের পর পূর্ব্বোক্ত প্রদেশগুলির রাজস্ব হইতে যাহা কিছু উদ্বৃত হইবে, তাহা আমরা তাঁহাদিগকে অর্পণ করিলাম। ইহাও আবশ্যক যে, আমাদের রাজকীয় বংশধরগণ, উজিরগণ, মর্য্যাদা-দাতৃগণ, উচ্চপদস্থ ওমরাহগণ ও কর্ম্মচারিগণ দেওয়ানীর মুৎসুদ্দিগণ, সুলতানের কার্য্যের ম্যানেজার (তত্ত্বাবধায়ক), জায়গীরদার ও ক্রৌড়ীয়গণ, ইঁহারা ভাবিকালীনই হউন, বা বর্ত্তমান কালীনই হউন যাঁহারা আমাদের রাজকীয় ক্ষমতা অক্ষুন্ন রাখিবার নিমিত্ত সতত চেষ্টা করিয়া থাকেন, তাঁহারা সকলেই যেন উক্ত পদটি পূর্ব্বোক্ত কোম্পানির হস্তে পুরুষানুক্রমে চিরদিনের নিমিত্ত থাকিতে দেন। ইঁহারা কস্মিন্ কালেও পদচ্যুত হইবেন না, এইরূপ বিবেচনা করিয়া তাঁহারা কোনও কারণেই ইঁহাদের কার্য্যে ব্যাঘাত উপস্থিত করিবেন না এবং ইঁহারা যে দেওয়ানীর সর্ব্বপ্রকার শুল্ক প্রদান ও রাজকীয় দাবী হইতে বিমুক্ত, ইহা তাঁহারা অবশ্যই জ্ঞান করিবেন। আমাদের এতদ্বিষয়ক আদেশাবলী অতিশয় কঠোর ও সুনিশ্চিত বুঝিয়া তাঁহারা যেন তাহা হইতে বিচ্যুত না হন। ইতি তারিখ জালুসের ষষ্ঠ বর্ষের ২৪শে সফর, ১২ই আগষ্ট ১৭৬৫।”
ক্লাইভ দেওয়ানী লাভ করিয়া যান বটে, কিন্তু ওয়ারেন্ হেষ্টিংসই দেশের শাসনকার্য্যে উহার পূর্ণ প্রয়োগ করেন। ক্লাইভ বিচারবিভাগের কার্য্য-দেওয়ানী, ফৌজদারী ও রাজস্বীয় নবাবের হস্তে রাখিয়াছিলেন, কিন্তু তিনি তাহার প্রকৃত তত্ত্বাবধানের এক প্রথা প্রবর্ত্তিত করিয়াছিলেন; উহাই ডবল গবর্ণমেণ্ট অর্থাৎ দ্বিবিধ শাসনপ্রণালী নামে অভিহিত হইয়াছে। এইরূপে তিনি যে সামান্য সংস্কার প্রবর্ত্তিত করেন, তাহা কিছু দিনের জন্য একরূপ চলিয়াছিল কিন্তু কু-শাসন ও অত্যাচার উৎপীড়ন পুনরায় জাগিয়া উঠিল। অবশেষে ১৭৭১ অব্দে ডিরেক্টরেরা তাঁহাদের অভিপ্রায় ব্যক্ত করিলেন যে, তাঁহারা স্বয়ং দেওয়ান হইবেন এবং কোম্পানির কর্ম্মচারিগণ দ্বারা স্বহস্তে রাজস্বের সমস্ত পরিচালন ও তত্ত্বাবধানভার গ্রহণ করিবেন। ইহাতে ভূসম্পত্তি-সংক্রান্ত স্বত্বসমুহের সম্পূর্ণ পুনর্গঠনের এবং বিচারবিতরণের কার্য্য স্বহস্তে গ্রহণের প্রয়োজন হইয়া উঠিল। যে নীতি ইতঃপূর্বে স্থিরীকৃত হইয়াছিল, সেই নীতি অর্থাৎ শাসনব্যাপার ইংরেদিগের তত্ত্বাবধানাধীনে নবাবের কম্মচারিবর্গের হস্তে পরিত্যাগ এবং রাজকার্য্যপরিচালনের প্রত্যক্ষ ভার কোম্পানির কর্ম্মচারিগণের হস্তে অর্পণরূপ নীতি ইহা দ্বারা সুস্পষ্টরূপে পরিব্যক্ত হইল। ইহার পরেই ওয়ারেন্ হেষ্টিংস মাদ্রাজ হইতে স্থানান্তরিত হইয়া বঙ্গের গভর্ণরের পদ প্রাপ্ত হইলেন এবং ১৭৭২ অব্দের প্রথম ভাগে বাঙ্গালায় আসিয়া উপস্থিত হইলেন। ওয়ারেন হেষ্টিংসই শাসনকার্য্যের প্রত্যক্ষ দায়িত্ব স্বহস্তে গ্রহণ করিলেন এবং ক্রমে ক্রমে মহম্মদীয় আইন ও আফিসগুলি উঠাইয়া দিয়া তত্তৎ স্থলে কোম্পানির রেগুলেশন ও ভৃত্যবর্গকে সংস্থাপন করিলেন। অবশেষে তিনি রাজধানী ও তৎসহ প্রধান প্রধান বিচারালয়গুলি মুর্শিদাবাদ হইতে কলিকাতায় উঠাইয়া আনিলেন। পাদরি গ্রীগ সাহেব এতৎ সম্বন্ধে তাঁহার ক্রিয়াকলাপের এই রূপ বর্ণন করিয়াছেন;—
তিনি প্রদেশত্রয়ের কার্য্যের তত্ত্বাবধানের ভার গ্রহণ করিয়া দেখিতে পাইলেন যে, কোষাগার অর্থশূন্য ও গবর্ণমেণ্ট স্বয়ং প্রভাবশূন্য। কেহই বলিতে পারিত না, রাজস্ব কিরূপে সংগৃহীত হইত; তাহাও আবার বৎসর বৎসর উত্তরোত্তর অল্প লাভজনক হইতেছিল। এমন কোন বিচারালয় ছিল যে, যেখানে লোকে প্রবলের অত্যাচারের বিরুদ্ধে বা দুর্ব্বলের চাতুরীজালের বিরুদ্ধে আবেদন করিতে পারে। পুলিশের অবস্থা অতীব শোচনীয় ছিল; তদ্রুপ পুলিশকে তৃণজ্ঞান করিয়া দস্যুগণ দলে দলে দেশের সর্ব্বত্র বিচরণ করিত। তদুপরি এক ভীষণ দুর্ভিক্ষ উপস্থিত হইয়া বহু লোককে গ্রাস করিয়াছিল; এক্ষণে তাহার ফলে বিষম দারিদ্র ও রোগ দেখা দিল—দুর্ভিক্ষতাবশিষ্ট লোকেরা প্রাণপণ চেষ্টা করিয়াও তাহার গতিরোধ করিতে সমর্থ হইল না। বাণিজ্যের অবস্থাও তদ্রুপ; দেশীয় ও বিদেশীয় উভয় প্রকার বাণিজ্যই অংশতঃ ব্যক্তিবিশেষের অসদাচরণবশতঃ ও অংশতঃ বিভিন্ন বিভাগের শীর্ষস্থানীয়গণের ঔদাসীন্য হেতু সম্পূর্ণ ধ্বংস প্রাপ্ত হইয়াছিল। সামান্য দুই বৎসর কালের মধ্যে হেষ্টিংস সাহেব এই অবস্থায় সম্পূর্ণ বিপর্য্যয় করিয়া তুলিলেন। ডাকাইত, সন্ন্যাসী এবং অন্যান্য লুণ্ঠনকারীদিগের অত্যাচার হইতে প্রদেশগুলিকে ক্রমশঃ উদ্ধার করা হইল। উহারা যেখানেই দেখা দিতে লাগিল, তিনি সেইখানেই উহাদিগকে ধরিয়া সাজা দিতে লাগিলেন, এবং এই রূপে অবশেষে উহাদের উৎপাত নির্ম্মূল করিলেন। রাজস্ব সংগ্রহ বিষয়ের দারুণ বিশৃঙ্খলা নিবারণ করিবার নিমিত্ত তিনি পরীক্ষাস্থলে প্রথমে পাঁচ বৎসরের নিমিত্ত ভূমির যে বন্দোবস্ত করিলেন, তৎকালের সমস্ত অবস্থা পর্য্যালোচনা করিয়া দেখিলে বুঝা যায় যে, তদপেক্ষা উৎকৃষ্ট বন্দোবস্ত সে সময়ে আর হইতে পারিত না। বিচারকার্য্যনির্বাহার্থ তিনি জেলায় জেলায় ডিস্ট্রিক্ট কোর্ট স্থাপন করিলেন এবং সাধারণের শান্তিরক্ষার্থ জেলায় জেলায় ডিস্ট্রিক্ট অফিসার নিযুক্ত করিলেন। ইহাতে শাসনসংস্কারের বিলক্ষণ সৌকর্য্য সাধিত হইল। তিনি সুপ্রীম কাউন্সিলকে কতিপয় কমিটিতে বিভক্ত করিলেন, এবং যে সমস্ত তত্ত্বাবধায়ক বোর্ড দ্বারা কোন কাজই হইত না, সেই সমস্ত বোর্ডের স্থলে এক এক বিভাগের উপরে এক এক জন সুপারিণ্টেণ্ডেণ্ট (তত্ত্বাবধায়ক) নিযুক্ত করিলেন, ইহাতে কার্য্য-বস্তু সুন্দররূপে চলিতে লাগিল এবং তাহার বিভিন্ন চক্রসমূহ যথানিয়মে ও সুশৃঙ্খলে ঘুরিতে লাগিল।
এদিকে যথাকালে হেষ্টিংস সাহেব ইণ্ডিয়া অফিসের সহকারিতায় ও সহযোগিতায় নানা বিভাগের সংস্কারসাধনের পন্থা আবিস্কার করিতেছিলেন, ওদিকে তৎকালে ইংল্যাণ্ডের জনসাধারণ কোম্পানীর কর্ম্মচারিগণের প্রতি বিরূপ হইয়া উঠিতেছিলেন; কারণ ঐ সকল কর্ম্মচারী কতিপয় বৎসর মাত্র এদেশে থাকিয়া অগাধ ধনসম্পত্তিসহ স্বদেশে প্রত্যাবৃত্ত হইতেন এবং প্রাচ্য রাজার হালে জীবনের অবশিষ্ট কাল অতিবাহিত করিতেন। এইরূপ আকস্মিক ভাগ্যবিবর্ত্তনে অনেকেরই বিষম ঈর্ষার উদ্রেক হইত এবং তজ্জন্য তাহাদের নামে নানাপ্রকার দোষারোপ হইত। ক্রমে ভারতপ্রবাসী ইংরেজগণের নিন্দাবাদে ওয়েষ্ট মিনিষ্টার প্রাসাদের ভিত্তি সমূহ প্রতিধ্বনিত হইতে লাগিল, এবং তাহাদের অন্যায্য অর্থোপার্জ্জন অসম্ভবপর করিয়া তুলিবার নিমিত্ত ও ভারতরাজ্যের শাসন ব্যাপার সুনিয়মে পরিচালিত করিবার জন্য বিবিধ বিধিব্যবস্থা ও আইন কানুন স্থিরীকৃত ও বিধিবদ্ধ হইতে লাগিল।
১৭৭২ অব্দে ওয়ারেন্ হেষ্টিংস কলিকাতার সদর দেওয়ানী আদালত নামে একটি চরম বিচারালয় প্রতিষ্ঠিত করেন। প্রথম প্রথম প্রেসিডেণ্ট এবং কাউন্সিলের তিন জন বা ততোধিক সংখ্যক সদস্য লইয়া এই কোর্টের অধিবেশন হইত। মফস্বল আদালতের যে যে স্থলে বিবাদের বিষয়ীভূত সম্পত্তির মূল্য ৫০০০৲ টাকার অধিক হইত, সেই সেই স্থলেই ঐ সকল আদালতের উপর ইহার অধিকার ছিল।
পার্লামেণ্ট মহাসভা ভারতরাজ্যের শাসনসৌকার্য্যার্থ ১৭৭৩ অব্দে “রেগুলেটিং একট্” নামে যে একটী আইন জারি করেন, তাহার বিধানানুসারে কলিকাতায় সুপ্রীমকোর্ট নামক বিচারালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। পার্লামেণ্ট সভার সভ্যগণ দুই দলে বিভক্ত এবং দুই দলের মত পরস্পরের সম্পূর্ণ বিরোধী। এই দুই দলের মধ্যে যখন যে দল প্রবল থাকেন, তখন সেই দলই ইংল্যাণ্ডের মন্ত্রিত্ব করেন। এই সময়ে যে দল মন্ত্রিত্ব করিতেছিলেন, তাঁহাদেরই সবিশেষ যত্নচেষ্টায় উক্ত আইন বিধিবদ্ধ ও সুপ্রীমকোর্ট স্থাপিত হয়। কারণ তাঁহাদের মনে এইরূপ একটা দৃঢ় সংস্কার জন্মিয়াছিল যে, ভারতস্থ ইংরেজগণ লুণ্ঠন ও প্রবঞ্চনা দ্বারা অগাধ অর্থ উপার্জ্জন করিয়া থাকেন। বিচার ও শাসনবিভাগের স্বতন্ত্রীকরণই এই বিচারালয় স্থাপনের মুখ্য ও ব্যক্ত উদ্দেশ্য ছিল। তাঁহারা মনে করিয়াছিলেন যে, এই সুপ্রীমকোর্ট ইংল্যাণ্ড হইতে প্রাপ্ত সহায়তার বলে ক্রমশঃ নিম্ন আদালতগুলির উপর কর্ত্তৃত্ব করিতে সমর্থ হইবে এবং সমস্ত বিচার বিভাগ শাসনকর্ম্মচারীদিগের অধীনতা-পাশ ছেদন করিয়া স্বাতন্ত্র্য অবলম্বন করিতে পারিবে। সুপ্রীম কোর্টে প্রথমতঃ একজন চীফ জষ্টিস্ (প্রধান বিচারপতি) এবং তিনজন পিউনি জজ অর্থাৎ অধস্তন বিচারপতি নিযুক্ত হন। তাঁহারা গভর্ণর ও কাউন্সিলের অধীন হইলেন, এবং তদ্ভিন্ন তাঁহাদের হস্তে বিস্তৃত দেওয়ানী ও ফৌজদারি ক্ষমতা অর্পিত হইল। এই সকল বিচারপতি এইরূপ সংস্কারবদ্ধ হইয়া বঙ্গে পদার্পণ করিলেন যে, কোম্পানির কর্ম্মচারিগণের অবিচারে ও অযথা উৎপীড়নে এতদ্দেশীয়দিগের দুঃখের অবধি নাই। পশ্চাল্লিখিত আখ্যায়িকায় তাহাদের সেই পূর্ব্ববদ্ধ সংস্কারের বিলক্ষণ পরিচয় পাওয়া যায়। এ দেশের লোকেরা উৎকট অত্যাচার উৎপীড়নে ক্লেশ ভোগ করিতেছে, এইরূপ প্রবল ধারণা লইয়া সুপ্রীম কোর্টের নবনির্ব্বাচিত বিচারপতিগণ যখন চাঁদপাল ঘাটে অবতীর্ণ হইয়া এতদ্দেশীয়দিগকে নগ্নপদ দেখিলেন, তখন তাঁহাদের মধ্যে এক জন অপর জনকে কহিলেন, “ঐ দেখ ভাই। এ দেশের লোক কি দারুণ উৎপীড়নই সহ্য করিতেছে!প্রয়োজনের পূর্ব্বে সুপ্রীম কোর্টের সৃষ্টি হয় নাই। আমি বোধ করি, আমাদের কোর্ট প্রতিষ্ঠার ছয় মাসের মধ্যেই এই সকল হতভাগ্য ব্যক্তি জুতা ও মোজা পায়ে দিবার সংস্থান প্রাপ্ত হইবে।” সুতরাং এই সকল বিচারপতি যে এ দেশে উপস্থিত হইয়া সেই দিনই শাসনকর্ম্মচারীদিগের প্রতিকূলে অস্ত্র ধারণ করিয়া তাহাদের দমনে প্রবৃত্ত হইবেন, তাহাতে আর আশ্চর্য্যের বিষয় কি আছে?
এইরূপে সুপ্রীম কাউন্সিল (১৭৭৩ অব্দের যে রেগুলেটিং এক্টের বিধানানুসারে সুপ্রীম কোর্ট স্থাপিত হইয়াছিল, তাহারই বিধান অনুসারে এই সুপ্রীম কাউন্সিলও সৃষ্ট হয়) এবং সুপ্রীম কোর্ট প্রতিদ্বন্দিভাবে পরস্পরের প্রতি ঈর্ষাপূর্ণ নেত্রে দৃষ্টিপাত করিতে লাগিল, এবং তাহার ফলে বিচার ও শাসনসংক্রান্ত উর্দ্ধতন কর্মচারীরা বিবদমান প্রতিপক্ষরূপে পরস্পরের প্রতিকূলে দণ্ডায়মান হইলেন। চীফ্ জষ্টিস্ এবং তাঁহার সহযোগী বিচারপতিগণ মনে করিতে লাগিলেন, কেবল কলিকাতার উপর কেন, কোম্পানির অধিকারস্থ তাবৎ ভূভাগের উপরই তাঁহাদের একাধিপত্য আছে। এই সময়ে এরূপ কথা ও জনশ্রুতি রটিতে লাগিল যে, এই সকল বিচারপতি যখন ইংল্যাণ্ডের রাজা ও পার্লামেণ্ট সভা হইতে ক্ষমতা লাভ করিয়াছেন এবং যখন তাঁহারা কোন মতেই এ দেশের প্রধান শাসনকর্ত্তার অধীন নহেন, তখন তাঁহারা ইচ্ছা করিলে স্বল্পং গভর্ণর জেনারেল ও তাঁহার মন্ত্রিগণকে পর্য্যন্ত গ্রেপ্তার করিতে পারেন। মেকলে সাহেব স্বীয় স্বাভাবিক ওজস্বিনী ভাষায় এই অবস্থার যে সমুজ্জ্বল চিত্র অঙ্কিত করিয়াছেন, তাহা কিয়দংশে উর্ব্বর মস্তিষ্কের কল্পনাপ্রসূত অতিরঞ্জন হইলেও তাহাতে ইহার অনেকটা আভাস পাওয়া যায়। তিনি লিখিয়াছেন;—“এই ইংরেজ ব্যবহারাজীবগণের আগমনে দেশ মধ্যে যে বিভীষিকার সঞ্চার হইয়াছিল; কোনও মারহাট্টা-আক্রমণেও তাহা হয় নাই। সুপ্রীম কোর্টের সুবিচারের তুলনায় পূর্ব্ববর্তী প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য উৎপীড়কদিগের যাবতীয় অবিচারই পরম সুখকর বলিয়া প্রতীয়মান হইত!”
অবশেষে সুপ্রীম কোর্টের বিচারপতিগণ যখন মফস্বলের প্রাদেশিক বিচারালয়গুলি বিধিসঙ্গতরূপে স্থাপিত কি না এই তর্ক উপস্থিত করিলেন, তখনই বুঝা গেল তাঁহাদের খেয়াল চরম সীমায় উঠিয়াছে। অতঃপর কাশীজোড়ার রাজার সুপ্রসিদ্ধ মোকদ্দমায় সুপ্রীম কাউন্সিল এবং সুপ্রীম কোর্ট প্রকাশ্য সম্মুখ যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইল। সকাউন্সিল গভর্ণর জেনারেল রাজাকে বলিয়াছিলেন, তিনি যেন সুপ্রীম কোর্টের ডিক্রী প্রভৃতি আদেশ মান্য না করেন। সুপ্রীম কোর্টও গভর্ণর জেনারেল এবং কাউন্সিলের সদস্যগণের প্রত্যেকের নামে ব্যক্তিগতভাবে শমন জারি করিলেন। অবশেষে ইংল্যাণ্ডে পার্লামেণ্ট সভায় আবেদন করা হইল, এবং ১৭৮১ অব্দে একটি সংশোধক আইন জারি হইল। তদ্দ্বারা সুপ্রীম কোর্টের ক্ষমতা সীমাবদ্ধ লইল, উহাকে সুপ্রীম কাউন্সিলের অধীন করা হইল এবং মফঃস্বলের বিচারালয়গুলি যে দেওয়ানীর অধীনে প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে, তাহাও স্বীকৃত হইল। এইরূপে ক্ষমতা ও প্রভাব সঙ্কুচিত হওয়ায় সুপ্রীম কোর্ট দ্বারা দেশের সবিশেষ হিত সাধিত হইতে লাগিল এবং উহা শীঘ্রই ইউরোপীয় ও দেশীয় উভয় সমাজের ভক্তি শ্রদ্ধা আকর্ষণ করিতে সমর্থ হইল। এই গুরুতর সমস্যাকালে ওয়ারেন্ হেষ্টিংস যে ধীরতা ও তীক্ষ্ণ মেধার সহিত কার্য্য করেন তাহাতেই এই বার সঙ্কট কাটিয়া যায়। অতঃপর তিনি সুবুদ্ধিসহকারে সার ইলাইজা ইম্পেকে সদর দেওয়ানী আদালতের প্রধান বিচারপতি নিযুক্ত করায় সমস্ত অপ্রীতিকর গণ্ডগোল চুকিয়া গেল। এই ব্যাপার উপলক্ষ করিয়া মেকলে তীব্র সমালোচনা করিয়াছেন এবং ইম্পের চরিত্রের প্রতিও ঘৃণাসূচক শ্লেষোক্তি বর্ষণ করিয়াছেন। কিন্তু “বঙ্গদেশ রক্ষা পাইল, সৈনিক বলের সহায়তা গ্রহণ আর করিতে হইল না।” কেহ কেহ সুপ্রীম কোর্টকে কতকটা একাধারে মিলিত ইংল্যাণ্ডের কোর্ট অভ্ চ্যানসারি (Court of Chancery) ও কোর্ট অভ কিঙস্ বেঞ্চের (Court of Kings Bench) সহিত তুলনা করিয়াছেন।
১৮০১ অব্দে বা তৎসমকালে সুপ্রীম কোর্টের গঠনে আর ও কিঞ্চিৎ পরিবর্ত্তন সাধিত হইল এবং চিহ্নিত সিভিল সার্ভিস (Covenanted Civil Servece) হইতে বাছিয়া আরও দুইজন পিউনি জজ নিযুক্ত করা হইল। ইহার কিছু কাল পরে স্থিরীকৃত হইল যে, সিভিলিয়ানেরাও সুপ্রীম কোর্টের প্রধান বিচারপতির পদ পাইতে পারিবেন। এইরূপে উত্তরোত্তর উহার গঠনে কিছু কিছু পরিবর্ত্তন চলিতে লাগিল। অবশেষে ১৮৬২ অব্দে সুপ্রীম কোর্ট ও সদর দেওয়ানী আদালত এই দুইটি বিচারালয় একত্র মিলিত করিয়া উহাদের স্থলে বর্ত্তমান কলিকাতা হাইকোর্টের সৃষ্টি হইয়াছে। বাঙ্গালা, বিহার, উড়িষ্যা ও আসাম প্রদেশ এই হাইকোর্টের এলাকাধীন। ইহা দুই ভাগে বিভক্ত, আদিম ও আপীল। ইহার আদিম বিভাগ কতকটা পূর্ব্বতন সুপ্রীম কোর্টের এবং আপীল বিভাগ সদর দেওয়ানী আদালতের প্রতিরূপ। ইহার আদিম বিভাগে কেবলমাত্র কলিকাতা শহরের দেওয়ানী মোকদ্দমার প্রথম বিচার হইয়া থাকে। আপীল বিভাগে আদিম বিভাগের এবং মফঃস্বল আদালতের মোকদ্দমার আপলের শুনানী ও বিচার হইয়া থাকে। তদ্ভিন্ন এই বিভাগে ফৌজদারী মোকদ্দমার মোশন ও আপীলের বিচার এবং অন্যান্য কার্য্যও হইয়া থাকে। হাইকোর্টে আবার ইন্সলভেন্সি, এক্লিজিয়াষ্টিক প্রভৃতি কয়েকটি বিভাগ আছে, এবং তদ্ব্যতীত রেজিষ্ট্রার রিসিভার প্রভৃতিও কতিপয় আফিসও ইহার সহিত সংশ্লিষ্ট আছে। দেওয়ানী মোকদ্দমায় স্থলবিশেষে কলিকাতা হাইকোর্টের নিষ্পত্তির বিরুদ্ধে বিলাতের প্রিভি কাউন্সিলে আপীল হইয়া থাকে। প্রিভি কাউন্সিলের বিচারবিভাগের ভার একটি জুডিসিয়াল কমিটির হস্তে ন্যস্ত। উক্ত কাউন্সিলের প্রেসিডেণ্ট লর্ড চ্যানসেলর এবং বিলাতের সর্বোচ্চ শ্রেণীর আর কয়েকজন জজ লইয়া এই কমিটি গঠিত। তদ্ভিন্ন রাজা ইচ্ছা করিলে আরও দুইজন প্রিভি কাউন্সিলরকে কমিটির সদস্য নিযুক্ত করিতে পারেন। ইঁহাদের মধ্যে তিন জন সদস্য উপস্থিত হইলেই আদালতের কার্য্য চলিতে পারে এবং অধিকাংশের মতানুসারে বিচারের জয় পরাজয় হয়। জুডিসিয়ল কমিটির এই কয়েকটী ক্ষমতা আছে, যথা-১ ইচ্ছানুসারে সাক্ষীর জবানবন্দী লওয়া বা লইবার আদেশ করা, (২) পুনর্ব্বার শুনানির নিমিত্ত মোকদ্দমা অধস্তন বিচারালয়ে প্রেরণ করা, এবং (৩) এইরূপ পুনর্ব্বার শুনানীর সময় আরও সাক্ষ্য প্রমাণ গ্রহণ করা, পুর্ব্বে অগ্রাহ্য করা হইয়াছে, এরূপ প্রমাণ গ্রাহ্য করা, পুর্ব্বে যাহা গ্রাহ্য করা হইয়াছে, এরূপ প্রমাণ অগ্রাহ্য করা এবং ইংল্যাণ্ডেশ্বরের অধিকারস্থ রাজ্যের যে কোনও বিচারালয়ে ইশুর বিচারের আদেশ করা। প্রিভি কাউন্সিলের বিচারের উপর আর আপীল চলে না। ১৭২৬ অব্দে যৎকালে মেয়র্স কোর্ট স্থাপিত হয়, তদবধি ভারতবর্ষের উপর প্রিভি কাউন্সিলের আধিপত্য চলিয়া আসিতেছে।
পুর্ব্বতন কোর্ট অভ রিকোয়েষ্টস্ নামক বিচারালয়ের স্থলে ১৮৫০ অব্দে বা তৎসমকালে কলিকাতার “স্মল কজ কোর্ট” স্থাপিত হয়।
গভর্ণর জেনারেল লর্ড উইলিয়ম বেণ্টিঙ্কের শাসনকালে পুলিশের অকর্ম্মণ্যতা ও উৎকোচগ্রহণাদি দোষের কথা সকলের মুখেই বিঘোষিত হইতে লাগিল। এবিষয়ের সংস্কার-সাধন-চেষ্টা প্রথমতঃ প্রেসিডেন্সি নগরগুলিতেই হয়, তদুদ্দেশ্যে প্রথমতঃ ম্যাজিষ্ট্রেট হইতে স্বতন্ত্র কয়েকজন পুলিশ সুপারিণ্টেণ্টে এবং দেশীয় ও ইউরোপীয় বেসরকারী জষ্টিস্ অভ্ দি পীস নিযুক্ত করা হইল। এই পরীক্ষায় উক্ত প্রকার স্বতন্ত্রীকরণ নীতির যৌক্তিকতা সর্ব্বত্রই প্রতিপন্ন হইল। ওদিকে জষ্টিস্ অভ্ দি পীসগণও অতি সন্তোষ জনকরূপে আপনাদের কর্ত্তব্য কর্ম্ম সম্পাদন করিতে লাগিলেন। কাউয়েল সাহেবের সেই ‘লেকচার’ পাঠে অবগত হওয়া যায় যে, বেঙ্গল কাউন্সিলের ১৮৬৬ অব্দের ৪ আইনের বিধানের মর্ম্ম এই যে, কলিকাতার পুলীশের সমস্ত তত্ত্বাবধানের ভার পুলিশ কমিশনার নামক একজন কর্ম্মচারীর হস্তে থাকিবে এবং তিনি লেপ্টেন্যাণ্ট গভর্ণর (ছোট লাট) কর্ত্তৃক নিযুক্ত হইবেন; তদ্ভিন্ন উক্ত কমিনারের আদেশক্রমে তাঁহার কার্য্যসম্পাদন জন্য ছোট লাট্ বাহাদুর তদধীনে এক বা একাধিক ডেপুটি কমিশনার নিযুক্ত করতে পারিবেন। কলিকাতা সহরে বিশেষ এক প্রকার পুলিশ ফৌজ থাকিবে এবং তাহার লোকসংখ্যা ছোট লাট ভারত গভর্ণমেণ্টের অনুমোদন ক্রমে নির্দ্দিষ্ট করিয়া দিবেন। কমিশনার এই সকল লোককে নিযুক্ত করিবেন। তিনি তাহাদের অর্থদণ্ড করিতে এবং উহাদিগকে পদচ্যুত করিতেও পারেন। এতদ্ব্যতীত তিনি বিশেষ আবশ্যক হলে সাধারণ পুলিশের ক্ষমতাবিশিষ্ট স্পেশ্যাল কনেষ্টবলও নিযুক্ত করিতে পারেন। কলিকাতা হাইকোর্টের অধীনে আর দুইটি বিচারালয় আছে। তথায় যাবতীয় মিউনিসিপাল ও পুলিশ সংক্রান্ত এবং অন্যান্য প্রকার ফৌজদারী মোকদ্দমার বিচার হইয়া থাকে, বিচারকার্য্যের সুবিধার নিমিত্ত বর্ত্তমান সময়ে তিন জন ফৌজদারী ম্যাজিষ্ট্রেট তিনটা আদালতের অধ্যক্ষতা করিয়া থাকেন, এবং তদ্ব্যতীত মিউনিসিপল মোকদ্দমার বিচারের নিমিত্ত আর একজন মিউনিসিপাল ম্যাজিষ্ট্রেট আছেন। প্রেসিডেন্সি ম্যাজিষ্ট্রেটগণের প্রথম শ্রেণীর মাজিস্ট্রেটের ক্ষমতা আছে। বোধ হয়, পূর্ব্বে যে জমিদারের কাছারী ছিল এবং কলিকাতায় ইংরেজ দিগের প্রথম উপনিবেশ স্থাপনকালে জষ্টিস অভ্ দি পীসগণের যে কাছারী ছিল, ঐ দুইটি বিচারালয়ের স্থলে কলিকাতা পুলিশ কোর্টের উদ্ভব হইয়াছে। প্রথম অবস্থায় কলিকাতায় দুইটি জেলখানাও ছিল। একটি ছিল লালবাজারে। তৎসম্বন্ধে উল্লিখিত হইয়াছে যে, “উহা বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ও স্বাস্থ্যকর, কিন্তু উহাতে স্ত্রীলোকের জন্য একটি স্বতন্ত্র প্রকোষ্ঠের অভাব আছে।” অপরটি ছিল বড়বাজারে। তৎসম্বন্ধে উল্লিখিত হইয়াছে যে, “একটী আবদ্ধ স্থান, তথায় অত্যন্ত রোগপীড়া হওয়ার সম্ভব।” বর্ত্তমান সময়ে প্রেসিডেন্সী জেল নামক একটি কারাগার ময়দানের (গড়ের মাঠের) উত্তর প্রান্তে অবস্থিত। ইহাও উল্লিখিত আছে যে, শুক্রবার অপরাধীদিগকে বেত্রদণ্ড দিবার দিন বলিয়া নির্দ্দিষ্ট ছিল।
সেকালে ব্যবহারাজীবগণের সহিত কর্ত্তৃপক্ষের প্রায়ই সঙ্ঘর্ষণ উপস্থিত হইত। ১৭৭৪ অব্দে একব্যক্তি লিখিয়াছেন, “ভারতীয় সেনাদলের যাত্রাকালে গলিত মাংসভোজী বায়সদল যেরূপ তাহাদের অনুসরণ করে, তদ্রূপ যে সকল এটর্ণি শিকারের অন্বেষণে জজের অনুগমন করে, তাহারা দেশীয়দিগের মধ্যে মামলাপ্রিয়তার ভাব পরিপুষ্ট রাখিতে সাতিশয় কৃতকার্য্য হইয়া থাকে; তাহার একটি বিশিষ্ট কারণ এই যে, শিশুরা যেরূপ নূতন খেলনা পাইলে অতিশয় আহ্লাদিত হয়, দেশীয়েরাও তদ্রূপ বিরক্তিজনক মামলা মোকদ্দমাদ্বারা পরস্পরকে উত্ত্যক্ত করিয়া তুলিবার সুযোগ পাইলে যারপরনাই সন্তুষ্ট হইয়া থাকে। আর এই যে সমাজের কণ্টকস্বরূপ বেলিফের (পিয়াদার) দল, এই দুর্বৃত্ত দল ভারতে নূতন আবির্ভূত, ইহারা আইনের নির্য্যাতনে উৎপীড়িত হতভাগ্য শিকারের প্রতীক্ষায় সহরের প্রত্যেক রাস্তাতেই ঘুরিয়া বেড়াইতেছে দেখা যায়। যে ইংরেজী উদ্ধত ও উচ্ছৃঙ্খল স্বেচ্ছাচারিতার ভাব গোলামকে প্রভুর প্রতি অবমাননাসূচক ব্যবহার করিতে এবং তাহার সেই ঔদ্ধত্য জন্য যথাযোগ্য দণ্ডিত হইলে তাহাকে ওয়েষ্টমিনিষ্টারে ড্যামেজের (ক্ষতিপূরণের) নালিশ উপস্থিত করিতে শিক্ষা দেয়, অধুনা অতি সামান্য ভৃত্যেরাও সেই উদ্ধত ভাব প্রকাশ করিতে শিক্ষা পাইয়া থাকে। যে সকল ভদ্রলোক আপনাদের গোলামের গায়ে হাত তুলিতে সাহসী হন, তাঁহাদের প্রতি এক্ষণে প্রতিদিনই যথেচ্ছ অর্থদণ্ডের প্রয়োগ হইয়া থাকে। ওয়েস্টমিনিষ্টারে যে বাণিজ্যব্যবসায়ী ম্যাজিষ্ট্রেট মেছুনীর ঝগড়ার বিচার করেন এবং শিলিঙ ওয়ারেণ্টের বিক্রয়দ্বারা জীবিকা নির্ব্বাহ করেন, এরূপ ম্যাজিষ্ট্রেটের অফিস যেরূপ, আজিকালি বাঙ্গালার চীফ জষ্টিসের ভবনও সেইরূপ।
ওয়াল্টার হ্যামিল্টন স্বকীয় গেজেটিয়ারে লিখিছেন, “সুপ্রীম কোর্টে সর্ব্বশুদ্ধ ২০ জন ব্যবহারাজীব স্বাধীনভাবে কার্য্য করিয়া থাকেন, তন্মধ্যে ১৪ জন এটর্নি এবং ৬ জন ব্যারিষ্টার। সে সময়ে ব্যবহারাজীবগণ অগাধ অর্থ উপার্জ্জন করিতেন, এবং তাঁহারা দেশীদিগের মধ্যে মোকদ্দমা বাধাইয়া তাহাদের মামলাপ্রিয়তা বাড়াইয়া তুলিতেন।” আর এক ব্যক্তি লিখিয়াছেন, “ব্যবহারাজীবগণ যে এক এক জন ধনকুবের হইয়া এ দেশ হইতে প্রতিগমন করেন, তাহাতে আশ্চর্য্যের বিষয় কিছুই নাই! তাহাদের ফি অত্যন্ত অধিক! তুমি যদি কোন বিষয়ে একটিমাত্র কথা জিজ্ঞাসা কর, তাহা হইলে তোমাকে একটি সোনার মোহর ঝাড়িতে হইবে, আর তিনি যদি তিন ছাত্রের একখানি পত্র লেখেন, তাহা হইলে অমনি ২৮৲ টাকা। পাছে তাহাদের হস্তে পড়িতে হয়, এই ভয়ে আমার থর থর কম্প উপস্থিত হয়; কারণ এত অধিক ব্যয়ভার বহন করিবার পর কত টাকাই বা উদ্ধার হইবে। যাহা হউক, এস্থলে বলিয়া রাখা আবশ্যক যে, আদালতের রেজেষ্টারিতে ১২ জন এটর্ণির সংখ্যা নির্দ্দিষ্ট আছে; ইহাদিগকে তিন বৎসর মাত্র আর্টিকেলড ক্লার্ক (articled clerk) থাকিতে হয়, কিন্তু ইংল্যাণ্ডে এটর্ণি হইতে হইলে পাঁচ বৎসর কাল এরূপ ক্লার্ক থাকিতে হয়। উইল প্রস্তুত করিবার ফি উহার দৈর্ঘ্যের পরিমাণানুসারে স্থিরীকৃত হইয়া থাকে। সে ফির ন্যূন পরিমাণ পাঁচ মোহর, কিন্তু উর্দ্ধ পরিমাণের নির্দ্দেশ নাই, উহা যথেচ্ছ হইতে পারে। বিবাহ সংক্রান্ত চুক্তি পত্রাদির কথা কি বলিব, তাহাতে লোককে প্রায় সর্বস্বান্ত হইতে হয়, আর আদালতের প্রসেস্ উভয় পক্ষকেই সর্বস্বান্ত করিয়া থাকে। ৺প্যারীচাদ মিত্র লিখিয়াছেন, তৎকালে এটর্ণির ক্লার্ক (উকিলের কেরাণী) হওয়া একটা বিশেষ গৌরবের বিষয় ছিল; তাহার বিদ্যাবুদ্ধি ছিল, কতকগুলি ছাঁকা ছাঁকা বাঁধি বোল, আর যখন তিনি সেই সকল বোলের ব্যবহার করিতেন, তখন লোকের হৃৎকম্প উপস্থিত হইত।
সদর দেওয়ানী আদালত ও সুপ্রীম কোর্ট প্রতিষ্ঠার সহিত উকিল ও প্লীডার নামক আর এক শ্রেণীর ব্যবহারাজীব আবির্ভূত হইয়াছেন। এটর্ণিদিগের সহিত ইহাঁদের প্রভেদ এই যে, ইহাঁরা সকল আদালতেই মোকদ্দমার সওয়াল জবাব করিতে পারেন; কিন্তু এটর্নিরা তাহা পারেন না। এই উকিল ও এটর্নি সম্প্রদায় উত্তরোত্তর সাতিশয় প্রভাবসম্পন্ন এবং কলিকাতা সমাজে বিশেষ গণ্যমান্য হইয়া উঠিতেছেন এই ব্যবসায় বিলক্ষণ অর্থকর বলিয়া যুবকদিগের দৃষ্টি স্বতই ইহার প্রতি আকৃষ্ট হইয়া থাকে, এবং একথা বলিলে বোধ করি কিছুই অত্যুক্তি হইবে না যে, দেশের মধ্যে যাঁহারা বিদ্যাবুদ্ধিতে শ্রেষ্ঠ, তাঁহারাই এই ব্যবসায়ে প্রবিষ্ট হইয়া ইহাকে অলঙ্কৃত করিয়াছেন। প্রথম অবস্থা হইতেই এই ব্যবসায়ে ব্যবহারাজীবগণ অগাধ অর্থ উপার্জ্জন করিয়াছেন। রমাপ্রসাদ রায়, কৃষ্ণকিশোর ঘোষ, প্রসন্নকুমার ঠাকুর, মোহিনীমোহন রায় প্রভৃতি অনেকেই স্ব স্ব উত্তরাধিকারীদিগকে বহুমুল্য সম্পত্তি দিয়া গিয়াছেন। সত্য কথা বলিতে কি, প্রভূত অর্থাগমের এই অভিনব পথ একমাত্র ইংরেজের আবিস্কৃত। আজিকালি উকিল মোক্তারের ছড়াছড়ি হওয়ায় এই ব্যবসায়ের আয় বহুজনের মধ্যে বিভক্ত ও বণ্টিত হইয়াছে বটে, কিন্তু তাহাতে উহার মোট পরিমাণ কিছু মাত্র কমে নাই, বরং উত্তরোত্তর বৃদ্ধিই পাইতেছে। মোকদ্দমার সংখ্যা দিন দিন অত্যন্ত বাড়িয়া উঠিতেছে, আর আইনের বিলম্বও অপরিহার্য্য হইয়া পড়িয়াছে। বিচারকগণ এই নিয়ত বর্দ্ধমান কার্য্য শেষ করিয়া তুলিতে পারিতেছেন না। উকিল ব্যতীত বহুসংখ্যক দেশীয় ও ইউরোপীয় ব্যারিষ্টার আছেন; তাঁহাদের আয়ের কথা শুনিলে সহসা বিশ্বাস করিতে প্রবৃত্তি হয় না। যে সুকল লেখক পূর্ব্বতন ব্যবহারজীবগণের আয় দেখিয়া অবাক হইয়াছিলেন, তাঁহাদের প্রেতাত্মা যদি এক্ষণে এই দেশের অবস্থা দেখিতে আসেন, তাহা হইলে তাঁহাদের অবস্থা কিরূপ হইবে, বলিতে পারা যায় না। বিচার অধুনা সহজে বা সামান্য ব্যয়ে পাইবার উপায় নাই। মোকদ্দমায় কিরূপে সর্বস্বান্ত হইতে হয়, তাহাই বুঝাইবার নিমিত্ত এক সময়ে একটি দেশীয় সংবাদপত্রে একটি বিদ্রুপাত্মক চিত্র প্রকাশিত হইয়াছিল। উহার মর্ম্ম এইরূপ;—দুই ভ্রাতার পৈতৃক একটি দুগ্ধবতী গাভী ছিল। গাভীটীর বিভাগ ও বণ্টন লইয়া ভ্রাতৃদ্বয় বিবাদে প্রবৃত্ত হইল। চিত্রে এক ভাই গাভীর শৃঙ্খল ধরিয়া এবং অপর ভাই তাহার পুচ্ছ ধরিয়া টানাটানি করিতেছে; সেই অবকাশে উকিল বাবু গাভীটী দোহন করিয়া দুধটুকু বাহির করিয়া লইতেছেন।
পূর্ব্বোক্ত বিচারালয় ব্যতীত অন্যান্য যে সকল অফিস আদালত কলিকাতায় স্থাপিত হইয়াছে, স্থানাভাববশতঃ সে সকলে কথা এস্থলে কিছুই বলিতে পারা গেল না। বর্ত্তমান শাসনপ্রণালী যে, এতদ্দশীয়দিগের আচারব্যবহার, রীতিনীতি ও মনোভাবের বিশেষ পরিবর্ত্তন সাধন করিয়াছে, তাহা অস্বীকার করিবার উপায় নাই। বস্তুতঃ শাসনকার্য্যপরিচালনের পাশ্চাত্য প্রথাটী এদেশে সম্পূর্ণ নূতন। প্রজাসাধারণের মস্তকে যে গুরুতর ব্যয়ভার পতিত হইয়াছে, তাহা বহন করা নিতান্ত ক্লেশকর হইয়া পড়িছে। বর্ত্তমান শাসনপ্রণালী হইতে যে সমস্ত উপকার ও সুবিধা লাভ হইয়াছে, তাহা অত্যন্ত অধিক মূল্যে ক্রয় করিতে হইতেছে। এই পরগাছা হইতে যে নানা কুফলও না ফলিতেছে, এরূপও নহে। এ কথা সত্য যে, আমাদের ইংরেজশাসনকর্ত্তৃগণ অতি উন্নত ও মার্জ্জিত ভাব এবং সাধু উদ্দেশ্য লইয়া এদেশের শাসনসংস্কারে অগ্রসর হইয়াছিলেন। পরন্তু তাঁহাদের সদুদ্দেশ্য সত্ত্বেও প্রকৃতপক্ষে যে উপকার লাভ হইয়াছে, তাহা অবিমিশ্র শুভজনক নহে। এই বিশাল সাম্রাজ্যের অধিবাসিবর্গের বিদ্যাবুদ্ধিবিষয়ক নৈতিক ও সাংসারিক উন্নতিকল্পে যে সকল বিধিব্যবস্থা প্রণীত হইয়াছে, তাহার তত্ত্ব আলো চনা করিলে, এই মতের সত্যতা প্রতিপন্ন হইবে। ইংরেজের বিধিব্যবস্থা প্রণয়নপ্রণালী ক্রমোন্নতিশীল। ১৮৫৭ অব্দের সিপাহীবিদ্রোহ প্রশমনের পর যৎকালে ইংল্যাণ্ডেশ্বরী স্বহস্তে ভারতের শাসনদণ্ড গ্রহণ করেন, তদবধি গভর্ণমেণ্টের বিধিব্যবস্থাসমূহ এক নির্দ্দিষ্ট পথে পরিচলিত হইয়া আসিতেছে। ভারতবর্ষ এক্ষণে ইংল্যাণ্ডেশ্বরের সাম্রাজ্যের একটি অংশ হইয়া পড়িয়াছে। সুতরাং ইহার হিতাহিতও এক্ষণে ইংল্যাণ্ডের গভর্ণমেণ্টের সবিশেষ চিন্তার বিষয়ীভূত হইয়াছে।
- ↑ প্রাচীন মোগলসম্রাট্ ও নবাবগণ মুসলমানদিগকে ইংরেজদিগের প্রথানুপ্রাচীন মোগলসম্রাটু ও নবাবগণ মুসলমানদিগকে ইংরেজদিগের প্রথা-সারে কঁসিকাষ্ঠে ঝুলিয়া মৃত্যুদণ্ড গ্রহণ কুরিতে দিতেন না, কারণ তাঁহাদের মতে মুসলমানের পক্ষে ঐরূপ মৃত্যু নিতান্ত অবমাননজনক; সুতরাং প্রাণদণ্ড-যোগ্য অপরাধের স্কুলে মোগলরাজের মুসলমান ও জেণ্ট (হিন্দু) অপরাধী প্রজাদিগকে এরূপ কশাঘাত করা হইত যে, তাহাতেই তাহারা মৃত্যুমুখে পতিত হইত, পরন্তু চাবুক সাওয়ার নামক কর্ম্মচারী সময়ে সময়ে এরূপ কার্য্য পটু হইত যে তাহারা ভারতীয় চাবুকের দুই তিন আঘাতেই দণ্ডিত ব্যক্তিকে শমন-ভবনে প্রেরণ করিতে পারিত।” ষ্টার্ণণ্ডেল সাহেব কৃত কলিকাতা কলেক্টরের ঐতিহাসিক বৃত্তান্ত।